সবুজ কারখানায় শ্রমিকের ধূসর জীবন!

বাবু কামরুজ্জামান

দেশের তৈরি পোশাক খাতে সবুজ বিপ্লব ঘটলেও সবুজ কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের কল্যাণ ও জীবনমান উন্নয়নে বাড়তি কোনো সুফল নিশ্চিত করা যায়নি। শ্রমিক প্রতিনিধিরা বলছেন, একের পর এক সবুজ কারখানা গড়ে উঠলেও শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিতই থাকছেন। এমনকি, পরিবেশ, জলবায়ু ও কার্বন নিঃসরণ ইস্যুতে টেকসই রূপান্তরের ভাবনা থেকেও দূরে শ্রমিকদের বড় অংশ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাস্ট ট্রানজিশন বা পরিবেশবান্ধব টেকসই রূপান্তরের দীর্ঘমেয়াদি সুফল পৌঁছে দিতে হলে শুধু পরিবেশের উন্নয়ন নয়; এই সংস্কারের পথে সবচেয়ে বড় অংশীজন করতে হবে শ্রমিকদের।

রানা প্লাজা ধস পরবর্তী এক দশকে সবুজায়নের নীরব বিপ্লব ঘটেছে দেশের তৈরি পোশাক খাতে। হাজার কোটি ডলারের বিনিয়োগ আর উদ্যোক্তাদের চিন্তার অভিনবত্বে বৈশ্বিক স্বীকৃতিও জুটেছে অসংখ্য। তাইতো প্লাটিনাম, গোল্ড, সিলভারের মতো কোনো না কোনো মর্যাদায় লিড সনদপ্রাপ্ত ১৯৮টি সবুজ কারখানায় উৎপাদিত হচ্ছে বিশ্বমানের পণ্য। পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র হিসাবে বিশ্বের শীর্ষ ১০০টি সেরা সবুজ কারখানার মধ্যে ৫৪টির দাবিদার বাংলাদেশ।

নির্মাণাধীন আরও ৫ শতাধিক।

শ্রমিকের জীবন কতটা সবুজ?

তবে নির্মল পরিবেশ আর ঝকঝকে সবুজ কারখানায় উদ্যোক্তারা নজর দিলেও মজুরি কিংবা শ্রমিকদের কল্যাণে এখন পর্যন্ত বাড়তি কোনো সুফল নিশ্চিত করা যায়নি এসব কারখানায়। তাইতো সবুজ কারখানায় চাকরি করলেও  নিজের ও পরিবারের ভবিষ্যৎ দেখতে পান না অনেক শ্রমিক।

মাদারীপুরের শিবচর থেকে  ঢাকায় আসেন কলি আক্তার। ২০১২ সাল থেকে পোশাক শিল্পে কাজ করছেন এই শ্রমিক।  বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, একদিকে ঘরভাড়া বেশি, অন্যদিকে বাচ্চাদের পড়াশোনার খরচও বেড়েছে।   বর্তমানে যে বেতন পাই তাতে সংসার চালাতে কষ্ট হয় অনেক।

কলি আক্তারের মতোই আরেক শ্রমিক মিলি। সবুজ কারখানায় কাজ করেন কোয়ালিটি ইন্সপেক্টর হিসেবে।  বলেন, গার্মেন্টসে তো আর সারাজীবন চাকরি করা যায় না। হয়তো ৫ বছর বা ১০ বছর চাকরি করবো যদি বেতনাদি বাড়ে। তা না হলে গ্রামে গিয়ে সংসার করবো, অথবা অন্য কিছু করার চেষ্টা করবো। কথা হয় পরিবেশ বান্ধব সবুজ কারখানার আরও একাধিক শ্রমিকের সাথে। অভিযোগ করেন, বর্তমানে নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে সে হারে আয়  বাড়েনি। কোনো রকম খেয়ে পরে বেঁচে থাকলেও সঞ্চয় বলতে কিছু নেই তাদের।  নিজেদের বাস্তব অবস্থা তুলে ধরে তারা বলেন, বর্তমানে যে মজুরি পাচ্ছি, ছেলে মেয়ে নিয়ে খাওয়া ও চলতে কষ্ট হয় খুব। বাচ্চার দুধ কিনতেও কষ্ট হয়।

কী বলছেন শ্রমিক প্রতিনিধিরা?

প্রশ্ন হলো টেকসই উত্তরণের চলমান যে সংস্কার কার্যক্রম আদৌ তা জলবায়ু, পরিবেশ আর উন্নয়নের সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ? বিজিএমইএ’র হিসাবে প্রায় ৪০ লাখ পোশাক শ্রমিকের মাত্র সাড়ে ৩ লাখ সবুজ কারখানায় কাজ করলেও ৯১ শতাংশের কর্মক্ষেত্র এখনো পুরনো কারখানায়। যেখানে, উপেক্ষিত জরুরি স্বাস্থ্যসেবা, খাবার, পানীয় এমনকি পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা। শ্রমিক প্রতিনিধিদের অভিযোগ, উদ্যোক্তারা সবুজ কারখানায় মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ করলেও, তা বাড়তি কোনো ভূমিকা রাখেনি শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে। এমনকি শ্রমিকরা বঞ্চিত হচ্ছেন তাদের অধিকার থেকেও।

এ বিষয়ে আওয়াজ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ও শ্রমিক নেত্রী নাজমা আক্তার বলেন, বাংলাদেশে যেসব কারখানাকে সবুজ কারখানা বলা হচ্ছে, সেখানে কি শ্রমিকরা ন্যূনতম মজুরির চেয়ে বেশি মজুরি বা অন্য কোনো সুবিধা পাচ্ছে? ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার, যৌথ দরকষাকষি বা নারীর প্রতি সহিংসতা কমিয়ে আনার মতো বিষয়গুলোর কি পরিবর্তন হয়েছে? গুরুত্বপূর্ণ এসব বিষয় আমলে নিচ্ছেন না মালিকরা।

বিষয়টি নিয়ে নিউজ টোয়েন্টিফোর এর সাথে কথা বলেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) এর নির্বাহী পরিচালক নজরুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, উন্নয়নের কথা  অনেক বলি আমরা। কিন্তু সবাই এর সুফল ভোগ করতে পারে  কি? যদি সবাই সে সুফল না পায়, তবে সেটা জাস্ট (ন্যায্য) হচ্ছে না। গ্রিন ফ্যাক্টরি হচ্ছে, কিন্তু সে ট্রানজিশন জাস্ট হচ্ছে না। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তারা কী পরিমাণ ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে? একজন শ্রমিক মারা গেলেও বাংলাদেশের শ্রম আইনে মাত্র ২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পায়। এসব নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এই শ্রমিক নেতা।

বিজিএমইএ’র অভিযোগের তীর বৈশ্বিক ক্রেতাদের দিকে

তবে উদ্যোক্তা ও পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ মনে করে, শ্রমঘন এই শিল্পে যে রূপান্তর এবং সবুজায়ন ঘটছে তাতে বৈশ্বিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখছে না খুব একটা। ফলে এই রূপান্তরের অংশীজন হিসেবে শ্রমিকদের বাড়তি কোনো সুফলও দেওয়া যায়নি এখন পর্যন্ত।

বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, বেতনের ব্যাপারে এখনো সবুজ কারখানার সাথে সাধারণ কারখানার কোনো পার্থক্য আসেনি। তবে আগামীতে সেটাও আসবে আশা করি। কারণ গ্রিন ও নন গ্রিন এর জন্য বাড়তি কোনো প্রাইস আসে না বায়ার এর কাছ থেকে, যেটা আমরা বলে আসছি অনেকদিন ধরে। আশা করি সেটাও আসবে।

টেকসই রূপান্তরে জলবায়ু ও পরিবেশ বিবেচনার তাগিদ আইএলও’র

পোশাক খাত বাংলাদেশের অর্থনীতিকে জিইয়ে রাখলেও, গেলো চার দশকে পরিবেশ সুরক্ষায় হেঁটেছে অনেকটা উল্টোদিকে। একাধিক গবেষণা বলছে, অতিরিক্ত পানির ব্যবহার পোশাক কারখানাপ্রবণ এলাকাগুলোতে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামিয়েছে আশঙ্কাজনকহারে। অন্যদিকে, কার্বন নিঃসরণ, নদীদূষণ ছাড়াও সবুজ জ্বালানি ব্যবহারে এখনো পিছিয়ে পোশাক শিল্প। তাইতো ৯৫ শতাংশেরও বেশি পোশাক কারখানার নির্ভরতা প্রাকৃতিক গ্যাস বা জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর। তাই, আগামী দিনে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলা ও পরিবেশ সুরক্ষার বৈশ্বিক মানদণ্ড নিশ্চিত করতে, পোশাক শিল্পের টেকসই উত্তরণের বিকল্প নেই বলে মত আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন ও বিশেষজ্ঞদের।

আইএলও’র কান্ট্রি ডিরেক্টর তোওমো পুতিআইনেন বলেন, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে যে সবুজায়ন হচ্ছে এটা খুব ইতিবাচক। গত কয়েক বছরে এ ক্ষেত্রে বেশ উন্নতিও হয়েছে।  তবে টেকসই রূপান্তর নিশ্চিত করতে হলে আগামী দিনে জলবায়ুর অভিঘাত, কারখানার উৎপাদন পদ্ধতি, নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের মতো বিষয়গুলো কতটা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে উদ্যোক্তাদের সেদিকে বাড়তি নজর দিতে হবে। আর এটা কেবল অল্প কিছু কারখানায় নয় পুরো শিল্পেই নিশ্চিত করতে হবে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পুরো উৎপাদন ব্যবস্থা যেন একটা গ্রিন এবং ইকোফ্রেন্ডলি হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। আর মূল্যস্তরের ওপর এটার যে প্রভাব সেটা যদি নিশ্চিত করাতে পারি তাহলে সেটার ভাগ শ্রমিকদেরও দিতে পারবো। তাহলেই অন্তর্ভুক্তিমূলক জাস্ট ট্রানজিশন হবে।

পরিবেশের বাইরে, ন্যায্য শ্রমমজুরির নিশ্চয়তাও এ খাতের উত্তরণের বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, এখনো, বিশ্বে  সবচেয়ে কম টাকায় পোশাক শ্রমিকের কাজ করেন বাংলাদেশে।

তৈরি পোশাক শিল্পের এই যে উত্তরণ, কম কার্বন নিঃসরণ অর্থনীতি বা জাস্ট ট্রানজিশন- এসব বিষয়ে বেশিরভাগ শ্রমিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের স্পষ্ট ধারণা নেই। বিশ্লেষকরা তাই মনে করেন, দীর্ঘমেয়াদে শ্রমিকদের এই ট্রানজিশনের সুফল পৌঁছে দিতে হলে বৈশ্বিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান, উদ্যোক্তা ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। তবেই টেকসই হবে শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্তি।

জলবায়ুর প্রভাব নিয়ে কী বলছে ইটিআইএ’র গবেষণা

পোশাক শিল্প ও শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এথিক্যাল ট্রেডিং ইনিশিয়েটিভ-ইটিআই।  সম্প্রতি এই শিল্পের জলবায়ু সচেতনতা নিয়ে ১০টি কমপ্লায়েন্ট কারখানার সাড়ে ৪০০ শ্রমিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের ওপর গবেষণা চালিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। যেখানে উঠে আসে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের অন্তত কোনো একটি বিষয়ে ধারণা আছে প্রতি ১০০ জনে মাত্র ২১ জন শ্রমিকের (২১.১ %); যা খুবই নগন্য। আর অন্তত ২টি বিষয়ে ধারণা আছে ১০০ জনে মাত্র ৯ জনের (৯.৩ %)। ৩৬ শতাংশই জানায়, জলবায়ু বিষয়ে তারা কখনোই শোনেননি। যদিও ৭৮ শতাংশ শ্রমিক জানিয়েছেন কর্মক্ষেত্রে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কথা। অথচ আগামী দিনে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবে সবচেয়ে বড় ক্ষতির শিকার হবেন শ্রমিকরা।

 

এ বিষয়ে ইটিআই মনে করে, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করতে সামাজিক ডায়ালগ এবং কারখানা পর্যায়ে শ্রমিকদের সচেতন করা জরুরি।

 

Reporter: Babu Kamruzzaman

(This story was produced with the help of the Thomson Reuters Foundation. The content is the sole responsibility of the author and the publisher)

News24bd.tv/AA