ঝুলন্ত তার কি সরবে, নিরচ্ছিন্ন থাকবে কি ইন্টারনেট সেবা?

ঝুলন্ত তার কি সরবে, নিরচ্ছিন্ন থাকবে কি ইন্টারনেট সেবা?

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানী ঢাকার প্রায় সব রাস্তার পাশেই মাথার ওপরে তারের জঞ্জাল। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকা এসব তার ছিঁড়ে মাঝে মাঝেই দুর্ঘটনা ঘটে; কখনও কখনও অগ্নিকাণ্ডেরও কারণ ঘটায়। উচ্চমাত্রার বিদ্যুৎ পরিবাহী তারের সঙ্গে ইন্টারনেট, টেলিফোন ও কেবল টিভির এসব তার অপসারণে সরকার দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা চালিয়ে আসছে।  

গত এক দশক ধরে এজন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা ও উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়।

যদিও বেশ কিছু এলাকায় এরই মধ্যে বিদ্যুতের তার মাটির নিচে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তবে ক্যাবল টিভি ও ইন্টারনেট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সহযোগিতা না পাওয়ায় এসব সেবা সংস্থার তারের জঞ্জাল এখনো মাটির নিচে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। অথচ তারের জঞ্জাল সরাতে উচ্চ আদালত ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নির্দেশ দিয়েছেন। আর এই তার অপসারণ করার নামে টানাটানিতে নেমেছে সংশ্লিষ্ট সরকারি বেসরকারি সংস্থা, রেগুলেটরি কমিশন এবং অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলো।

যদিও নির্দেশনা বাস্তবায়নে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন (ঢাকা উত্তর-ডিএনসিসি ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন-ডিএসসিসি)) এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তারের এই জঞ্জাল অপসারণ শুরু হয়েছে কিছুদিন আগে।

ঝুলে থাকা অবৈধ তার অপসারণে রীতিমতো অভিযান চলছে।  

রাজধানীজুড়ে ঝুলে থাকা অবৈধ এই তারের জন্য ন্যাশন ওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) অপারেটরগুলোকে দায়ী করেছেন ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম।


আরও পড়ুন: ঢাকার যেসব এলাকায় এখন মোটর সাইকেল চালাতে পারবেন না


যদিও তার এই বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করেছে বেসরকারি খাতে কাজ করা দুইটি এনটিটিএন অপারেটর। এনটিটিএন অপারেটরগুলোকে তদারকিতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বিটিআরসির ভূমিকা নিয়ে তোলা মেয়র আতিকের প্রশ্নকেও প্রত্যাখ্যান করেছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার।   

এমনই টানাপোড়নে নিজস্ব ড্রেন বা সড়কের নিচ দিয়ে নিজেরাই ফাইবার অপটিক ক্যাবল বসানোর প্রস্তাব দিয়েছেন ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম। বিষয়টি এনটিটিএন নীতিমালার পরিপন্থী হলেও অনেকটা অনড় অবস্থানে ঢাকা উত্তরের নগরপিতা।

এনটিটিএন অপারেটর সামিট কমিউনিকেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ আল ইসলাম বলেন, “২০০৯ সাল থেকে আমরা এবং আরেকটি প্রতিষ্ঠান ‘ফাইবার অ্যাট হোম’ দেশজুড়ে এনটিটিএন নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করেছি। বিটিআরসি থেকে আমাদের লাইসেন্স প্রদানের সঙ্গে যে শর্ত দেওয়া হয়েছিল আমরা সেগুলো যথাযথভাবে পালন করে আসছি। ঢাকার অলিগলিতে ফাইবার টানতে হবে এমন নির্দেশনা সিটি করপোরেশনও আমাদের কোনোদিন দেয়নি। তবুও আমরা অনেক জায়গাতেই চেষ্টা করেছি। কোনো ভবন পর্যন্ত আমরা ফাইবার নিয়ে গেলে ভবন মালিক ভাড়া চায়। তাহলে আমরা কী করব? এখন যদি একটা সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করে আমাদেরকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয় তাহলে আমরা করব। ”

‘ফাইবার অ্যাট হোম’- এর জনসংযোগ ও রেগুলেটরি বিষয়ক বিভাগের প্রধান আব্বাস ফারুক বলেন, “দেশজুড়ে ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করার আইনি এখতিয়ার শুধু আমাদের; এনটিটিএন অপারেটরদের। এর বাইরে যারা এটা করবেন সেটা গাইডলাইনের পরিপন্থী। আমরা দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে আছি। ডিশ ক্যাবল অপারেটর, আইএসপি (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার) বা অন্য কেউ আমাদের নেটওয়ার্কে আসতে চায় না। আমাদেরকে টাকা দেওয়ার বদলে তারা তার ঝুলিয়ে নিতেই পছন্দ করে। আবার অনেক অবৈধ আইএসপি আছে, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায়ী আছে। তারা যদি এই নেটওয়ার্কের আওতায় আসে তাহলে বিটিআরসির কাছে তারা ধরা পড়ে যাবে। তাই তারা এনটিটিএন এ আসে না। এখন যদি সিটি করপোরেশন বা অন্য কেউ নেটওয়ার্ক বসায় তাহলে আমাদের বিনিয়োগের কী হবে? আমরা ফাইবার অ্যাট হোম এখন পর্যন্ত রাজধানীতে ১৮০০ কিলোমিটার ফাইবার বসিয়েছি। সিটি করপোরেশন চিহ্নিত সকল প্রধান সড়ক ও রাজপথে ফাইবার বসিয়েছি। মাটির নিচ দিয়ে তার বসানোর জন্য প্রতি মিটারে আমরা সিটি করপোরেশনকে কমপক্ষে ২৩০০ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিয়েছি। তাহলে আমাদের ব্যবসার কী হবে?”


আরও পড়ুন: বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কীভাবে, শনিবারের সভায় সিদ্ধান্ত


এদিকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীকে নিজেদের পাশে পাচ্ছে এনটিটিএন অপারেটর। উলটো সিটি করপোরেশন নিজেদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছে না দাবি করে মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, “আমাদের সিটি করপোরেশনগুলো তাদের যে দায়িত্ব পালন করা উচিত ছিল সেটা ঠিক সেভাবে পালন করেনি। তারা আজকে রাতারাতি পুরো শহর সাফ করে তার ফেলে দেওয়ার যে কথা বলছে, সেটা আমার কাছে আত্মঘাতী মনে হচ্ছে। এই সময়ে মানুষ বাসায় অনলাইন ক্লাস করছে, ব্যবসা করছে, অফিসের কাজ অনেকে বাসায় করছে। সেখানে কোনো বিকল্প না করে তার ফেলে দেওয়া আত্মঘাতী হবে। দুই সিটি করপোরেশন কোনো বিকল্প না করে এটা করছে; এটাকে আমি সমর্থন করছি না। আমরাও তারবিহীন শহর পছন্দ করব, কিন্তু বিকল্প করে করতে হবে। ”

সিটি করপোরেশন নিজেরাই অপটিক্যাল ফাইবার বসানোর সুযোগ দেবে এমন বিষয়কে ‘না জেনে বলা কথা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন মোস্তাফা জব্বার।  

তিনি বলেন, “সিটি করপোরেশন যদি কাউকে লাইন টানার সুযোগ দেয় তাহলে সেটা এনটিটিএন অপারেটরগুলোকেই দিতে হবে। এই অধিকার কোয়াব বা আইএসপিএবির নেই। নিজেরা আইন বানালে তো হবে না। মূলত তারা না জেনে কথা বলেছেন। ”

অবশ্য আইনে যাই থাকুক না কেন যে কোনো উপায়ে তারবিহীন শহর চান ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম। এনটিটিএন অপারেটর ছাড়া অন্য কারও ফাইবার অপটিক ক্যাবল নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করা এনটিটিএন গাইডলাইন পরিপন্থী হলেও ‘ডোন্ট কেয়ার’ আতিক।

তিনি বলেন, “এটা এনটিটিএন গাইডলাইনের পরিপন্থী কী না ‘আই ডোন্ট কেয়ার’। আমার শহরের ওপর দিয়ে তার যেতে পারবে না। আমি যদি তার কেটে দেই তাহলে এনটিটিএনের চেয়ে আমার বদনাম বেশি হবে। কারণ এই কোভিডের সময় সবাই বাসায় থেকে ইন্টারনেটে কাজ করছে। কাজেই আমি আমার রাস্তা থেকে পাইপ নেব। এনটিটিএন যদি কিছু করতে পারে তারা আমার সঙ্গে কথা বলুক। হয় এনটিটিএন আগামী এক মাসের মধ্যে সমস্ত রাস্তার নিচ দিয়ে পাইপ দেবে। পাইপ দিয়ে প্রাইস কমিয়ে আইএসপি এবং কোয়াবকে তারা সেখানে প্রবেশ করাবে অথবা রাস্তার নিচ দিয়ে আমি পাইপ দিয়ে দেব। আমি দেখব কোয়াব, আইএসপি আমাদের পাইপ ব্যবহার করে নাকি তাদেরটা ব্যবহার করে। তারা চাইলে আমাদেরটা করবে; চাইলে এনটিটিএনদেরটা করবে। কিন্তু আমাদের শহরে কোনো ঝুলন্ত তার থাকতে পারবে না। ”

এদিকে,  আগামী ১৭ অক্টোবরের মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) বিনা নোটিশে বৈদ্যুতিক খুঁটিতে ইন্টারনেট ও ক্যাবল টিভি নেটওয়ার্ক অপসারণের সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে না এলে, কিংবা এ সমস্যার সমাধান না হলে আগামী রোববার (১৮ অক্টোবর) থেকে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত দেশজুড়ে ইন্টারনেট বন্ধ রাখার হুমকি দিয়েছে আইএসপিএবি ও কোয়াব।

এ প্রসঙ্গে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি এম এ হাকিম বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের যে দাবি-দাওয়া সেটি নিয়ে সরকার অথবা সিটি করপোরেশনের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি। আর তাই পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী রোববার থেকে সারা দেশে এ কর্মসূচি পালন করা হবে। এখন পর্যন্ত এটাই আমাদের সিদ্ধান্ত।

সোমবার (১২ অক্টোবর) দুপুর ১২টায় জাতীয় প্রেসক্লাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বিনা নোটিশে বৈদ্যুতিক খুঁটিতে ইন্টারনেট ও ক্যাবল টিভি নেটওয়ার্ক অপসারণের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন করা হয়।


আরও পড়ুন: এন্টিজেন কিট আমদানিকে বেআইনি বললেন ডা. জাফরুল্লাহ


এতে বলা হয়, বাংলাদেশের বাসাবাড়ি, অফিস ও ব্যাংকসহ সব পর্যায়ে ইন্টারনেট ডাটা কানেক্টিভিটি এবং ক্যাবল টিভি বন্ধ রাখার প্রতীকী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি) ও ক্যাবল অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব)।

বক্তারা জানান, ডিএসসিসি বিনা নোটিশে বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে ইন্টারনেট ও ক্যাবল টিভি নেটওয়ার্ক অপসারণের হঠকারী সিদ্ধান্তের এ কারণে গত দুই মাসে রাজধানীর মগবাজার, সায়েদাবাদ, জিরো পয়েন্ট, ধানমন্ডি, পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ২০ কোটি টাকার ক্যাবল সংযোগ দিতে হয়েছে। এতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইন্টারনেট ক্যাবল টিভি অপারেটর ব্যবসায়ীরা।

আইএসপিএবির সভাপতি আমিনুল হাকিম লিখিতভাবে পাঁচ দফা দাবি জানান। দাবিগুলো হলো: লাস্ট মাইল ক্যাবলের স্থায়ী সমাধান না করা পর্যন্ত কোনো ঝুলন্ত ক্যাবল অপসারণ করা যাবে না। আইএসপিএপি, কোয়াব, বিটিআরসি, এনটিটিএন এবং সিটি করপোরেশনের সমন্বয়ে লাস্ট মাইল ক্যাবল স্থাপন করা হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করতে একটি কমিটির মাধ্যমে সরেজমিন তদন্ত ব্যবস্থা করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাসাবাড়ি, অফিস, ব্যাংকসহ সব পর্যায়ে ইন্টারনেট ক্যাবল টিভি সেবার দাম নির্ধারণ করতে হবে। গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেট পরিষেবা স্বল্পমূল্যে দিতে এনটিটিএনের মূল্য সরকার থেকে নির্ধারণ করতে হবে। গ্রাহক পর্যায়ে নিরবচ্ছিন্ন সেবার নিশ্চয়তা দিতে এনটিটিএনগুলোর সার্বিক সফলতা আছে কিনা তা যাচাই ব্যবস্থা করতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা জানান, যোগাযোগ প্রযুক্তি ছাড়াও বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষা ও চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ খাতে ইন্টারনেট কার্যকর ভূমিকা রাখছে। এর মধ্যে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ভিডিও কনফারেন্স, শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাস, অনলাইনে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়-বিক্রয়, বাড়িতে বসে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন সেবা নিচ্ছেন গ্রাহকরা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বিনা নোটিশে বৈদ্যুতিক খুঁটিতে ইন্টারনেট ও ক্যাবল টিভি নেটওয়ার্ক অপসারণের কারণে আজ গ্রহকরা এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

# রোববার থেকে তিন ঘণ্টা ইন্টারনেট সেবা বন্ধের সিদ্ধান্ত আইএসপিএবি-কোয়াবের

news24bd.tv নাজিম