করোনাকালে এক উপজেলায় ৬০০ বাল্যবিয়ে

করোনাকালে এক উপজেলায় ৬০০ বাল্যবিয়ে

Other

বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়নের সুন্দরবন সন্নিহিত দক্ষিণ খুড়িয়াখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী সুমি আক্তার (১২)। শরণখোলা গ্রামের নবী হোসেন হাওলাদারের মেয়ে। সে লেখাপড়ায় একেবারেও খারাপ না। ৩৫ জন ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে ক্লাসে তার রোল চার।

কিন্তু তাকে আর লেখাপড়া করতে দিল না করোনা। বাল্যবিয়ে

হয়ে গেছে সুমি আক্তারের। অপ্রাপ্তবয়স্ক এই কিশোরী এখন অন্যের ঘরের বধূ।

অভিশপ্ত করোনা শিক্ষাজীবনের পাশাপাশি কেড়ে নিয়েছে তাদের ভবিষ্যতের সব স্বপ্ন-স্বাধ।

করোনাকালে শরণখোলায় সুমির একারই শুধু বিয়ে হয়নি। তার মতো কিশোরীবধূ হয়েছেন পঞ্চম থেকে এসএসসি পর্যন্ত প্রায় ছয় শত শিক্ষার্থী।

শুধু শরণখোলা উপজেলাতেই নয়, করোনাকালে বাগেরহাটের অন্য ৮টি উপজেলার প্রাথমিক, নিন্ম মাধ্যামিক, মাধ্যমিক ও মাদ্রাসার শত-শত অপ্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের স্বীকার হয়েছে। গ্রামাঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই যে এমন হয়েছে, তা নয়। উপজেলা সদর ও আশপাশের ঐতিহ্যবাহী স্কুল-মাদরাসাগুলোতেও অকালে বিয়ে হয়ে গেছে বহু শিক্ষার্থীর। এর মধ্যে মাদরাসার চেয়ে স্কুলে বিয়ের হার বেশি। অভিভাবকদের অসচেতনতা, আর্থিক দৈন্যতা, নিরাপত্তার অভাব এবং শিক্ষাজীবনের অনিশ্চয়তাই শিক্ষার্থীদের অকালে বিয়ের হওয়ার কারণ। বাল্যবিয়ের পাশাপাশি ঝরে পড়ার সংখ্যাও হতাশাজনক। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পর উঠে এসেছে এমন ভয়াবহ চিত্র।

বাল্যবিয়ে স্বীকার সুমি আক্তারের বাবা নবী হোসেন সুন্দরবনে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। ভিটেমাটি বলতে আছে মাত্র এক শতক চরের জমি। ছোট্ট একটি ঘর তুলে তাতেই বসবাস।

সংসারে সদস্য সংখ্যা ছয়জন। স্বামী, স্ত্রী, তিন মেয়ে আর এক ছেলে। তিন মেয়ের মধ্যে সুমি সবার বড়। বাবা মাছ ধরে যা আয় করেন তা দিয়ে সংসার চলে টানাটানি করে। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে অর্থনেতিকভাবে পিছিয়ে পড়া দরিদ্র নবী হোসেনের তিন মেয়ে তার মাথার বোঝা হয়ে দেখা দেয়। একই সাথে যোগ হয় মহামারী করোনা। স্কুলবন্ধ।

মা-বাবা পড়ে যান এক ঘোর অনিশ্চয়তায়। তাই অভাবের সংসারে চাপ কমাতে এক মাস আগে অকালে বিয়ে দিয়ে দেন তাদের বড় মেয়েটিকে।

দক্ষিণ খুড়িয়াখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মমতাজ খানম জানান, স্কুল খোলার পর পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী সুমি আর ক্লাসে আসেনি। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন তার বিয়ে হয়ে গেছে। তিনি আফসোস করে বলেন, মেয়েটি ভালো ছাত্রী ছিল। ওর বাবা খুব গরীব। তাই এতো অল্প বয়সে মা-বাবা তাকে বিয়ে দিয়েছে। করোনার কারণেই অকালে ঝরে গেল মেয়েটি। স্কুল খোলা থাকলে আর এমনটি হতো না।

সহপাঠী রাবেয়া আক্তার, জান্নাতী আক্তার ও সুমন গাজী জানায়, স্কুল খোলার পর সুমিকে না দেখে তারা খোঁজ নিয়ে জানতে পারে ওর বিয়ে হয়ে গেছে। সুমির বিয়ে হওয়াতে ওদের খুব মন খারাপ। ওরাও বলে, এতো অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে সুমির মা-বাবা ঠিক করেনি।

সুমিদের বাড়িতে গিয়ে পাওয়া যায়নি বাবা নবী হোসেনকে। তিনি গেছেন মাছ ধরতে সুন্দরবনে। সুমি শ্বশুর বাড়ি থেকে কয়েকদিন আগে এসেছে বাবার বাড়িতে। সুমির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিয়েতে তার মত ছিল না। ইচ্ছার বিরুদ্ধেই মা-বাবা তাকে বিয়ে
দিয়েছেন। তারপরও সমাপনী পরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছা আছে বলে জানায় সুমি।

মেয়েকে এতো কম বয়সে বিয়ে দিয়ে ঠিক করেছেন কিনা জানতে চাইলে সুমির মা মুকুল বেগম বলেন, সংসারে সদস্য ছয়জন। ওর বাপে জঙ্গলে (সুন্দরবনে) মাছ ধইরা কয় টাহা আর পায়?

তা দিয়া সংসার চলে না। তার উপর তিনডা মাইয়া বিয়া দিমু ক্যামনে? মাইয়াও বড় ওইতে আছে। স্কুল বন্ধ থাকায় মাইয়াগো লেহাপড়া বন্ধ। তাই ভালো পোলা (ছেলে) পাইয়া বিয়া দিয়া দিছি। জামাই পোষাক কারখানায় চাকরি করে।

শরণখোলার রায়েন্দা সরকারি পাইলট হাই স্কুলে গিয়ে জানা যায়, করোনার বন্ধে নবম, দশম এবং এসএসসি পরীক্ষার্থী মিলিয়ে ৫০ জনের মতো বিয়ে হয়েছে এই প্রতিষ্ঠান থেকে।

এসএসসিতে ৬৮ জন মেয়ে পরীক্ষার্থী। এর মধ্যে ২০ জনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। চালিতাবুনিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম, দশম ও এসএসসি পরীক্ষার্থীর বিয়ে হয়েছে ২৫ জন ছাত্রীর। এদের মধ্যে কিছু কিছু এখনো বিদ্যালয়ে আসছে। বাল্য বিয়ের শিকার নবম শ্রেণির ফাতিমা আক্তার জানায়, স্কুল বন্ধ থাকায় ঢাকায় খালার বাসায় বেড়াতে যায় সে। তখন পরিবারের পছন্দে প্রতিবেশী এক সৌদী প্রবাসীর সঙ্গে বিয়ে দেয় তাকে। তবে, বিয়ে হলেও লেখাপড়া চালিয়ে যেতে চায় সে। এসএসপি পরীক্ষার্থী রিমা আক্তার জানায়, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই বিয়ে দেওয়া হয়েছে। জনতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১৬ জন, খোন্তাকাটা ইউনিয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১৭ জন, খোন্তাকাটা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১৪ জন, বিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১২ জন, সাউথখালী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে ২৩ জন, আমেনা স্মৃতি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১২০জন ছাত্রীর মধ্যে ১৫ জন, তাফালবাড়ী কলেজিয়েট স্কুলে সপ্তম শ্রেণি থেকে এসএসসি পর্যন্ত ১৫ জন, রাজাপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১৫জন, উপজেলা সদরের ‘আরকেডিএস’ বালিকা বিদ্যালয়ে ১১ জন।

এভাবে শরণখোলা উপজেলার ২০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গড়ে ২০ জন করে কমপক্ষে ৪০০ ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে বলে জানা গেছে। আর সুন্দরবন দাখিল মাদরাসায় নবম, দশম ও দাখিল পরীক্ষার্থী মিলিয়ে বিয়ে হয়েছে ১৩ জনের। রায়েন্দা-রাজৈর ফাজিল মাদরাসায় অষ্টম থেকে দাখিল পরীক্ষার্থীদের মধ্যে বিয়ে হয়েছে ১০ জনের, দারুল হেদায়েত নেছারুল উলুম ফাজিল মাদরাসায় ১২ জন, রায়েন্দা মহিলা দাখিল মাদরাসায় নবম. দশম ও দাখিল পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ১৮ জন, রায়েন্দা বাজার ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসায় ৬ জন, সোনাতলা ইসলামিয়া আলিম মাদরাসায় ২০ জন। এমনিভাবে শরণখোলা উপজেলার ১৬টি মাদরাসায় গড়ে ১৫ করে প্রায় ২৪০জন ছাত্রী করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বাল্যবিয়ের স্বীকার হয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের কাছ থেকে পাওয়া গেগে এসব তথ্য।

প্রতিষ্ঠান প্রধানরা জানান, করোনাকালে বাল্য বিয়ের পাশাপাশি ছাত্র-ছাত্রীদের অনুপস্থিতির সংখ্যাও কম নয়। গড় হিসাবে ৪০ভাগ আর কোনো দিনই বিদ্যালয়মুখি হবে না বলে তারা হতাশা প্রকাশ করেন।

শরণখোলা উপজেলা মাদরাসা শিক্ষক সমিতির সভাপতি মাওলানা আব্দুল জলিল আনোয়ারী বলেন, দীর্ঘদিন প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা, পারিবারিক অসচ্ছ্বলতা এবং অভিভাবকদের অসচেতনায় বাল্যবিয়ের সংখ্যা বেড়েছে। স্কুল-মাদরাসা খোলা থাকলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের সংস্পর্শে থাকতো, খোঁজখবর নেওয়া যেত। তখর আর এই পরিস্থিতি হতো না।

রায়েন্দা সরকারি পাইলট হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. সুলতান আহমেদ গাজী বলেন, স্কুলবন্ধ থাকায় ছেলে-মেয়েদের খোঁজ নেওয়া সম্ভব হয়নি। দীর্ঘদিন স্কুলবন্ধ থাকায় অভিভাবকরাও অনিশ্চয়তায় পড়ে যায়। তাছাড়া, সুন্দরবন ঘেঁষা এই এলাকার বেশিরভাগ পরিবারই নিম্নআয়ের।

আরও পড়ুন: 


বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ নির্মাণে সময় বাঁচবে ৩ ঘণ্টা

দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দুঃসময় যাচ্ছে: ফখরুল

প্রকাশ হলো এসএসসি ও এইচএসসির পরীক্ষার রুটিন

নিজের মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দিলেন বাইকার


তাই অনেকে পরিবারের বোঝা মনে করে মেয়েকে অপ্রাপ্ত বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেয়। পরিবার ইচ্ছে করেই তার মেয়েকে অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে এতো পরিমাণ বিয়ে হতো না।

শরণখোলা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নূরুজ্জামান খান বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পর প্রাথমিকভাবে খোঁজ নিয়ে অসংখ্য বাল্য বিয়ের খবর জানতে পেরেছি। বাল্যবিয়ের সঠিক তথ্য দেওয়ার জন্য প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে চিঠি দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে যাতে আর এমন অপ্রাপ্ত বিয়ের ঘটনা না ঘটে সে ব্যাপারে শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের নিয়ে সচেতনতামূলক সভা করা হবে।

শরণখোলা সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক ও সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান এইচ এম আব্দুল হালিম বলেন, করোনার দুর্যোগে শিক্ষা ব্যবস্থার চরম ক্ষতি হয়ে গেছে। বাল্য বিয়ের প্রবনতা বৃদ্ধি পেয়েছে আশঙ্কাজনক হাবে। এটাকা একটা সামাজিক অবক্ষয়। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ার ফলে মেয়েরা শারীরিক ও মানসিকভাবে স্থায়ী ক্ষতির মুখে পড়বে। পাবিারিক কলহ বৃদ্ধি পাবে। সমাজে এর ক্ষতিকর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হবে। এব্যাপারে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে।

শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খাতুনে জান্নাত বলেন, বাল্য বিয়ে সমাজের জন্য একটা অসনি সংকেত। এটা আমাদের সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। ক্ষতি যা হবার হয়ে গেছে। সামনে যাতে আর এধরণের অনাকঙ্খিত বিয়ে না হয়, সেব্যাপারে জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, অভিভাবক, ইমাম, পুরোহিত, কাজী ও গ্রাম পুলিশদের সমন্বয়ে এলাকাভিত্তি সভা করা হচ্ছে।

news24bd.tv তৌহিদ

সম্পর্কিত খবর