বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে জ্বালানি ও ভোজ্য তেল পাচার

জ্বালানি ও ভোজ্য তেল

বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে জ্বালানি ও ভোজ্য তেল পাচার

জ্বালানি ও ভোজ্য তেলের বাড়তি দাম নিয়ে বাংলাদেশে আলোচনার শেষ নেই। কিন্তু আমাদের পাশের দেশ মিয়ানমারে এক লিটার অকটেনের দাম ৬০০ টাকা। এই পরিস্থিতিতে কক্সবাজারের সাগর পথে মিয়ানমারে দেদারসে পাচার হয়ে যাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রায় আমদানি করা জ্বালানি ও ভোজ্য তেল। এতে করে আমাদের দেশে এসব পণ্যের বাজারে আরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

 

জানা গেছে, মেরিন ড্রাইভে বসে এক লিটার অকটেন নৌকায় তুলে দিতে পারলেই হাতে লাভ মিলছে নগদ ১৬৫ টাকা। আর কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন সাগর থেকে মিয়ানমার উপকূলে পৌঁছলে সেই অকটেনের প্রতি লিটারে লাভ ৩০০ টাকা। আকস্মিক মাদকের চেয়েও তেল পাচারে বেশি টাকা প্রাপ্তির কথায় হুমড়ি খেয়ে পড়ছে উপকুলীয় এলাকার মানুষ।

রাতে এভাবে সাগর তীরের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে তেল পাচারের খবর পেয়ে কক্সবাজারের র‍্যাব-১৫ এর সদস্যরা আকস্মিক অভিযান চালিয়ে এক চালানের ২ হাজার ৯০০ লিটার অকটেন উদ্ধার করেছে।

সেই সঙ্গে অকটেন পাচারের সাথে জড়িত ৬ জন পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ পরিমাণ অকটেন ৬৯টি প্লাষ্টিক কন্টেইনারে করে নৌকায় পাচার করা হচ্ছিল মিয়ানমারে। র‍্যাব সূত্র জানিয়েছে, পাচারকারীরা উখিয়ার একটি তেলের পাম্প থেকে এ পরিমাণ অকটেন প্রতি লিটারে ১৩৫ টাকা করে কিনে নিয়ে যাচ্ছিল ।

র‍্যাব-১৫ এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক (ল' অ্যান্ড মিডিয়া) ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আবু সালাম চৌধুরী গণমাধ্যমকে জানান, সাম্প্রতিক সময়ে কক্সবাজার জেলার সমুদ্রের বিভিন্ন চ্যানেল ব্যবহার করে চোরাকারবারী চক্র জ্বালানি অকটেন পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করে আসছে। এ তথ্যের ভিত্তিতে র‍্যাব-১৫ এর একটি চৌকস আভিযানিক দল শুক্রবার দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার সময় কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভের দরিয়ানগর ব্রিজের ওপর বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে টেকনাফ অভিমুখী দুইটি পিকআপ ভ্যান আটক করে। গ্রেপ্তার হওয়া পাচারকারীরা পিকআপের করেই ৬৯টি কনটেইনারে ভরে এ পরিমাণ অকটেন মিয়ানমারমুখী নৌকায় করে পাচারের জন্য নিয়ে যাচ্ছিল।  

গ্রেপ্তার হওয়া পাচারকারীরা হচ্ছেন যথাক্রমে উখিয়ার জালিয়া পালং ইউনিয়নের সোনারপাড়ার বাসিন্দা মো. আয়াছ ওরফে রিয়াজ (২২), মো. জসিম উদ্দিন (২০), আলী আকবর (৩৮), মো. সোহেল (১৯), মো. এহাছান উল্লাহ ওরফে রহমত উল্লাহ (২৩) ও রামুর হিমছড়ির বাসিন্দা মো. দেলোয়ার (২৪)।  
জিজ্ঞাসাবাদে তারা আরও জানিয়েছে, পরস্পরের সহযোগিতায় দীর্ঘদিন ধরে দেশের বিভিন্ন পেট্রোল পাম্প থেকে পাইকারি দামে জ্বালানি অকটেন ক্রয় করে অধিক মূল্যে অবৈধভাবে সমুদ্রের বিভিন্ন চ্যানেল ব্যবহার করে পার্শ্ববর্তী দেশে চোরাইপথে বেশি দামে পাচার করে আসছিলেন।

টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো, ওসমান গণি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, বেশ কিছুদিন আগে থেকেই জ্বালানি ও ভোজ্য তেল মিয়ানমারে পাচার হয়ে আসছে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে আমাদের পুলিশ দুই দফার অভিযানে মিয়ানমারে পাচারকালে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি ও ভোজ্য তেলের চালান উদ্ধার করেছে।  

তিনি জানান, সদ্য সমাপ্ত জাতীয় নির্বাচনের সময়কালীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ লোকজনের ব্যস্ততার সুযোগটা পাচারকারীরা কাজে লাগিয়েছে।  

ওসি আরও জানান, জ্বালানি ও ভোজ্য তেল পাচার রোধে আরও বেশ কয়েকটি অভিযান চালানো হলেও নানা কারণে তা ধরা যায়নি।

জানা গেছে, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সে দেশের সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে চলমান গৃহযুদ্ধে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা এক প্রকার ম্যাচাকার হয়ে পড়েছে। এমনকি পশ্চিম আরাকানের (রাখাইন রাজ্য) বন্দর শহর মণ্ডুর সঙ্গে জেলা ও বিভাগীয় শহর আকিয়াব এবং রাজধানী ইয়াংগুনের যোগাযোগ রক্ষাকারী সড়কও বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এসব কারণে পণ্য সামগ্রী পরিবহণে সর্বত্র মারাত্নক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। পশ্চিম আরাকানসহ আকিয়াব, ভুচিদং, রাশিদং ও মন্ডু এলাকায় নিত্য পণ্যের দাম এখন আকাশ ছোঁয়া ।  

শনিবার (১৩ জানুয়ারি) সকালে মন্ডুর ব্যবসায়ী আবুল কালাম জানন, বাংলাদেশের এক টাকার সমপরিমাণ হচ্ছে মিয়ানমারের ২৭.৫০ কিয়েত ।

মন্ডু শহরের ব্যবসায়ীরা বলেন, মন্ডু শহরে ৫০ কেজির এক বস্তা পুরান চালের দাম বাংলাদেশি টাকায় ৮ হাজার ৯২৮ টাকা, অর্থাৎ প্রতি কেজির দাম ১৭৮ টাকা। তবে সেখানে নতুন চালের দাম আরও কম। প্রতি লিটার ভোজ্য তেলের দাম এক হাজার ৪৫০ টাকা । প্রতি লিটার অকটেনের দাম ৬০০ টাকা, প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ৪০০ টাকা ।  

টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের পেট্রল পাম্পের মারিক রাশেদ মাহমুদ আলী বলেন, প্রতি লিটার অকটেনের দাম হচ্ছে ১৩৫ টাকা ও ডিজেলের দাম লিটারে ১১১ টাকা।

বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন খোকন সংবাদ মাধ্যমকে জানান, চট্টগ্রামের উপকূল দিয়ে গভীর সাগর পথেও সরাসরি মিযানমারে জ্বালানি পাচার হয়ে যাচ্ছে। টেকনাফ থেকে চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকার জ্বালানি তেলের এজেন্সিগুলো চট্টগ্রামের ডিপো থেকে ৯ হাজার লিটার ভাউচারে ভরে সরাসরি সাগরের নৌকায় কনটেইনারে করে পাচার করে দেয়ার তথ্য ইউপি চেয়ারম্যানের নিকট রয়েছে।  

তিনি জানান, মেরিন ড্রাইভে বসে এক লিটার অকটেন মিয়ানমার গামি নৌকায় তুলে দিতে পারলেই ১৬৫ টাকা নগদ লাভ হাতে আসে। এসব কারণে তার এলাকার লোকজনও দেদারসে পাচার করছে।

টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের চৌকিদার শহিদুল্লাহ জানান, ওই এলাকার বড় ডেইল, শীলখালী, জাহাজপুরা, হাজমপাড়া, মারিশবুনিয়া, নোয়াখালী পাড়া, মহেশখালীয়া পাড়া, হাবিরছড়া, কচ্ছপিয়া, করাচিপাড়াসহ আরো বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে সাগর পথে জ্বালানি ও ভোজ্য তেলের চালান মিয়ানমারে পাচার করা হচ্ছে। এলাকাবাসির অভিযোগ হচ্ছে বাহারছড়ায় পুলিশের একটি তদন্ত কেন্দ্র থাকলেও এ যাবত কেন্দ্রটির পুলিশ পাচারের কোন চালান আটক করতে পারেনি। তবে এ বিষয়ে তদন্ত কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিদর্শক মশিউর রহমান বলেন, পাচার নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন।  

news24bd.tv/আইএএম