মা এক অদ্ভূত রাঁধুনি

মা এক অদ্ভূত রাঁধুনি

Other

১.

আম্মার যদি একটা মেন্যু বুক থাকতো তার উপরে কী লেখা থাকতো? বোকার মতো প্রশ্ন হয়ে গেলো? আমার মা’র মেন্যু বুকে কি লেখা থাকবে তা তো আপনার জানার কথা নয়? কিন্তু, সত্যিই কি জানার কথা নয়। জগতের সব মা তো একই। কি বলেন? আচ্ছা আমার মায়ের মেন্যুতে লেখা থাকতো ‘খাইলে খা, না খাইলে যা। ’ আমি খেতে বসে সবচেয়ে বেশি শুনেছি এ কথা।

 
- আম্মা, আজকেও ডাল, সবজি! আমি খামু না।
- খাইলে খা, না খাইলে যা।
- পুঁইশাক! 
- খাইলে খা, না খাইলে যা।
- এইটা কি! মূলা! আমি খাই না।

- খাইলে খা, না খাইলে যা।
- এইসব। হাবিজাবি আমি খাই না! 
- খাইলে খা, না খাইলে যা।

ছোটবেলায় আমার এক নম্বর শত্রু ছিলো আম্মা। পৃথিবীতে তারচেয়ে নিষ্ঠুর মহিলা আমি দেখি নাই। আমার মতো লক্ষ্মী ছেলেও আমি পৃথিবীতে দেখি নাই। একটুকরা মুরগির মাংস, দুই টুকরা গরুর মাংস কিংবা একটা ডিম ভাজি করে দিলে যেখানে আমি সোনামুখ করে খাই সেখানে আমাকে দেয়া হতো পাট শাক ভাজি, ঢেড়শ দিয়ে চিংড়ি মাছ, করল্লা ভাজি, কাকরোল ভর্তা, পটলের তরকারি, কাচাকলা দিয়ে ইলিশ--এমনি সব ভয়াবহ খাবার! 

news24bd.tv

ইয়াক থু! কিন্তু থু বলার উপায় নেই। একবার বলছিলাম। আম্মা বললো, তোর খাওয়া লাগবো না, যা। দুইবেলা না খাইলে বুঝবি! বলাবাহুল্য একবেলা না-খেয়েই ‘ইয়াক থু’ বলার অপরাধ বুঝে গেছিলাম। মাবুদ সাক্ষী, আমি আর এই জীবনে খানাখাদ্য দেখে ‘ইয়াক থু’ বলি নাই।   

মানুষের জীবন বৈপরীত্বে ভরপুর। আমি ভাবতাম বড় হয়ে নেই একবার, তারপর আমারে আর পায় কে? নিজে বাজার করবো। মুরগি, গরু, খাসি কিনবো। প্রতিদিন মাংস ভুনা, কষানো খাবো। নিজের বেতনের টাকায় ডেইলি মাংস খাবো। কিসের কি! বড় হয়ে দেখি, আমিও মলা, কাচকি, চাপিলা মাছ কিনে ফেলি।  

বউরে বলি, ইয়ে, তুমি কলার থোড় রাঁধতে পারো? রাধা আমার আগুন চোখে তাকিয়ে বলে, আইনো। আমিও কলার থোড়, কচুর লতি, কচু শাক একদিনে বাসায় কিনে আনি। ঢেড়শ আর কচুরমুখির মতো পিছলা খাবারে আমার কেমনে এতো পিরীতি হইলো আমি তা বুঝতেই পারি না! বড়বেলাটা সত্যিই কনফিউজিং। এখন মনে হয় আম্মার হাতের রান্নাই সেরা।  

ইলিশ মাছের লেজ মাথা সহযোগে মূলা, বেগুন, আলু, পটল, ডেঙ্গা (ডাটা) দিয়ে আম্মা যে ঘাটা রাঁধেন তার তুলনা এই মহাবিশ্বে নাই। বউরে বলি, আম্মা যে ঘাটা রাঁধছে তেমনটা রাঁধতে পারো না! মনে মনে ভাবি, হায়রে আমার জীবন, কই গেল মাংস খাওয়া একরোখা ছোটবেলা।  

আম্মার রান্নাঘরটা একটা সামরিক সংগ্রহশালাও বটে। আম্মা রেগে গেলে তার খন্তা, ডাল ঘুটনি দিয়েই জায়গায় বেজায়গায় মারতেন। রান্নাঘর তার অস্ত্রের কারখানা ছিলো। আর আমি বলতাম, মাছ খায় বিলাইয়ে, মাংস খায় বাঘ, সিংহে, বুঝছো? আম্মা বুঝে না বুঝেই ভাজাকাঠি দিয়ে আমাকে আদর করে দিতেন। সেই আদরের ঠেলায় পাছা ডলতে ডলতে কোন কোণায় গিয়ে মায়ের নিষ্ঠুরতা আর জগতের সবচেয়ে ভালো রান্নার কথা ভাবতাম আর চোখের পানি ফেলতাম লুকিয়ে। পুরুষ মানুষ যে প্রকাশ্যে কাঁদতে পারে না সেই শিক্ষা ততোদিনে অবশ্য পেয়ে গিয়েছিলাম!

বড় হয়ে দেখলাম, আম্মার রান্নাঘরটাই ছিলো বৈজ্ঞানিক নিরীক্ষাগার। শুধু নীরিক্ষাগার নয়, আম্মার রান্নাঘর ছিলো রহস্য আর রোমাঞ্চে ভরপুর। সেখানে এক পাতিল পেপের ঝোলে লুকানো থাকতো কয়েক টুকরা শিং মাছ, সেখানে লাউ পাতার অন্তরে মোড়ানো থাকতো নোনা ইলিশ, সেখানে প্রচুর বুটের ডালের তলায় লুকিয়ে থাকতো গরুর মাংসের পিচ্চি পিচ্চি টুকরা। সেই টুকরার দু’চারখান পাতে পেয়ে যাওয়া কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের চেয়ে কম আনন্দের ছিলো না নিশ্চয়ই।   

এখন মনে হয়, পৃথিবীর সেরা রান্নাঘর আমার মায়ের রান্নাঘর আর পৃথিবীর সেরা রাঁধুনি আমার আম্মা। কিন্তু এ কি আমার একার মনে হয়? না, জগতের সকল মানুষই একবাক্যে বলবে, ‘আমার মায়ের হাতের রান্নাই সেরা। ’ এমনকি জগত সেরা সেফও বলবে, তার সবচেয়ে প্রিয় খাবার মায়ের হাতের যে কোন রান্না। ঋত্বিক অভিনীত সেই ‘মাছের ঝোল’ সিনেমাটার কথা খুব মনে পড়ছে। মায়ের প্রিয় মাছের ঝোল রান্না করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে এ ছবির নায়ক।  

আমরা কি কখনো চেষ্টা করেছি, মায়ের পছন্দ মতো রাঁধতে? জানি, মায়ের মতো কেউ রাঁধতে পারে না। কিন্তু মাকে নিজের মন মতো রেঁধে খাওয়ানোর ভাগ্য পাওয়াই তো সবচেয়ে বড় পাওয়া। মায়ের জন্য একটা ডিম ভাজি করতে পারাও বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার। এই সৌভাগ্য যারা পায় তারা পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী সন্তান। এই বিবেচনায় আমি একজন ধনী লোক।  

news24bd.tv

তবে ধনী, গরীব, সুখি, অসুখি সব মানুষই এক বাক্যে স্বীকার করবে, মা হলেন জগতের সবচেয়ে বড় রাঁধুনি। সত্যিই কি জগতের সব মা সেরা রাঁধুনি? কিন্তু কারণটা কি? সব মাই কি রান্নায় জগত সেরা? মনোবিজ্ঞানীরা কিন্তু অন্য কথা বলছে।  

বিজ্ঞানীরা মায়ের রান্নাকে জগত সেরা মনে করার পেছনে মন কিংবা মগজের কারসাজি বলছেন। তাদের মতে মায়ের রান্না সেরা মনে করার কারণ লুকিয়ে আছে মগজের গভীর কোষে, নিউরনে নিউরনে। মনে করে দেখুন এই রুক্ষ্ম, কঠিন পৃথিবীতে জন্মের সময় কতো অসহায় ছিলেন আপনি? সেই অসহায় শিশুটিকে কে খেতে দিয়েছিলো? মা দিয়েছিলো তার বুকের সুধা।  

নিজের শরীরের অংশকে নিজের শরীর, প্রাণ দিয়েই বাঁচিয়েছে মা। প্রথম মুখে ভাত, প্রথম খিচুড়ি, প্রথম স্কুলের টিফিন, বিকালের নাস্তা, সকাল, দুপুর, রাতের খাবার-- সবই মায়ের হাত থেকেই পেয়েছি আমরা। অসুখ হলে মায়ের হাতে স্যুপ, জাও, উৎসবে মায়ের রান্না করা পোলাও কোরমা, নানার মৃত্যু বার্ষিকীতে নানার প্রিয় পাতলা খিচুড়ি, জন্মদিনে চুলায় বানানো কেক-- মোদ্দা কথায় রোগে, শোকে, সুখে আম্মার রান্নাই প্রথম ভরসা। আমাদের সবার স্মৃতি জুড়ে তাই মায়ের রান্নার ঘ্রাণ। মায়ের হাতের রান্না আর মায়ের রান্নাঘরই আমাদের বাঁচিয়েছে।  

মা এক অদ্ভূত রাঁধুনি। তার রান্নার কোন রেসিপি নেই। কোন বই পড়ে, টিভি দেখে, ইউটিউব দেখে মা রান্না শেখেনি। তার কোন মেজারমেন্ট টুল নেই। মা যা রেঁধেছে, রান্নায় যা কিছু উপাদান দিয়েছে সবই পরিমাণ মতো অথবা আন্দাজ মতো। শুধু আন্দাজ মতোই না মায়ের রান্নার আরেকটা কৌশল ছিলো। সেই কৌশলটা অনেকটা যেমন খুশি তেমন সাজোর মতো।  

আমরা যা কিছু রাঁধি একটা তালিকা করি। এটা রাঁধতে ওটা লাগবে, তারপর ছোটো বাজারে। চিনিগুড়া চাল না-হলে খিচুড়ি হবে না, পেঁয়াজ ছাড়া পোলাও হবে না, ঘি ছাড়া সেমাই হবে না-- এইসবের তোয়াক্কা করেনি আম্মা। কি রাঁধতে কি কি লাগবে তার ধার ধারেনি আম্মা। যা আছে তা দিয়েই রাঁধে আম্মারা।  


ঈদের রাতের ফজিলত

মমতার মন্ত্রিসভায় শপথ নেবেন ৪৩ জন, নাম আছে ৬ মুসলিমের

সোনাহাট স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি ৬ দিন বন্ধ

জিহাদী বইসহ উল্লাপাড়া জামায়াতের আমির গ্রেপ্তার


আম্মারা দেখেন, কী কী আছে হাতের কাছে, সে অনুযায়ী মেন্যু সাজায়। রেসিপির গোলামি করে না আমাদের আম্মা, রেসিপি তার গোলাম হয়ে থাকে। তাই আম্মা নিজের আন্দাজে যা রাঁধেন তাই সেরা। তার রান্নার মসলা, উপাদানের পরিমাণ কিংবা আন্দাজ সদাই নির্ভুল। দুজন হোক কিংবা বিশজন মা অব্যর্থভাবেই রেঁধেছে সেরা রান্নাটি।  

প্রশ্নটা হলো, মা নিজে এই অব্যর্থ রান্নাবান্না শিখলেন কই? 
তার মা’র কাছে।  
তার মা তার মার কাছে।  
এইভাবে মা থেকে মা বাঙলার রান্না ঘুরেফিরে আসে প্রতিটি রান্না ঘরে।  
বাঙালির সবচেয়ে বড় ঐতিহ্য হলো মায়ের রান্নাঘর।

২.

আম্মা মানেই ডাইল ঘুটনি, 
পাঙ্খা আর ঝাড়ুর বাড়ি...
: আম্মা আর মাইরো না...
: না মারলে তুই সিধা হবি না...
: উফ্, এ্যাম্মা... মা, মা, মা... 
: থাপ্পড় খাবি, ম্যা ম্যা করিস না, কাজ করতে দে।
(একটু পরে)
: খাইছস? তাড়াতাড়ি খা। নাইলে আরেকটা দিমু।  
জানি, আরেকটা মাংস কিংবা ডিম না, ঝাড়ুর বাগি দিবো। তাই তাড়াতাড়ি পেঁপের ঝোল খায়া উঠি।

news24bd.tv নাজিম