ভবিষ্যতের করোনা ও বুস্টার ডোজের প্রয়োজনীয়তা

সংগৃহীত ছবি

ভবিষ্যতের করোনা ও বুস্টার ডোজের প্রয়োজনীয়তা

অ্যান্ড্রু পোলার্ড  

বৈশ্বিক মহামারি চলছে প্রায় দুই বছর ধরে। এই সময়ে কভিড-১৯ নামের দানবটি পৃথিবীর প্রতিটি কোনায় দাপিয়ে বেড়িয়েছে। কেড়ে নিয়েছে ৫৫ লাখের অধিক মানুষের প্রাণ। তবে আমরাও অসম্ভব গতি ও উদ্দীপনা নিয়ে লড়াই করেছি।

এ কারণেই ২০২০ সালের প্রথম দিকের তুলনায় আজকের পরিস্থিতি একেবারে ভিন্ন। এই ফেব্রুয়ারির শুরুতে সারা বিশ্বে এক হাজার কোটি ডোজ টিকাদান সম্পন্ন হবে। এর মধ্যে কোভ্যাক্স প্রকল্প নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে ১০০ কোটি টিকা সরবরাহ করেছে। ফলে এক বছরের বেশি সময় পর ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে দৈনিক মৃত্যু এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে।

এর পরও দানবটিকে শেষ করে দেওয়া গেছে বলা যাবে না। এমনকি ভবিষ্যতে কভিড-১৯ একেবারে অদৃশ্য হয়ে যাবে তা-ও না। এই গ্রহ থেকে একটি মাত্র মনুষ্য সংক্রামক রোগ নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে। সেটা হচ্ছে গুটিবসন্ত। তাও প্রায় ২০০ বছর সময় লেগেছে। পোলিও এখন বিলুপ্তির কাছাকাছি। এর পেছনেও ৭০ বছরের প্রচার-প্রচারণার দরকার হয়েছে। কভিড-১৯ মোকাবেলা আরো বেশি জটিল হতে পারে। গুটিবসন্ত ও পোলিওর মতো ভাইরাসগুলোর তুলনায় কভিড-১৯ মানুষের শরীরে গড়ে ওঠা ইমিউনিটি বা প্রতিরোধক্ষমতার (তা সংক্রমিত হয়ে হোক বা টিকা নিয়ে হোক) চারপাশে নিজের পথ খুঁজে নিতে অনেক বেশি মরিয়া, যাতে সে মানবজাতির মধ্যে টিকে থাকতে পারে। তাই ওমিক্রন বা তার বংশধররা সম্ভবত আরো কয়েক দশক আমাদের সঙ্গে থেকে যাবে।

কভিড-১৯-এর ভবিষ্যৎ চিত্র কিভাবে প্রকাশ পাবে তা আমরা এখনো জানি না। সম্ভবত এর তীব্রতা হ্রাস পাবে। এরপর এটি আরএসভি বা ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো নিয়মিত মৌসুমি ঢেউ হিসেবে ফিরে আসবে। এটাও হতে পারে যে বছরের অন্যান্য সময়েও এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেবে। তবে এরই মধ্যে জনগোষ্ঠীর মধ্যে উচ্চমাত্রার ইমিউনিটি গড়ে ওঠার কারণে এটা খুব বেশি ধারালো হতে পারবে না।

এই সময় আমরা লড়াই করতে শিখেছি। গত ১২ মাসে সবচেয়ে নাটকীয় পরিবর্তন ভাইরাসটির মধ্যে নয়, আমাদের মধ্যে ঘটেছে। ইমিউনিটি হচ্ছে রক্ষাকবচ। এর ফলেই আমরা এখন আবার রাস্তায় হাঁটতে পারছি। টিকা বিশ্বকে বদলে দিয়েছে। এর পরও আমাদের এটা অবশ্যই মেনে নিতে হবে যে সংক্রমণের বিরুদ্ধে সুরক্ষা অসম্পূর্ণ এবং এটা থাকবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রক্ষাকবচটি যখন দুর্বল হয়ে আসবে, তখন সংক্রমণও ফিরে আসবে। তবে গুরুতর রোগ সৃষ্টির বিরুদ্ধে সুরক্ষার বিষয়টি অনেকাংশে বজায় থাকবে। তাই টিকা আসার আগে আমাদের যেভাবে বন্ধ দরজার পেছনে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল সে ধরনের ভয়াবহ পরিস্থিতি ফিরে আসার আশঙ্কা করা আমাদের উচিত হবে না। অন্তত নতুন রোগ নিয়ে আরেকটি মহামারি না আসা পর্যন্ত সেই ধরনের আশঙ্কা আর নেই। আর নতুন কোনো মহামারি এসে আমাদের যাতে আর কাবু করতে না পারে, সে জন্য আমাদের অনেক বেশি প্রস্তুত থাকতে হবে।

এই পরিস্থিতিতে কভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পরবর্তী পর্যায়ের কাজ হলো আমাদের অবশ্যই ২০২২ সালের মধ্যে টিকাপ্রাপ্তি সর্বত্র সহজলভ্য করতে হবে। প্রথম ডোজটি দেওয়ার পর ১৩ মাস অতিবাহিত হয়েছে। এরপর বিশ্বব্যাপী সক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে এখন সর্বত্র টিকা সরবরাহের ব্যর্থতার জন্য কোনো অজুহাত দেখানোর সুযোগ নেই।

এর পরও টিকা সুরক্ষা সর্বজনীন হবে মনে করে অতি আত্মবিশ্বাসী হওয়া আমাদের ঠিক হবে না। কারণ এখনো অনেক মানুষের মধ্যে পর্যাপ্ত ইমিউনিটি তৈরি হয়নি। এর কারণ হয় তারা টিকা নেয়নি (সেটা অপছন্দ বা সুযোগের অভাবে) অথবা তাদের শরীর টিকায় সাড়া দেয়নি। এসব মানুষের আরো অনেক জটিলতা রয়েছে, যা তাদের ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে।

যেসব মানুষ এখনো ঝুঁকিপূর্ণ রয়ে গেছে, তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আমরা এই ভাইরাসটির নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি উন্নত করছি এবং এর ব্যবহার চালিয়ে যাচ্ছি। এর পাশাপাশি কভিড-১৯-এর ভবিষ্যতের সঙ্গে মানিয়ে নিতে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থায়ও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উন্নতি অব্যাহত রয়েছে। এ ক্ষেত্রে হাসপাতালের শয্যা ও জনবল সক্ষমতা বাড়াতে সময় লাগবে। কিন্তু এই মুহূর্তে জীবন রক্ষার জন্য এটা স্পষ্ট যে আমাদের অবশ্যই মহামারির হুমকি মোকাবেলায় টিকে থাকার মতো শক্তি অর্জনের ব্যবস্থা নিতে হবে। এমনকি একটি সাধারণ বছরেও যেন একই ব্যবস্থা থাকে সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। যুক্তরাজ্যে দেখা গেছে, স্বাভাবিক সময়ে ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের ওপর যে চাপ থাকে, তা এমনিতেই এর অভ্যন্তরীণ কর্মীদের জন্য অনেক বেদনাদায়ক। মহামারির সময় সেটা এখন সবাই দেখতে পারছেন।

এটা ঠিক যে সব মানুষকে নিয়মিত বুস্টার ডোজ দেওয়ার প্রয়োজন কিংবা অর্থনৈতিকভাবে কার্যকর বা কাম্য না-ও হতে পারে। তবে শারীরিকভাবে দুর্বল ব্যক্তিরা নিঃসন্দেহে এর থেকে উপকৃত হতে পারে। এখন আমাদের দরকার হচ্ছে কারা কারা ঝুঁকিতে রয়েছে তা আরো ভালোভাবে জানা এবং দুর্বল ব্যক্তিদের জন্য বুস্টার ডোজ দরকার হলে তা কখন দিতে হবে সে বিষয়ে একটি উপায় নির্ধারণ করা। এ জন্য আমাদের হাসপাতালে আসা সংক্রমিত রোগীদের সম্পর্কে বিস্তারিত বিচার-বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

আরও পড়ুন:


 

বিশ্বে করোনায় সংক্রমণ ও মৃত্যু কমেছে


যদি এই ভাইরাসটির ভবিষ্যৎ ধরনগুলো ওমিক্রনের মতোই দ্রুত আসে ও চলে যায়, তাহলে টিকাগুলোতে দ্রুত পরিবর্তন আনাও কঠিন হয়ে পড়বে। তাই হাতে থাকা টিকাগুলোই আমাদের দিয়ে যেতে হবে। যদি ফ্লুর মতো একটি প্রত্যাশিত করোনাভাইরাস মৌসুম শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে যায়, তাহলেই শুধু একটি বার্ষিক হালনাগাদ টিকা সম্ভব।

কভিড-১৯-এর ক্ষতি থেকে বিশ্বকে বাঁচানোর রক্ষাকবচটি কিভাবে আরো উন্নত করা যায় তা আমরা জানি। সে জন্য নজরদারি, সাবধানতা ও বিজ্ঞানের দেওয়া উদ্ভাবিত উপায়গুলোই আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র পথ।

লেখক : অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন গ্রুপের পরিচালক এবং অক্সফোর্ড/অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রধান পর্যবেক্ষক।  সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ 

news24bd.tv রিমু