হৃদরোগ নিয়ে অনেকের মনে নানা প্রশ্ন। কিন্তু সব প্রশ্নের বিজ্ঞানসম্মত সঠিক উত্তর মেলে না। বিশ্ব হার্ট দিবস উপলক্ষ্যে হৃদরোগ বিষয়ক কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন দেশের বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী। সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন আতাউর রহমান কাবুল

প্রশ্ন : হৃদরোগ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নয় এমন মানুষেরা কিভাবে হৃদযন্ত্রের যত্ন নিতে পারে?
অধ্যাপক ওয়াদুদ চৌধুরী : হৃদরোগের আসল কারণ হলো—উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ধূমপান, রক্তে কোলেস্টেরল লেভেল বেশি থাকা, স্থূলতা, বংশগত ইত্যাদি।

প্রশ্ন : সুস্থ মানুষ প্রায়শই হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

প্রশ্ন : কেউ উত্তরাধিকারসূত্রে কি হৃদরোগে আক্রান্ত হতে পারে?
অধ্যাপক ওয়াদুদ চৌধুরী : বংশগত কারণে কারো হৃদরোগ হতে পারে। তবে একক জেনেটিক কারণে হৃদরোগ সহজে হয় না। হৃদরোগের সঙ্গে অনেকগুলো ফ্যাক্টর জড়িত। সব কিছুর সঙ্গে পরিবেশের সম্পর্কও রয়েছে।

প্রশ্ন : জগিং না হাঁটা—কোন ব্যায়ামটি ভালো?
অধ্যাপক ওয়াদুদ চৌধুরী : দুটিই ভালো। তবে প্রত্যেকের শারীরিক বা কায়িক পরিশ্রম করা উচিত, যাতে শরীর থেকে অন্তত ঘাম বের হয়। মডারেট এক্সারসাইজ সব সময় ভালো, হেভি এক্সারসাইজ কখনোই ভালো না। সব কিছুর মাত্রা রেখে করা উচিত। দিনে ৩০-৪০ মিনিট করে সপ্তাহে পাঁচ দিন ব্যায়াম করা ভালো। সাইকেল চালনা, সাঁতার কাটা ভালো ব্যায়াম।

প্রশ্ন : নিম্ন রক্তচাপে যাঁরা ভোগেন, তাঁরা কি হৃদরোগে আক্রান্ত হতে পারেন?
অধ্যাপক ওয়াদুদ চৌধুরী : নিম্ন রক্তচাপে ভোগা মানুষদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা তুলনামূলকভাবে কম। তবে মূল বিষয় হলো, তার ডায়াবেটিস আছে কি না, তিনি ধূমপান করেন কি না বা কোলেস্টেরল লেভেল বেশি কি না—এসব বিষয় আগে দেখা উচিত।

প্রশ্ন : রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কি অল্প বয়স থেকেই বাড়তে থাকে? কখন এ বিষয়ে সতর্ক হওয়া উচিত?
অধ্যাপক ওয়াদুদ চৌধুরী : সাধারণত ৩০ বছর বয়সের পর থেকেই মানুষের দেহে কোলেস্টেরলের মাত্রা পরিবর্তন হতে শুরু করে। আমরা তাই ৪০ বছরের পর নিয়মিত ‘লিপিড প্রোফাইল’ চেক করার পরামর্শ দিই। আর যাদের বংশগত হৃদেরাগ রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে ৩৫ বছর পার হলেই বছরে একবার লিপিড প্রোফাইল করা উচিত।  

প্রশ্ন : অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস কিভাবে হৃদ্যন্ত্রের ওপর প্রভাব ফেলে?
অধ্যাপক ওয়াদুদ চৌধুরী : অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাসে ভাজাপোড়া, জাংক ফুড বেশি খাওয়া হয়ে যায়। এতে হেলথ এনভায়রনমেন্টটা আসলে নষ্ট হয়। তাই হৃদরোগ থেকে বাঁচতেই শুধু নয়, বরং শারীরিক সুস্থতায় নিয়মিত খাদ্যাভ্যাস জরুরি।

প্রশ্ন : ওষুধ ছাড়া কি কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করা যায়?
অধ্যাপক ওয়াদুদ চৌধুরী : অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ও ব্যায়াম—শুধু এ দুটি মাধ্যম দিয়ে সাকসেসফুললি কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করেছেন অনেকে। মনে রাখা দরকার, খাদ্যতালিকায় কার্বোহাইড্রেট ও ফ্যাটজাতীয় খাবার কমাতে হবে; কিন্তু প্রোটিন ঠিক রাখতে হবে।

প্রশ্ন : হৃদযন্ত্রের জন্য সবচেয়ে ভালো ও সবচেয়ে খারাপ খাবার কোনটি?
অধ্যাপক ওয়াদুদ চৌধুরী : মেডিসিনে একটি কথা আছে, ‘প্রতিটি ওষুধই ক্ষতিকর হতে পারে, যদি সেটি অনুপযুক্ত মাত্রায় ব্যবহার করা হয়। ’ খাদ্যের দোষ নেই, পরিমাণটা উপযুক্ত কি না তা-ই বিবেচ্য বিষয়। সপ্তাহে একটি বার্গার খেতেই পারি, তাই বলে প্রতিদিন তো খাওয়া ঠিক হবে না।

প্রশ্ন : রান্নার জন্য কোন তেল ভালো?
অধ্যাপক ওয়াদুদ চৌধুরী : খাঁটি সরিষা ও সানফ্লাওয়ার তেল রান্নার জন্য ভালো। অলিভ অয়েলকে বেস্ট অয়েল বলা হলেও আমাদের দেশের খাঁটি সরিষার তেল কিন্তু বেশ ভালো। রান্নার জন্য রাইস ব্রান অয়েলও ভালো। তবে এটা নিয়ে তেমন গবেষণা নেই। আবার পাম অয়েল মেশানো সয়াবিন তেল খাওয়া ঠিক নয়।

প্রশ্ন : নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য কি নির্দিষ্ট কোনো পরীক্ষা আছে?
অধ্যাপক ওয়াদুদ চৌধুরী : খালি পেটে ব্লাড সুগার, লিপিড প্রোফাইল, উচ্চ রক্তচাপ পরীক্ষা করে একটা ইসিজি করে নিলেই হয়। বয়স ৩০ পেরোনোর পর দুই বছরে একবার হলেও প্রত্যেকের উচিত এ পরীক্ষাগুলো করা।

প্রশ্ন : হার্ট অ্যাটাক হলে কেউ কি নিজে নিজে প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে পারে? এসময় করণীয় কি?
ডা. ওয়াদুদ : সাধারণত চার ভাগের এক ভাগ মানুষ কোনো ধরনের পূর্বাপর ব্যথার উপসর্গ ছাড়াই হৃদরোগে বা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়। এই চিত্রটা সারা পৃথিবীতে একই রকম। সব রোগীর টিপিক্যাল বুকে ব্যথা হয় না। তবে কেউ যদি বুঝতে পারেন যে তাঁর হার্ট অ্যাটাক হতে যাচ্ছে, তখন বিলম্ব না করে ফার্মেসি থেকে অ্যাসপিরিন ৩০০ মি.গ্রা. ট্যাবলেট কিনে সরাসরি চিবিয়ে খেয়ে ফেলবেন। এই অ্যাসপিরিন হার্ট অ্যাটাকে ৩০ শতাংশ মৃত্যু কমাতে পারে। অন্যান্য অসুখ থাকলেও এটা সেবনে কোনো ক্ষতি নেই। এছাড়াও নাইট্রেট স্প্রে বা ট্যাবলেট জিহ্বার নিচে দিতে পারেন। এরপর গ্যাস্ট্রিকের ট্যাবলেট খেয়ে একটা ইসিজি করে হার্ট অ্যাটাকের মার্কার হিসেবে রক্তের ট্রপোনিনও দেখা উচিত।

প্রশ্ন : হৃদরোগজনিত ব্যথা ও গ্যাস্ট্রিকের ব্যথার মধ্যে পার্থক্য করা যায় কিভাবে?
অধ্যাপক ওয়াদুদ চৌধুরী : বিশেষজ্ঞ ছাড়া এটা আসলে অন্য কারো পক্ষে বোঝা মুশকিল। এটা বুঝতে হলে হার্টের ইসিজি করে দেখতে হবে। তবে ইসিজি নরমাল মানেই যে হার্ট অ্যাটাক হয়নি—এমনটি মনে করা যাবে না। এতে অনেকেই ভুল করেন। অথচ ২৫ ভাগ ক্ষেত্রে প্রাথমিক ইসিজিতে হার্ট অ্যাটাকের প্রমান মেলে না। এ জন্য প্রয়োজনে কিছুক্ষন হাসপাতালে অবজারভেশনে থেকে আবার ইসিজি করাতে হবে।

প্রশ্ন : যুবকদের মধ্যে হৃদরোগের সমস্যা বাড়ছে, এর কারণ কী?
অধ্যাপক ওয়াদুদ চৌধুরী : যুবকদের মধ্যে একটা গ্রুপ আছে, যারা নেশায় আসক্ত, তারা হৃদেরাগে আক্রান্ত হচ্ছে। সেটা সিগারেট হোক আর হেরোইন, ইয়াবা যাই হোক না কেন।  আবার অনেকে হোন্ডা নিয়ে সারা দিন খালি ছুটে বেড়ায়। তারা এত ব্যস্ত যে নিজের শরীরের দিকে তাকানোর পর্যন্ত সময় নেই! এরাও হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে সতর্কতার অভাবে।

প্রশ্ন : রক্তচাপের স্বাভাবিক মাত্রা (১২০/৮০) না থাকলেও কি কেউ পুরোপুরি সুস্থ থাকতে পারে?
অধ্যাপক ওয়াদুদ চৌধুরী : রক্তচাপের স্বাভাবিক মার্কার হলো ১২০/৮০ মিমি মার্কারি। তবে রক্তচাপ ওপরেরটা ১০০ থেকে ১৩৯ পর্যন্ত থাকলেও নরমাল। আবার নিচেরটা ৬০ থেকে ৯০-এর নিচে থাকলে নরমাল। অর্থাৎ কারো রক্তচাপ যদি ১১০/৬০ বা ১৩৫/৮৫ থাকে, তবে সে স্বাভাবিক রক্তচাপে অবস্থান করছে ধরতে হবে।

প্রশ্ন : নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে করলে সন্তানের হৃদরোগ হতে পারে—এটা কি সত্য?
অধ্যাপক ওয়াদুদ চৌধুরী : এ ক্ষেত্রে জন্মগত হার্ট ডিজিজ হতে পারে। তবে হবেই যে এমন কোনো কথা নেই।

প্রশ্ন : বেশির ভাগ মানুষ অনিয়ন্ত্রিত রুটিন অনুসরণ করে। অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করেন কেউ কেউ। এতে কি হৃদযন্ত্রের ক্ষতি হয়? এ ক্ষেত্রে করণীয় কী?
অধ্যাপক ওয়াদুদ চৌধুরী : যাঁরা রাত জেগে কাজ করেন, তাঁদের স্ট্রেস লেভেল একটু বেশি। তাঁরা টেনশন করেন বেশি, মেজাজও খিটমিটে ধরনের হয়। অনেকে উচ্চ রক্তচাপেও ভোগে এবং ধূমপানও বেশি করেন। এদের মধ্যে যাঁদের উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রয়েছে এবং রক্তে কোলেস্টেরল লেভেল বেশি, তাঁদের একটু সতর্ক থাকতে হবে।

প্রশ্ন : অ্যান্টি-হাইপারটেনসিভ ওষুধ গ্রহণ করলে অন্য কোনো জটিলতা তৈরি হয়?
অধ্যাপক ওয়াদুদ চৌধুরী : প্রতিটি ওষুধেরই রি-অ্যাকশন আছে, সাইড ইফেক্ট আছে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শে মাত্রা জেনে সতর্কতার সঙ্গে যেকোনো ওষুধ সেবন করা উচিত।

প্রশ্ন : নিয়মিত হার্টের ওষুধ খেলে কি কিডনি রোগ বা অন্য সমস্যা হয়?
অধ্যাপক ওয়াদুদ চৌধুরী : এটা একেবারেই ভুল ধারণা।

প্রশ্ন : অতিরিক্ত চা বা কফি পান করলে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে?
অধ্যাপক ওয়াদুদ চৌধুরী : অতিরিক্ত যেকোনো কিছুই ক্ষতিকর। সারা দিন তিন-চার কাপ চা বা কফি পান করা যেতে পারে—এতে হার্টের তেমন সমস্যা হবার কথা নয়।

প্রশ্ন : অ্যাজমা রোগীদের কি হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি?
অধ্যাপক ওয়াদুদ চৌধুরী : এটা নির্ভর করে রোগীর ডায়াবেটিস, রক্তচাপ, কোলেস্টেরল লেভেল বেশি কি না তার ওপর। তবে যাঁরা আনকন্ট্রোল্ড অ্যাজমার রোগী অথবা যাঁরা নিয়মিত শ্বাসকষ্টে ভুগে থাকেন, তাঁদের শ্বাষরোগজনিত হৃদরোগ বা কর-পালমোনালে হতে পারে।

প্রশ্ন : রক্তে শ্বেতকণিকা ও হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে গেলে কি হৃদরোগ হতে পারে?
অধ্যাপক ওয়াদুদ চৌধুরী : রক্তের সঙ্গে হৃদরোগের সরাসরি সম্পর্ক নেই। তবে কেউ রক্তশূন্য থাকলে হার্টের অক্সিজেন সাপ্লাই কমে যায়। কাজেই তখন তাদের অ্যানজাইনা বা হার্টের ব্যথা হতে পারে।

প্রশ্ন : ব্যস্ত জীবনযাত্রার কারণে অনেকের পক্ষে স্বাভাবিক ব্যায়াম করা সম্ভব হয় না। সে ক্ষেত্রে ঘরের স্বাভাবিক কাজের সময় হাঁটাহাঁটি করা অথবা সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা করা কি ব্যায়ামের বিকল্প হতে পারে?
অধ্যাপক ওয়াদুদ চৌধুরী : কায়িক পরিশ্রম করা হার্টের জন্য ভালো। আমি যখন দ্রুত পায়ে হাঁটব, তখন ফুসফুসে রক্ত চলাচল বাড়বে, হার্ট অক্সিজেন পাবে। এ অক্সিজেনই হার্টের খাবার। আর ঘরে বসে যখন হাঁটাহাঁটি করব বা সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা করব, তখন সেভাবে তা হয় না। শরীর থেকে ঘাম বের করতে না পারলে তেমন লাভ হয় না।

প্রশ্ন : নারীদের চেয়ে পুরুষরা হৃদরোগে বেশি আক্রান্ত হয় কেন?
অধ্যাপক ওয়াদুদ চৌধুরী : সব সময় এটাই হয়ে আসছে। ঋতু বা মাসিক চলাকালে নারীরা হরমোনাল প্রটেকশনের মধ্যে থাকেন, ফলে তাঁদের হৃদরোগ কম হয়। নারীদের মাসিক বন্ধ হওয়ার পর এই প্রটেকশনটা চলে যায়, তখন রোগের ঝুঁকিটা পুরুষদের মতোই হয়ে যায়। তাই প্রায় ৫০ বছর পর্যন্ত নারীরা হৃদরোগে তেমন আক্রান্ত হন না।

(আগামীকাল প্রকাশ করা হবে ‌‘নিম্ন রক্তচাপ যখন সমস্যা’ শীর্ষক বিশেষ নিবন্ধ। পড়তে ভিজিট করুন : https://www.news24bd.tv/category/health)