পবিত্র কোরআন যেভাবে সংরক্ষিত হয়েছে

পবিত্র কোরআন যেভাবে সংরক্ষিত হয়েছে

Other

পবিত্র কোরআনের সংরক্ষণ পদ্ধতি মানবজাতির জন্য এক মহাবিস্ময়। কেননা আল্লাহ তাআলা কোরআনকে মুখস্থকরণ, লিপিবদ্ধকরণ ও মানুষের আমলে বাস্তবায়নের মাধ্যমে সংরক্ষণ করেছেন। তিনি তা সংরক্ষণ করেছেন তার শব্দ, বাক্য, পাঠপদ্ধতি, অর্থ, মর্ম, ব্যাখ্যা, আয়াতগুলো অবতীর্ণ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিত সব কিছুই সংরক্ষণ করেছেন। ফলে কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার পর প্রায় দেড় হাজার বছর গত হলেও কোরআনের এক হরফ ও নুকতা পর্যন্ত পরিবর্তিত হয়নি।

আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমিই কোরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই তা সংরক্ষণ করব। ’ (সুরা : হিজর, আয়াত : ৯)

পবিত্র কোরআনের নির্ভরযোগ্যতা ও সংরক্ষণের ব্যাপারে কোরআনের একাধিক জায়গায় আল্লাহ মানবজাতির প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, ‘এটা সেই কিতাব, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ’ (সুরা : বাকারা,  আয়াত : ২)

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আমার বান্দার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি, তাতে তোমাদের কোনো সন্দেহ থাকলে তোমরা তার অনুরূপ কোনো সুরা আনয়ন করো এবং তোমরা যদি সত্যবাদী হও, তাহলে আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সব সাহায্যকারীকে আহ্বান করো। যদি তোমরা আনয়ন না করো এবং তোমরা কখনোই তা করতে পারবে না, তবে সেই আগুনকে ভয় করো, মানুষ ও পাথর যার ইন্ধন হবে।

অবিশ্বাসীদের জন্য যা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত :      ২৩-২৪)

যেভাবে সংরক্ষিত হয়েছে কোরআন

আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনের ছয়টি জিনিস সংরক্ষণের মাধ্যমে কোরআনুল কারিমকে সংরক্ষণ করেছেন। তা হলো—

১. কোরআনের শব্দ-বাক্য : রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর যে শব্দ ও বাক্যে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছিল, আল্লাহ ঠিক সেই শব্দ-বাক্যে কোরআন সংরক্ষণ করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময়ই তা তাঁর হূদয়ে প্রোথিত হয়ে যেত। এরপর তিনি ওহি লেখক কোনো সাহাবিকে ডেকে তা লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। অতঃপর সাহাবিরা তা মুখস্থ করে ফেলতেন। তবে কোরআনুল কারিম ‘মাসহাফ’ তথা গ্রন্থের রূপ লাভ করে উসমান (রা.)-এর যুগে।

২. কোরআনের অর্থ ও মর্ম : কোরআনের শব্দ-বাক্যের মতো কোরআনের অর্থ ও মর্মও আল্লাহ সংরক্ষণ করেছেন। কেননা অর্থ ও মর্ম সংরক্ষণ করা না হলে মানুষ কোরআনের ভুল ব্যাখ্যায় লিপ্ত হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেই কোরআনের ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আপনার প্রতি কোরআন অবতীর্ণ করেছি মানুষকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য, যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে। যাতে তারা চিন্তা করে। ’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৪৪)

মহানবী (সা.)-এর প্রদত্ত কোরআনের ব্যাখ্যা হাদিসে সংরক্ষিত আছে এবং সেগুলোই কোরআনের ব্যাখ্যার মূল উৎস ও বিশুদ্ধতা নিরূপণের মাপকাঠি। মূলত এটাও আল্লাহর সংরক্ষণপ্রক্রিয়ার অংশ। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর এর বিশদ ব্যাখ্যার দায়িত্ব আমারই। ’ (সুরা : কিয়ামা, আয়াত : ১৯)

৩. ভাষা সংরক্ষণ : কোরআনের ভাষা তথা আরবি ভাষাকেও আল্লাহ সংরক্ষণ করেছেন। পৃথিবীর বহু ধর্মগ্রন্থের ভাষা বিস্মৃত হয়েছে এবং বহু ভাষা সাধারণ মানুষের চর্চার বাইরে চলে গেছে। যেমন—হিব্রু ও সংস্কৃতি। কিন্তু আল্লাহ কোরআনের ভাষা আরবিকে আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদা দান করেছেন এবং তার পঠন-পাঠন সহজসাধ্য করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই কোরআন জগত্গুলোর প্রতিপালকের থেকে অবতীর্ণ। জিবরাইল যা নিয়ে অবতরণ করেছে আপনার অন্তরে, যাতে আপনি সতর্ককারী হতে পারেন। অবতীর্ণ করা হয়েছে সুস্পষ্ট আরবি ভাষায়। ’ (সুরা : শুআরা, আয়াত :    ১৯২-১৯৫)

৪. আমল : আল্লাহ মুমিনের আমলের মাধ্যমেও কোরআনের প্রায়োগিক রূপও সংরক্ষণ করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন কোরআনের বিধানের প্রথম বাস্তবায়নকারী। তিনি তাঁর কথা ও শিক্ষা, আচার-আচরণ ও দৈনন্দিন জীবনের মাধ্যমে উম্মতকে কোরআনের প্রায়োগিক শিক্ষা দান করেছেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা নামাজ আদায় করো যেভাবে আমাকে নামাজ আদায় করতে দেখো। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০০৮)

আর এ জন্যই আয়েশা (রা.) বলেন, ‘নবী (সা.)-এর চরিত্র ছিল কোরআন। ’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ১৬০১)

৫. কোরআনে নবীর জীবনচরিত্র সংরক্ষণ : মহান আল্লাহ শুধু কোরআন সংরক্ষণ করেননি, বরং যে মহিমান্বিত নবীর ওপর কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে তাঁর জীবনীও সংরক্ষণ করেছেন। সংরক্ষণ করেছেন তাঁর বংশধারা, পারিবারিক ইতিহাস এবং তাঁর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের প্রতি অধ্যায়; যেন পৃথিবীর কোনো মানুষ তাঁর চরিত্রে কালিমা লেপন করতে না পারে এবং তাঁর প্রচারিত কোরআনের ব্যাপারে কোনো সংশয় পোষণ করতে না পারে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আপনার আলোচনাকে সমুচ্চ করেছি। ’ (সুরা :  আশ-শরাহ, আয়াত : ৪)

 আরও পড়ুন:

যে দোয়ায় মিলবে জান্নাত

৬. কোরআনের বাহকদের জীবনী সংরক্ষণ : মহানবী (সা.)-এর সাহাবিদের থেকে পরবর্তী যুগে মনীষীদের মধ্যে যাঁরা কোরআনের বাহক ছিলেন, যাঁরা দ্বিনি ইলম (ধর্মীয় জ্ঞান) চর্চায় নিজেদের নিয়োজিত করেছিলেন, মুসলিম মনীষীরা তাঁদের জীবন ও ইতিহাস সংরক্ষণ করেছেন। বিশেষত কোরআনের কোনো ব্যাখ্যাকার ও হাদিসবিশারদকে গ্রহণযোগ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আগে তাঁরা অবশ্যই তাঁদের সততা, আল্লাহভীতি ও মেধা-প্রতিভাকে নানাভাবে যাচাই-বাছাই করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় ধর্মীয় জাতিগুলোর মধ্যে মুসলিমরাই ‘আসমাউর রিজাল’ নামক এক অনন্য শাস্ত্রের উদ্ভব করেছেন। বিশেষত রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে সরাসরি কোরআনের শিক্ষা লাভ করে যাঁরা পুরো পৃথিবীতে তা ছড়িয়ে দিয়েছেন, তাঁদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহর রাসুলের সামনে নিজেদের কণ্ঠস্বর নিচু করে, আল্লাহ তাদের অন্তরকে আল্লাহভীতির জন্য পরীক্ষা করে নিয়েছেন। তাদের জন্য আছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার। ’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ৩)

মহান আল্লাহ সবাইকে কোরআনের প্রতি যথাযথভাবে ঈমান আনার তাওফিক দান করুন। আমিন।  

 

এই রকম আরও টপিক