হাত-চোখ বাঁধা নেই

হাত-চোখ বাঁধা নেই

চৌধুরী জহিরুল ইসলাম

“আমাদের হাত বাঁধা নেই, আমরা লিখতে পারি”! “আমাদের চোখও বাঁধা নেই, আমরা দেখতে পারি”! হাত-চোখ বাঁধা একটি যুবকের ছবি দিয়ে একটি বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়েছিল ১৯৯০ সালের শেষ দিকে। বিজ্ঞাপনটি ছিল ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে “আজকের কাগজ” নামে একটি দৈনিকের আত্মপ্রকাশ উপলক্ষে।

সেই বিজ্ঞাপনটি মানুষের দৃষ্টি কাড়ে। বাংলাদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজে বিজ্ঞাপনটির আবেদন ছিল প্রচুর।

এবং প্রকাশনার শুরু থেকেই আজকের কাগজ পত্রিকাটি বিপুল সাড়া ফেলেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে সদ্য পাশ করা তরুণ নাঈমুল ইসলাম খান ছিলেন এর সম্পাদক। সৌভাগ্যক্রমে আমি সেই পত্রিকায় একজন সাব এডিটর হিসেবে আমার কর্মজীবন শুরু করেছিলাম।

নাঈম ভাইয়ের বয়স তখন ছিল ৩০।

তার এই বয়স মনে রাখার কারণ হলো, পত্রিকা প্রকাশের বছরপূর্তির আগেই আমরা নাঈম ভাইয়ের ৩১তম জন্মদিবস উপলক্ষে একটি কেক কেটেছিলাম সংবাদ বিভাগের বড় টেবিলটিতে। সময়টি ছিল- প্রায় এক দশকের স্বৈর শাসন, এবং প্রায় দেড় দশকের সামরিকতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রের উত্তরণকাল।
আজকের বিভিন্ন সংবাদপত্রের সম্পাদক, টিভি চ্যানেলের অনেক প্রতিভাধর প্রধান সম্পাদক অথবা উপস্থাপক তৎকালে সেই আজকের কাগজেই তাদের তারুণ্যের পেশাজীবন শুরু করেছিলেন। অথবা অন্য সংবাদপত্র থেকে এসেছিলেন আজকের কাগজে হাতখুলে লিখবেন বলে।

দেখতে দেখতে প্রায় তিরিশটি বছর চলে গেল। সময়ের হিসেবে কম নয়! যদিও আমার সে সময়কার সহকর্মী মোস্তফা ফিরোজ দীপু ভাই, নঈম নিজাম, সৈয়দ বোরহান কবীর, আনিসুল হক, ফরহাদ টিটো, আমিনুর রশীদ, পুলক দা, শ্যামল দত্ত, অলক গুপ্ত, জাকারিয়া, মেরিনা ইয়াসমিন, সুমি খান, মোহসিন আব্বাস কিংবা অমিত হাবিবকে এখনো তারুণ্যদীপ্তই মনে হয়। এমন কি নাঈম ভাইও সবল, সতেজ।

সে সময় প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ভাই কিছুদিন বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছিলেন। তিনিও ঝরঝরে তরুণ। মানব জমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী ইত্তেফাক পত্রিকায় কাজ করলেও ছিলেন নিয়মিত কলাম লেখক। কবি আবু হাসান শাহরিয়ার ভাই একটু অসুস্থ শুনেছি। তাছাড়া ড. আজফার হোসেন এখনো গুরুগম্ভীর আলোচনায় ‘টক শো’গুলোতে থাকেন।

এমন কি আজকের কাগজের প্রকাশক এবং প্রধান সম্পাদক কাজী শাহেদ আহমেদকেও সেদিন দেখলাম সাক্ষাৎকার দিতে, হানিফ সংকেতের সাম্প্রতিক ইত্যাদিতে। আমার সেই সময়কার সহকর্মীদের মধ্যে জানামতে একমাত্র নিউজ এডিটর আহমেদ ফারুক হাসান এবং সাব এডিটর সঞ্জিব চৌধুরী এবং জহিরুল আহসান টিপু অকাল প্রয়াত।

“আজকের কাগজ” এখন আর নেই। ২০০৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর কাজী শাহেদ আহমেদ পত্রিকাটি পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছেন। অবশ্য ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তিনি আওয়ামী লীগার হয়ে গেছেন। দুই-একবার সংসদ সদস্য পদেও দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর এই রাজনৈতিক অভিপ্সার কারণেই পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায় বিএনপি আমলের শেষ দিকে।

পত্রিকাটির সঙ্গে আমার সাংবাদিকতা পেশায় নিজেকে যুক্ত করার বিষয়। যদিও অনিয়মিতভাবে শুরু করেছিলাম ১৯৯০-এর মাঝামাঝি ঢাকায় এসেই। এর অফিস ছিল প্রথমে ধানমন্ডি ২-এ সড়কের মোড়ে। আমি ঢাকায় আমার প্রথম জীবনও শুরু করেছিলাম পত্রিকাটির লাগোয়া দুটি বাড়ি পরে। সেটি ছিল কবি, কার্টুনিস্ট আর সাংবাদিকের একটি মেস বাড়ি।

আজকের কাগজ না থাকলেও সেই এক ঝাঁক তরুণ তুর্কি আজ বাংলাদেশের মিডিয়া জগতের আলোক বর্তিকা। কিন্তু মিডিয়া জগত কি সে রকম আছে? মিডিয়া কি এখনো বলতে পারে- আমাদের হাত বাঁধা নেই, আমরা লিখতে পারি! আমাদের চোখ বাঁধা নেই, আমরা দেখতে পারি? বাংলাদেশে দেখার মত সেই ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সংখ্যাও তো কম না!

১৯৮২ সালে আমি যখন ১৮ বছরের তরুণ, তখনই বাংলাদেশে সামরিক শাসনের জোয়াল নামে। আমি তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। তখনও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল ৩০ বছর আগেকার এক গৌরব গাঁথা ইতিহাস। প্রায় এক যুগ আগের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল আমাদের চেতনার মশাল।

আমাদের মনে হয়েছিল ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের এই দেশে ‘সামরিক শাসন’ খাপ খায় না। তাই সামরিক শাসন উপড়ে ফেলে গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণ করাকে আমাদের লক্ষ্য স্থির করেছিলাম। সে কারণে আন্দোলন, সংগ্রাম, মিছিল, মিটিং, প্রতিরোধ!

১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে সামরিক শাসনের পতন হয়। এরপর গত তিন দশকে আমরা নির্বাচনী ব্যবস্থার অনেক পরীক্ষা নীরিক্ষা করেও সফল হতে পারিনি। আমরা বারবার হোঁচট খেয়েছি। লক্ষ্যচ্যুত হয়েছি। ভেঙ্গে পড়েছি। আবার উঠে দাঁড়িয়েছি।

এখন পেছন ফিরে তাকালে দেখি- আমাদের অর্জন নিরঙ্কুশ হয়নি। আমাদের সমাজ এখনো সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে আচ্ছাদিত। সবলের শাসনে দূর্বল মাথাকুটে মরে। নারীর আসন সম্মানিত হয়নি। বরং নারীই সমাজ থেকে গা বাঁচিয়ে চলতে গিয়ে নিজেকে বোরকার আচ্ছাদনে একেবারে আড়াল করে ফেলেছে।

আমরা রাজাকার-আলবদরকে চিহ্নিত করতে পেরেছি, কিন্তু সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারিনি।
বরং সমাজে নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে অন্ধত্ব ও কূপমন্ডুকতা। মানুষকে অন্ধকার এবং কূশিক্ষার গর্তে ঠেলে দেয়াই এর উদ্দেশ্য। সমাজের প্রান্তিক মানুষেরা এখনো রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করার সুযোগ পান না, ভোটের অধিকার নেই বলে।

মানুষকে জাগানোর কাজটি করা প্রয়োজন। মানুষ জাগবে সচেতন হয়ে, ভয়-ভীতির উর্ধে উঠে। শিক্ষা-কর্মে এবং জীবন যাপনে সবাই বিকাশের সুযোগ পাবে। সবলের বিরুদ্ধে দূর্বল যেন নির্ভয়ে কথা বলতে পারে, সুবিচার প্রার্থনা করতে পারে। যুক্তি এবং বিজ্ঞানমনস্কতা যেন সমাজের চালিকা শক্তি হয়।

বাংলাদেশ এখন শিক্ষিত বেকারের দেশ। এর কারণ- আমরা শিক্ষাকে কর্মমুখী করতে পারিনি। এই গণ বেকারত্বও একটি মারাত্মক পশ্চাদপদতা। বেকারত্বের অভিশাপে তারুণ্যের জীবনীশক্তি লোপ পায়। জীবনকে নিয়ে তার কোনো পরিকল্পনা থাকে না। দেশ এবং সমাজের প্রতি তার কোনো দায়বদ্ধতা তৈরি হয় না।

বেকারত্ব দূর করার উদ্যোগটা নিতে হবে সরকারকেই। প্রত্যেক জেলায় চাকরি পরামর্শকেন্দ্র খুলতে হবে। প্রশিক্ষণ এবং সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এসব বিষয়ে সরকারকে মনোযোগী করে তোলার কাজটিও করতে হবে তরুণদেরকেই।

আজকের যারা তরুণ, তারাই এক সময় আমাদের মত মধ্যবয়সী হবে। সমাজকে দিক নির্দেশ করবে কিন্তু তরুণরাই। তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লক্ষ্যস্থির করতে হবে, বর্তমান এবং আগামীর বাংলাদেশকে কেমন দেখতে চায় তারা। বাঁধা থাকবে। প্রগতির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীলতা থাকবে। সেই বাঁধা ডিঙ্গানোই তো তরুণের কাজ।

তরুণদের উদ্দেশ্যে বলবো- তোমরা সকল বাঁধা অতিক্রম করে এগিয়ে চলো। আমরা বাঁধা অতিক্রম করেছি। আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম, তারাও বাঁধা অতিক্রম করেছিল। সময়ের সাহসী তরুণ আমরা তাকেই বলি- যার আত্মমর্যাদা বোধ আছে, সৎ সাহস আর ন্যায় বোধে নিজেকে জাগিয়ে তোলার শক্তি যে রাখে। সেই অমিত তেজে তরুণরা বর্তমানের বাঁধা মোকাবিলা করবে, সে আশা করা অমূলক নয় মোটেও। নিউইয়র্ক, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০।

লেখক: নিউইয়র্ক প্রবাসী।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

 

নিউজ টোয়েন্টিফোর/কামরুল