নকিয়া-১১১০

অলংকরণ: কামরুল

কিস্তি-১৩

নকিয়া-১১১০

অনলাইন ডেস্ক

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতেই আমি মোহাম্মদ আজমের কথার বারিষে দোলা সিল্কি চুল আর কথার দাপটে টেবিল চাপড়ানো ঢেঁড়শের মতো আঙুলগুলোর সন্ধান পাইনি। তাঁর কাছে পৌঁছানোর রাস্তায় অনেক কিছু অতিবাহিত করতে হলো আমাকে। আমি সেসব রাস্তায় কখনো বিড়াল-কাঁটা, কখনো সূর্যমুখীর হাসি, কখনো তেঁতুলের টক, করলার তিতা, আবার কখনো আঁটিসহ পাকা মিষ্টি আম পেলাম।  অনেক রকম সময়; বয়সের সাথে সাথে দেখতে পেলাম অনেক মুডের মানুষও।

সেগুলো নিয়ে একটা মেকি দুঃখবোধ আমাকে সবসময় তাড়িত করতো, ভারাক্রান্ত রাখতো। আসলে বয়সটা কম, তার উপর বুদ্ধিও কিছুটা কম ছিলো (এখনও আছে;  হৃদয় বেশি সক্রিয় থাকলে, বুদ্ধি সুয়ারেজে আটকা পড়া ময়লার মতো জমতে থাকে)। এর সঙ্গে যুক্ত ছিলো বাবা-মা-ভাইয়ের ভুবন-বিজয়ী আহ্লাদের ট্রাক্টর।  

হুমায়ূন আহমেদের 'নক্ষত্রের রাত' নাটকের 'মনীষা' চরিত্রের মতো অবস্থা হয়েছিলো আমার।

ছোট ছোট দুঃখকে পাহাড়সমান মনে হতো। অথচ জীবনের গহীন বেদনার চোরাবালিতে যখন পা-দুটো আটকে যেতে থাকলো, তখন বিগত সব কিছুকেই অতি তুচ্ছ ও বালখিল্য সময়-নষ্ট বলে মনে হতে শুরু করলো।

আরও পড়ুন: বিশ্ববিদ্যালয় ও একজন মোহাম্মদ আজম

তখনও বুঝিনি যে জীবনের সংকটগুলো তাদের এতো তুচ্ছতা দিয়ে আমাকে মালিক-ছাড়া ভিটার মতো অবলীলায় দখল করে নিতে পারার অল্প প্রয়াস করেই সফল হতে পারবে! অন্তত আমার আব্বা আর ভাইয়ের মৃত্যুর পরের সময়গুলো ছিলো আমার জীবনের সব থেকে বড়ো দুঃসময় এবং একই সঙ্গে রাজকীয় সব শিক্ষার সময়। আমি সেই অগভীর সংকটগুলোকে আজ 'খালই'-পূর্ণ (মাছ সংগ্রহ করার বাঁশের পাত্র) ছোট চিংড়ির ক্ষণজীবী উদ্দীপনার মতো জানাতে চলে এলাম।

এইচএসসির রেজাল্টের পরে ২০০৩-এর দিকে ভাইয়া আমাকে আর আম্মুকে মোবাইল ফোন কিনে দেন। আমারটা ছিলো নকিয়া-১১১০ আর মায়েরটা স্যামসাং। মডেলটা মনে নেই। মায়ের ফোন থাকতো ইঁদুরের লেজের মতো এন্টিনার তারের সঙ্গে যুক্ত।
স্বাভাবিক। ২০০৩ সালে গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক আজকের মতো এরকম তারবিহীন আর 'জি'-এর মারদাঙ্গা ও শক্তিশালী নেটওয়ার্কওয়ালা ছিলো না। ফলে, তখনকার দিনে এতো ঘনঘন 'স্বপ্ন বাড়ি যেতো না'। স্বপ্ন নিজের সঙ্গেই থাকতো সবসময়।

আমার নাম্বারটার শেষ ডিজিটগুলো ছিলো বড়োই ঐতিহাসিক: ৭১৫২। ভাইয়া কেন জানি ইচ্ছে করেই এই নাম্বারটা আমার জন্য সিলেক্ট করেছিলেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের কতোটুকু কী বুঝতেন বা ধারণ করতেন ঠিক বুঝতে পারিনি।  তবে সালগুলো যে মাথায় ছিলো এবং সেটা যে মোবাইল নাম্বারেও ধারণ করা যায়, তা আমি এই নাম্বার আমার জন্য বাছাই করাতে বুঝতে পারি। নাম্বারটি আমি এখনও ব্যবহার করি৷ মোবাইলের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবার পর থেকে এ পর্যন্ত দুই-দুইবার মোবাইল হারিয়েছি, তবু নাম্বারটা ছাড়িনি। এর কারণ কি শুধুই ভাইয়ার স্মৃতি আঁকড়ে থাকা, নাকি সহজে নাম্বার মনে রাখার বাস্তবতা, ঠিক বুঝতে পারি না। হয়তো দুটো বিষয়ই একসঙ্গে কাজ করে। আর অভ্যস্ততার মধ্যেও তো এক ধরনের মানসিক নিরাপত্তার ব্যাপার আছে।

আরও পড়ুন: ক্ষমা

নতুন ফোন। তারবিহীন মুঠোফোনে মানুষের সঙ্গে কথা বলার ভেতর দিয়ে অন্যরকম আবেগ কাজ করতো তখন। করারই কথা। অবশ্য এই আবেগের একটা অতি তুচ্ছ ইতিহাসও আছে।  

খুব ছোটবেলায়, যখন সুমনি-নিপাদের সঙ্গে খুটিমুচি খেলতাম, তখন আমি বাসার নষ্ট ক্যালকুলেটারগুলো দিয়ে তারবিহীন ফোন বানাতাম। এই আইডিয়া সম্ভবত সেইসময়ের খুব জনপ্রিয় টিভি-সিরিজ 'ম্যাকগাইভার' থেকে পেয়েছিলাম। ঠিক মনে নেই। সেইসময় ক্যালকুলেটরের ডিজিট টিপে টিপে বান্ধবীদের সঙ্গে 'হ্যালো হ্যালো' করতাম। সেই 'হ্যালো'র তলে কতো জন যে কতো রকম হাসাহাসি করতো! ল্যান্ড ফোনের একচেঞ্জ নির্ভর ঘটর-ঘটরের যুগে তারবিহীর ফোন তো হাস্যকরই লাগার কথা।

বাসায় টিএন্ডটি ফোন এসেছিলো ১৯৯৯ সালের দিকে। তখনও একটা স্বপ্ন পূরণের মতো ঘটনা ঘটেছিলো। ফোনে আব্বু আর আমিই বেশিক্ষণ কথা বলতাম। আব্বু বলতেন তাঁর বন্ধু হেমায়েত চাচার সাথে। আর আমি বলতাম আমার বান্ধবী লিমার সঙ্গে। আম্মু শুধু ফোন রিসিভই করতেন বেশিরভাগ সময়। ভাইয়া তখন থাকতেন ফরিদপুরে। রাজেন্দ্র কলেজে পড়াশোনা করতেন।

আরও পড়ুন : আমার দস্তইয়েভস্কি

খুব ভুল করে না থাকলে ২০০০ বা ২০০১ সালের দিকে ভাইয়া যমুনা গ্রুপে চাকরি শুরু করেন। তখন যমুনা গ্রুপ ছিলো মোটামুটিভাবে আমাদের বৃহত্তর পরিবারের পারিবারিক কর্মসংস্থান। যমুনা গ্রুপের সিডি ছিলেন আমার মায়ের মামা প্রয়াত জনাব জাহিদ হোসেন। তিনি প্রথমে তাঁর ভাগিনা (আমার মেজোমামা) জনাব এম.  সাইদুর রহমান এবং পরে আমার ভাইকে বেকারত্বের স্বাদ গ্রহণের আগেই এই কোম্পানিতে নিয়ে নেন। দুইজনই খুব সিনসিয়ারিটির সঙ্গে চাকরি করেন। দু'জন যোগ্যও ছিলেন।  এছাড়া এই নানা (জাহিদ হোসেন) আমার ছোটচাচা, আব্বুর দুই মামাতো ভাই, এলাকার প্রভাবশালী বাবু মিয়ার ছেলে, টোকন মিয়ার ছেলে এবং পাঠক স্যারের জামাইসহ বোয়ালমারী-আলফাডাঙ্গা অঞ্চলের অনেক শিক্ষিত তরুণকে তাদের যোগ্যতানুযায়ী চাকরি দিয়েছিলেন। ফলে একটা কথা যে প্রচলিত আছে: প্রভাবশালী মামা-চাচার ধ্বজ ধরে চাকরি হওয়া, সেটা মোটামুটিভাবে আমাদের পরিবারের একটা অংশের জন্য সত্য ছিলো।

ভাইয়া সেই চাকরি পেয়ে স্বনির্ভর হয়ে আমাদের পরিবারে একটা অদম্য সচ্ছলতার সুর সংযোজন করলেন। ভেতরে ভেতরে অনেকগুলো অব্যক্ত বেদনা যে আমাদের পরিবারের মাথার ওপর ছায়ার মতো ভেসে থাকতো, তা কিন্তু মিথ্যা নয়। সেসব বলবো হয়তো কখনো। আব্বু গড়তেন ভিত্তি, আর ভাইয়া সেখানে যুগোপযোগী সব বস্তুর সংযোগ ঘটাতেন। তার মধ্যে এই মোবাইল যন্ত্রটি ছিলো একটি। তালিকায় আইপিএসও আছে।

আরও পড়ুন : দাঁড়িয়ে আছি মাধ্যাকর্ষণের টানে

নকিয়া-১১১০। সাদা আর ছাই রঙের একটা ফোন, মনে হতো যেন জাদুর প্রদীপ। প্রথম প্রথম আমার এই ফোনে রিংটোন বাজতো শুধু ভাইয়া আর আম্মুর। পরে কোচিঙের সুবাদে যুক্ত হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের একজন আর ইংরেজি বিভাগের এক ভাইয়ার নাম্বার। প্রাইভেট পড়ার জন্য নিতে হয়েছিলো। থাকতাম বাবার দিকের এক আত্মীয়ের বাসায়। এই ফোন আমার জিম্মায় থাকতো শুধু বাইরে যাবার মুহূর্তে।  বাসায় থাকতো ওই আত্মীয়ের মেয়ের কাছেই। আল্লাহর দুনিয়ার ছেলে-বন্ধু ছিলো তার। এই সম্পর্কে তার মা জানতো নাকি জানতো না তা বড়োই ধোঁয়াশায় কেটেছে আমার। কারণ, ওই ভদ্রমহিলা কোনোদিন তার মেয়ের কোনো ত্রুটি দেখেননি। নিজের মেয়ের নানা কেলেঙ্কারি করে প্রেম করে বিয়ে করাকে সারাজীবন আত্মীয়স্বহনের কাছে চেপে গেছেন আর আমার ছোটবেলার একপাক্ষিক প্রেমের ঘটনা, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া, বিয়ে এবং চাকরিসহ আরো অনেক কিছু নিয়ে সারাজীবন তিনি আত্মীয়স্বজন এবং বাইরের মানুষের কাছে নানা মিথ্যাচার করেছেন। নিজের মেয়ের জঘন্য রকমের অপকর্মগুলো হিজাবের আড়ালে ঢেকে রেখেছেন সারাজীবন। তবু এই ভদ্রমহিলার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই, বৃহত্তর ঢাকার শহরে কিছুদিনের জন্য তিনি আমাকে মাসিক খরচের বদৌলতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। হোস্টেলে বা মেসে থাকার বিড়ম্বনা পোহাতে হয়নি। এছাড়াও তিনি আমাকে প্রথম দেখালেন ঢাকার মানুষ এবং তাদের যাপন কেমন। শুনেছি আমার নানা কাজের বরাত তিনি তার সন্তানদের দিতেন তাদের ভালো করার অনুপ্রেরণা হিসেবে। ব্যাপারটা ভালো লেগেছে। প্রকাশ্যে খারাপ বললেও নিজের ঘরে আমাকে আদর্শ মানার ব্যাপারটা দারুণ কিউট। ভালো রকমের ধাক্কা এবং আশ্রয় দুটোর জন্যই আমি এই নারীর কাছে কৃতজ্ঞ। আজ মহান নারী দিবসে এই নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
 আরও পড়ুন : মা
ফেরা যাক আমার আশ্রয় দাতা ভদ্রমহিলার কন্যার প্রসঙ্গে।
যশোর ক্যান্ট.পাবলিক কলেজ, ২ বছরের কোচিং (সে আমার এক বছরের সিনিয়র ছিলো, কিন্তু কোনো পাবলিকে চান্স না হওয়ায় আমার সঙ্গে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেয়। চান্স না হলেও এমনিতে সে যথেষ্ট ভালো ছাত্রী) মিলিয়ে হালকা-পাতলা প্রেমের সম্পর্ক ছিলো তার অনেক। আমার ফোন নিয়েই সে এইসব কাজ করতো। টুকটুক করে এসএমএস চালাচালি করতো। এখন মনে হয়, মেয়েটা দারুণ স্মার্ট ওই অল্প বয়স থেকেই। আমার ফোনে কী করছে আমাকেই বলতো না। এসএমএস সেন্ড করে ডিলিট করে দেয়ার বিষয়টি তখনও অতো ভালো বুঝতাম না। মেয়েটা খুব দ্রুত টেক্সট দিতো, দিয়েই ডিলিট করে দিতো। আমি কিছুই বুঝতাম না কী ঘটছে আমার নকিয়া -১১১০ ফোনে। আসলে ওইসময় আমার সম্পূর্ণ মনোযোগ ছিলো আসলে পড়ার মধ্যে। শুধু পড়তাম আর পড়তাম। যাকে বলে 'কুত্তা-বিলাই পড়া'।  

তখন একেকটা এসএমএসে সম্ভবত দুই-তিন টাকা করে কাটতো। আর ফোনকল ছিলো ৭ টাকা মিনিট। আমার ফোনের টাকা দিতো ভাইয়া। এতো দ্রুত টাকা শেষ হয়ে যেত দেখে ভাইয়া খুব রাগ করতেন। আর যার বাসায় ছিলাম সেই ভদ্রমহিলাও নাকি ভাইয়াকে উলটা-পালটা কানপড়া দিতেন। আমি প্রেম করে বেড়াই (ছোটোবেলার তুচ্ছ স্মৃতি মনে রেখে বলতো, যে বিষয়ে আগের পর্বগুলোতে বিশদ বলা হয়েছে) ছেলেদের সাথে ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ, হায়! কে কাকে বলবে এই কাজ তার নিজের মেয়েই করতো। ভাইয়া অবশ্য তখন আমাকে এসব কথা বলেনি। বলেছে অনেক অনেক বছর পরে, যখন ভার্সিটিতে পড়তাম। সস্তা প্রেম করে বেড়ালে ভার্সিটিতে চান্স হতো না নিশ্চয়ই! ভাইয়া এটা বুঝতে পেরেছিলেন। হিংসুটে স্ত্রীলোক যে কতোটা ডেঞ্জারাস হয় আমি প্রথম ওই নারীকে দেখে বুঝতে পারি। নিজের মেয়ের ব্যর্থতার রক্তপাত সে আমার সাফল্যের ওপর ফেলেছে আজীবন। ফলে হিংসুটে স্ত্রীজাতির মনস্তত্ত্বের ওই চ্যাপ্টার মুখস্থ হয়ে যাওয়ায় পরে পরিস্থিতি অনুযায়ী সূত্র মিলিয়ে নিতে অসুবিধে হয় না আমার।

আরও পড়ুন : আমার একজন হাড়ে-মজ্জায় শিক্ষক এবং জিনেটিক্যালি খামারি পিতা
সেই আত্মীয়ের মেয়েটি আমার প্রাইভেটের দুই ভাইয়ার সঙ্গে মোবাইলে চুটিয়ে প্রেম করেছে এসএমএসের মাধ্যমে। ইংরেজি বিভাগের সেই ভাইয়া তো একেবারে প্রেমের গর্তে পড়ে হাবুডুবুও খেয়েছেন। অথচ আমি কিছুই জানি না। মুশকিলটা হলো এসএমএস চালাচালি করে প্রেম করবি কর, কিন্তু পরিচয় গোপন করে কেন? দায়িত্ব না নিয়ে এইসব করা অসহ্য লাগে আমার। প্রেমরসে টইটম্বুর এসব এসএমএস আমার ফোন থেকে যেতো, ফলে ভাইয়া ভাবতেন আমিই দিচ্ছি। অথচ তিনি দেখতেন যে দেখা হলে এসব বিষয়ে আমি কিছুই বলছি না। ভাইয়া ভাবতেন আমি মনে হয় খুব লাজুক, তাই সরাসরি কথা বলি না। হায়! আমি তো এ জীবনে লাজুক স্বভাবের কোনোদিনই ছিলাম না! আর আমার তো এসবের দিকে তখন মনও ছিলো না।
একমাত্র টার্গেট ছিলো ঢাবিতে চান্স পাওয়া।

বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার চান্স পাওয়ার পরে ইংরেজি ভাইয়ার খুশি দেখে খুবই অবাক হয়েছিলাম। উনি কেন এতো খুশি হতে যাবেন? পড়তাম তো চারপাঁচজন। চান্সও হয়েছে কয়েকজনের। গোপনে গাঁজা সেবনের চেষ্টা যেমন গন্ধের কারণে গোপন থাকে না, সেরকম আমার মনের সন্দেহও চাপা রইলো না।
সন্দেহ মনের অতলে গিয়ে জিওল মাছের ঝাঁকের মাথা চেপে ধরলো।  
ঘটনা কী আসলে?

আমি ইংরেজি ভাইয়ার সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিলাম।

আরও পড়ুন: আমার বিজ্ঞাপন

অনেকদিন পরে অবশ্য ইংরেজি ভাইয়া একদিন কলাভবনের সবুজ চত্বরে আমাকে ডেকে নিয়ে সব খুলে বললেন। আমি সব অস্বীকার করি এবং বলি এটা আমার বোনের কাজ। ভাইয়া বিশ্বাস করেননি। এটা কেউ বিশ্বাস করবে? 
করার কথা? আমি নিজে হলেও তো বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু জগতে এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা শামুকের গতিতে ঘুরে-ফিরে বেড়ায়। আমরা আইনের খাঁচায় পুরে দিয়ে বিচার করতে বসে যাই। আইনের ভাষা বুঝেও বসি, না বুঝেও বসি। এটা আমাদের মনুষ্য অভ্যাস। আমরা অভ্যাস গড়ে তুলতে খুব পছন্দ করি।
ইংরেজি ভাইয়াও আমার কথা বিশ্বাস না করে এর শোধ নিয়েছিলেন, তারই হলের এক বড়োভাইকে দিয়ে। সেই বড়ো ভাইটিই ছিলো আমার জীবনের একমাত্র অপ্রাপ্ত ভালোবাসার ফসিল। কবি হওয়ার যাত্রা শুরু হলো সেই বড়োভাইয়ের দেয়া উৎকৃষ্ট ও তথাকথিত ছ্যাঁকা খাওয়ার পর।

“প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ। ”
প্রেমের কবিতা দিয়ে নারী হৃদয় হরণ করার কৌশলে রবীন্দ্রনাথ আজীবন একটা গডফাদারের ভূমিকা রেখেছেন। ইংরেজি ভাইয়ের প্রতিশোধ নেয়া সৈনিক সেই বড়োভাই আমার চিত্ত হরণ করেন প্রথমে এই চরণ চারটি দিয়েই।  

আরও পড়ুন: ‘মোর প্রথম মনের মুকুল ঝরে গেল হায় মনে মিলনের ক্ষণে...’

নকিয়া-১১১০ মডেলের ফোনে ইংরেজি ভাইয়ের সেই বড়ো ভাই, যিনি দর্শন বিভাগের ছাত্র ছিলেন, সেই দার্শনিক ভাইয়ের নাম্বার থেকে যে কতো কতো টেক্সট এবং ফোনকল আসতো, তার ইয়ত্তা নেই।
আমার নাম্বারটা ইংরেজি ভাইয়া দর্শন ভাইকে দিয়েছিলেন একটা রিভেঞ্জ নেয়ার উদ্দেশ্যে। অথচ, আমি এক নিতান্ত নাদান বলির পাঠা হলাম আমার সেই আত্মীয় বোনটির জন্য! হায়! এইসব কি মেনে নেয়া যায় এ যুগে?

ওই দর্শন ভাইয়ের নামটা তখন এতো চিকন বা গভীর হয়ে বিঁধে ছিলো আমার হৃদয়ে যে হলের রুমমেট থেকে শুরু করে আমার বন্ধুমহল এমনকি ভাইয়া পর্যন্ত জানতো নামটি। প্রায়ই আমার হলে আসতেন তিনি। তার বাড়ি ছিলো কুমিল্লায়। লোকটা 'ক্যাচকেইচ্যা' বুদ্ধিওয়ালা ধুরন্ধর চালু মাল। আবার পড়েছেন  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে। ফলে ধুরন্ধর বুদ্ধির সঙ্গে একাডেমিক জটিল পঠনপাঠনের এক দুর্দান্ত ঘটনা ঘটে গিয়েছিলো তার মধ্যে। 'লাইসিয়াম' বলে একটা পত্রিকা বের করেছিলেন তিনি। সেটার এক কপি আবার আমাকে দিয়েছিলেনও। তিনি কবিতা লিখতেন, ডিবেট করতেন। আমি এই জন্য তখন ঢাবির ডিবেট ক্লাবে জয়েন করি এবং অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে ব্যর্থ হই। একবাক্যও ডায়াসে দাঁড়িয়ে বলতে পারতাম না। ওইসময় আমার ক্লাসমেট মীর হুমায়ূন কবীর বিপ্লব ছিলো তুখোড় অ্যাংকর। 'রেডিও টুডে'তে 'গুড মর্নিং ঢাকা' বলে একটা অনুষ্ঠান করে দারুণ সাড়া ফেলে দিয়েছিলো। আমি অবাক হয়ে বিপ্লবের 'বাকোয়াজি' দেখতাম আর আমার নিজের অপারগতাকে 'লাত্থি' মারতাম। জায়গামতো মোদ্দা কথাটা বলতে না পারলে লোকে বোকা না হয়েও বোকা বনে যায়। আমি ডিবেট করতে গিয়ে নিজের অপূর্ণতাকে দারুণভাবে আবিষ্কার করলাম। আর আমার ওই তুখোড় তার্কিক ক্রাশের প্রেমে আরও ভালোভাবে পড়ে গেলাম! 

আরও পড়ুন: প্রাইমারির প্রজাপতি-কাল

ডিবেটের পাশাপাশি তিনি প্রথম আলোর পাঠকের কলামেও লিখতেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতে আমি এমন নির্ভেজাল প্রবঞ্চকের (আমার ক্ষেত্রে প্রবঞ্চক বলছি, এমনিতে তিনি নিশ্চয়ই স্বনামধন্য) দেখা পেলাম। অথচ ওই দর্শন ভাইয়ার কোয়ালিটি ছিলো আমার চোখে তখন সেরাদের সেরা! হায় প্রেম! প্রেমে পড়লে কতো কী হয় মানুষের!

দর্শন ভাইয়া আসলে ইংরেজি ভাইয়ার রিভেঞ্জ নেবার জন্য পুরোটা সময় আমার সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে গেছেন। পরে সব স্বীকার করেছেন, আর ইংরেজি ভাইয়াও আমাকে সেটা জানিয়েছিলেন। তিনি এটা করিয়েছিলেন জাস্ট এটা বোঝানোর জন্য যে, কাউকে কষ্ট দিলে কষ্ট পেতে হয়। কিন্তু কষ্ট তো আমি দিইনি। যে দিয়েছে সে কি তার ভাগের কষ্টটা ভোগ করেছে? 
কে জানে? 

আরও পড়ুন: ভাইয়ার 'মনাভাই'

দর্শন ভাইয়া বা ইংরেজি ভাইয়ার স্বীকারোক্তিতে কোনো সমস্যা নাই। একটা অপ্রাপ্তবয়স্ক সম্পর্কের পরিণাম সম্পর্কে এই স্বীকারোক্তি খারাপ না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সবকিছু পরিচ্ছন্ন করবার পর যখন দর্শন ভাইয়া আমাকে নিয়ে রিকশা-ভ্রমণে যাবার প্ল্যান করেন এবং আমাকে আমার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে জড়িয়ে ধরার প্রস্তাব করেন তখন। বলে রাখছি, ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডের মতো ছেলে-মেয়ে অবাধে হাগ করার কালচারে আমি বড়ো হইনি। এইসব ব্যাপারে আমি ছিলাম চরম গোঁড়া। আর দর্শন ভাইয়ের ভঙ্গিও অতো সুবিধার ছিলো না। সস্তা পেলে বাঙালির আলকাতরা খাওয়ার মতো তিনি আমার প্রেমকে অতি সস্তা মনে করেছিলেন।
আসলে কারো কাছেই সহজলভ্য হতে নেই। ব্যক্তিত্বের সংকট তৈরি হয়। এই জিনিস আমি এখন বুঝি। সদা হাস্যোজ্জ্বল মন ও মুখ মানুষকে দেখাতে নেই। মানুষের প্রতি কোনোপ্রকার কোনো প্রেমও দেখাতে নেই। যা ঔন করা যায় তাই করা উচিত। প্রকাশ পেলে নিজের গর্ভধারিণীও ছাড় দেন না।  

আরও পড়ুন : ‘ভাগ্যলক্ষ্মীর মহড়া পর্ব’

আমার তখন দর্শন ভাইয়ের কিত্তি দেখে ঘেন্নায় বমি চলে এসেছিলো। যাকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসা যায়, তাকে একইসঙ্গে ঘৃণাও যে করা যায় তা আমি তখন টের পেলাম। দর্শন ভাইয়ের প্রস্তাব শুনে আমি কষে একটা চড় মেরেছিলাম তার গালে। চোখে ছিলো এক জোড়া নিরুপায় চশমা। চড় পান করে চশমাজোড়া কান থেকে মাটিতে মুখ লুকিয়ে ফেলে। ফ্রেম থেকে একটি গ্লাস পিচঢালা পথের পাশের মাটিতে খুলে পড়ে থাকে। মনে হলো চশমাজোড়াও দর্শন ভাইয়ার সেই অপকর্মের প্রতিবাদ জানিয়ে ঘাট হয়ে বসে রইলো, একটুও নড়লো না। বলাবাহুল্য সেই গ্লাসটি আমি আর কোনোদিন তাকে ফেরত দেইনি। এরপর আর কোনো যোগাযোগও আমি করিনি তার সাথে। তিনি আইএলটিএস দিয়ে বিদেশে পাড়ি জমান। মাঝে মাঝে আমার সেই নকিয়া-১১১০-এর সেই ৭১৫২ নাম্বারে আননোন নাম্বার থেকে কল আসতো। খুব উচ্ছ্বাস দেখা যেতো আমার চোখে মুখে। কখনো কখনো ফোন ধরতামও। আবার মাঝে মাঝে ধরতাম না। রুমমেট মুন আপু খুব বোঝাতেন আমাকে। এই ছেলে ভণ্ড ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলে, সেইসব আননোন নাম্বারের ফোন ধরে কড়া কড়া কথা বলতাম। আবার অনেকদিন তিনি ফোন দিতেন না। হুট করে আবার দিতেন। রুমমেটরা মাঝে মাঝেই আমাকে 'আননোন নাম্বার কলিং' বলে ক্ষেপাতো। যেমন গোসলে ঢুকলে যাতে দ্রুত বের হই তাই এই 'আননোন নাম্বার কলিং' বলে বাথরুম থেকে বের করতো আমাকে!

আরও পড়ুন: ‘সেঁজুতি-সম্ভব পর্ব’

ইতোমধ্যে আমার নকিয়া-১১১০ ফোনটি এক অদ্ভুত কায়দায় হলের বাস থেকে গায়েব হয়ে যায়! সঙ্গে যুক্ত হয় আরও কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত তুচ্ছ দুঃখের বিষয়।

আর এভাবেই শেষ হয় আমার সঙ্গে নকিয়া-১১১০ মডেলের মোবাইল ফোনের প্রেম-মধুর জার্নি।  

news24bd.tv/ডিডি
 

এই রকম আরও টপিক