করোনাকালে খুন-খারাপি বেড়েছে গাজীপুরে

করোনাকালে খুন-খারাপি বেড়েছে গাজীপুরে

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্, গাজীপুর থেকে

বিশ্বব্যাপী এক আতঙ্কের নাম করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯)। এর নাম শুনেই যেন আতকে ওঠেন দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষ। আর এ থেকে রেহাই পায়নি বাংলাদেশও। দেশের এই ক্রান্তিকালে শিল্পাঞ্চলখ্যাত গাজীপুরে হঠাৎ বেড়েছে খুন-খারাপির মতো ঘটনা।

গত দুই আড়াই মাসে এ জেলায় অন্তত ৩৩টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এতে জেলার আইনশৃঙ্খলা চরম অবনতি দেখা দিয়েছে। যদিও পুলিশ বলছে ভিন্ন কথা। স্বাভাবিক সময়ের মতোই জেলার আইনশৃঙ্খলা বিরাজ করছে বলে জানায় পুলিশের ঊর্ধ্বতনরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেখানে করোনা ভাইরাস নামক একটি জীবানুর কবলে দেশের মানুষ। সেখানে খুন, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতির মতো জঘন্য ঘটনা কাম্য নয়। গাজীপুরের টান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) সদস্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মুকুল কুমার মলি­ক বলেন, বৈশ্বিক এ সময়ে আমরা সহনশীল না হয়ে দুর্ধর্ষ হয়ে যাচ্ছি। যা কখনোই কাম্য নয়।
আমাদের উচিত করোনা কালে একে অপরের প্রতি সহনশীল হওয়া।

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার জৈনাবাজার এলাকায় মালয়েশিয়া প্রবাসি রিজওয়ান হোসেন কাজল নামে এক প্রবাসী স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে বসবাস করে আসছিল। বেশ ভালোই দিন যাচ্ছিল প্রবাসী কাজলের পরিবারে। চাকরির সুবাদের কাজল থাকেন মালয়েশিয়ায়। গত ২৩ এপ্রিল রাতে একদল দুর্বৃত্ত প্রবাসী ওই কাজলের বাসায় হানা দিয়ে স্ত্রী ফাতেমা ও তিন সন্তানকে গলা কেটে হত্যা করে। এ ঘটনায় নির্মমতা এতোটাই ছিল যে, হত্যাকাণ্ডের আগে দুর্বৃত্তরা কাজলের স্ত্রী ফাতেমা ও স্কুলছাত্রী সাবরিনা নূরাকে ধর্ষণ করে। এ সময় টাকা-পয়সা, স্বর্ণালংকারসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুটে নেয় দুর্বৃত্তরা।

নিহতরা হলো, প্রবাসী কাজলের স্ত্রী ফাতেমা বেগম (৪০), মেয়ে সাবরিনা নূরা (১৬), হাওরিন (১১) ও প্রতিবন্ধী ছেলে ফাদিল (৭)। নিহতদের মধ্যে নূরা এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘটনার সাথে জড়িত ৬ জনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে।

অপরদিকে গত ১৬ মে জেলার টঙ্গীর মধুমিতা রেলগেট এলাকার মামুন মিয়ার সাত বছরের শিশু কন্যা চাঁদনিকে ধর্ষণের পর হত্যা করে এক পাষণ্ড। আলোচিত এ ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয় পুরো জেলায়। ছোট্ট শিশুটিকে ধর্ষণ করেও ক্ষান্ত হয়নি পাষণ্ড। ঘটনা ধামাচাপা দিতে শিশুটিকে গলাটিপে হত্যা করে। ওই পাষণ্ডের নাম আবু সুফিয়ান সিয়াম বলে জানা
গেছে। যদিও পরে র‌্যাপিড এ্যাকশন বেটালিয়ানের (র‌্যাব) সাথে এক বন্দুকযুদ্ধে সুফিয়ান নিহত হয়।

অন্যদিকে গত ১৮ জুন জেলার কাপাসিয়ায় বাবা ও ভাই মিলে পিটিয়ে হত্যা করে মোবারক হোসেন নামের এক যুবককে। নিহতের বাবা শফিউলল্লাহ ১৬৪ জবানবন্দিতে ছেলেকে হত্যার দায় স্বীকার করেন। গত ৩ জুন কাপাসিয়ার জুনিয়া এলাকায় টিটু নামের এক গৃহকর্তা তার বাসার কাজের মহিলা পারভিনকে রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে।

অপরদিকে গত ১২ জুন জেলার কালিয়াকৈর চন্দ্রা এলাকায় জুয়া খেলা নিয়ে আব্দুল মান্নান নামের এক পোশাক শ্রমিককে কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষরা। শুধু তাই নয়, গত ১৬ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর গানম্যান কিশোর কুমার দুই
বন্ধুকে গুলি করে হত্যা করে। কিশোর কুমার গাজীপুর পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) এএসআই।

নিহতরা হলো, গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার সীমান্তবর্তী টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের আজগানা এলাকার মো. শহিদ (৩০) ও একই এলাকার মো. মহিম উদ্দিন (৩২)। মন্ত্রীর গানম্যান কিশোর কুমার তার স্ত্রীর সাথে বন্ধুর পরকীয়া আছে এমন সন্দেহে ওই দুই বন্ধুকে গুলি করেন। মো. শহিদ ঘটনাস্থলেই মারা যান এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় মো. মহিম
উদ্দিনের মৃত্যু হয়। পরে মন্ত্রীর গানম্যান কিশোর কুমারকে ঢাকার আশুলিয়ার শিমুলতলী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ সময় তার কাছ থেকে একটি পিস্তল ও ৬ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে।

পুলিশ জানায়, তারা তিনজন পরস্পরের বন্ধু। প্রায়ই তারা এক সঙ্গে আড্ডা দিতেন। স্ত্রীর সঙ্গে কিশোরের দীর্ঘদিন ধরে দাম্পত্য কলহ চলছিল। পরে কিশোরের স্ত্রী তাকে ছেড়ে বাবার বাড়ি চলে যান। কিশোরের ধারণা, তার স্ত্রীর সঙ্গে মহিমের পরকীয়া আছে। এ জন্য মহিমকে হত্যার উদ্দেশ্যে গত ১৬ এপ্রিল ডেকে আনেন কিশোর। এ সময় মহিম বন্ধু শহিদকে নিয়ে কিশোরের উল্লি­খিত স্থানে দেখা করতে যায়। রাত পৌনে ১০টার দিকে কিশোর মোটরসাইকেলে করে গিয়ে
পিস্তল দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করেন। আর এভাবেই এ জেলায় একের পর এক খুনের ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে। কোনোভাবেই যেন এর লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। তারপরও আইনশৃঙ্খলা ঠিক আছে বলে দাবি করছেন পুলিশ।

গাজীপুর পুলিশ সুপার (এসপি) শামসুন্নাহার পিপিএম বলেন, খুনের ধরণগুলো যদি পর্যালোচনা করা হয় দেখা যাবে অন্যান্য সময়ের মতোই ঘটেছে। বিশেষ করে পারিবারিক, জমি সংক্রান্ত, পরকীয়া সংক্রান্ত কারণে প্রায়ই হত্যার মতো ঘটনা ঘটে গাজীপুরে। এখানে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মধ্যে পরকীয়ার ঘটনা বেশি ঘটে। তারপরও আমরা আইনশৃঙ্খলা
ঠিক রাখতে বিভিন্ন এলাকায় পুলিশি টহল বাড়িয়েছি। করোনা মোকাবেলায় সচেতনতা বাড়ানোসহ নানা বিষয়ে
গাজীপুরবাসীকে বুঝাতে জেলা পুলিশ সড়ক-মহাসড়ক ও পাড়া-মহল্লায় নানা ক্যাম্পিং করছে। আইনশৃঙ্খলা সম্পূর্ণ ঠিকঠাক আছে বলেও দাবি করেন পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার।

দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ জেলার আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখতে পুলিশ বাহিনীকে জেলা পুলিশ ও মেট্রোপলিটান পুলিশে বিভক্ত করা হয়েছে। গাজীপুর মেট্রোতে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ৮টি থানা। বিশাল আকারে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে পুলিশ সদস্যদের। জেলা পুলিশ, মেট্রোপলিটান পুলিশ, র‌্যাব, আনসার, ট্রাফিক পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশসহ নানা ধরণের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থাকা সত্ত্বেও খুন, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতির মতো অপরাধ দিন দিন বাড়ছেই।

গাজীপুর জেলা পুলিশ এলাকায় গত আড়াই মাসে অন্তত ২০টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। অপরদিকে মেট্রোপলিটান পুলিশ এলাকায় ঘটেছে ১৩টি খুনের ঘটনা।

গাজীপুর মেট্রোপলিটান পুলিশ কমিশনার মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, গাজীপুরের প্রত্যেকটি খুনের ঘটনাই পারিবারিক কলহের কারণে ঘটছে। এখানে পরিকল্পিত খুন বা অবৈধ লাভের উদ্দেশ্যে খুন এমন ঘটনা গাজীপুরে নেই। মানুষের মধ্যে এখন যে ক্রাইসিস চলছে তারমধ্যে মানুষ সবকিছু বাদ দিয়ে একটি সুস্থ ধারায় চলছে। তারপরও একটি শ্রেণি রয়েছে
যারা সুযোগ বুঝে অপরাধ করে।

(নিউজ টোয়েন্টিফোর/তৌহিদ)

সম্পর্কিত খবর