মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর কঠোর সমালোচনা যুক্তরাষ্ট্রের

নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক

মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর কঠোর সমালোচনা যুক্তরাষ্ট্রের

এনআরবি নিউজ, নিউইয়র্ক থেকে

নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরের ইকোসক চেম্বারে শুক্রবার মিয়ানমারর পরিস্থিতির উপর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যগণ ‘আরিয়া ফর্মূলা সভা’য় অংশগ্রহণ করেন। এই সভার আয়োজন করে ব্রিটিশ ও ফরাসী ডেলিগেশন।

অ্যাডভাইজরি কমিটি অন রাখাইন স্টেট-এর চেয়ারম্যান নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানও এই সভায় বক্তব্য রাখেন।  

কফি আনান তাঁর বক্তব্যে সম্প্রতি মিয়ানমার সরকারের কাছে পেশকৃত ‘অ্যাডভাইজরি কমিটি অন রাখাইন স্টেট’ এর রিপোর্টের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোকপাত করেন।

রাখাইন প্রদেশের জনগণের স্থায়ী শান্তি, নিরাপত্তা, সমৃদ্ধি, উন্নয়ন ও চলমান সংকটের সমাধানের লক্ষ্যে মিয়ানমার সরকার তাঁর কমিশন প্রণীত রিপোর্টের সুপারিশমালার দ্রুত বাস্তবায়ন করবে মর্মে তিনি প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।  

কফি আনান রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের ১৯৮২ সালে প্রণীত নাগরিকত্ব আইন আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সংশোধনের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের মর্যাদা ও নিরাপত্তার সাথে নিজ ভূমিতে প্রত্যাবর্তন, মানবিক সহায়তা ও মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করতে কফি আনান তাঁর রিপোর্টে উল্লেখ করেন।

বাংলাদেশের সাথে সীমান্ত নিরাপত্তা ও দ্বিপাক্ষিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা রক্ষা করার বিষয়ে জোর দিয়ে কফি আনান বলেন, এই সুসম্পর্ক ও সহযোগিতার মাধ্যমে উভয় দেশই লাভবান হবে।

 

কফি আনান রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে মিয়ানমারের আন্তঃসম্প্রদায়ের মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতার উপর বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, “এই ভয়াবহ রোহিঙ্গা সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত রাখাইন প্রদেশের জনগণের কল্যাণে মিয়ানমার সরকার রাখাইন জনগোষ্ঠী ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ঐক্যমত্য হয়ে কাজ না করে”।

নিরাপত্তা পরিষদের সকল সদস্যই এ সংকট সমাধানের পক্ষে বক্তব্য রাখেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি এটিকে মানবিক বিপর্যয় আখ্যা দিয়ে বলেন, “এনাফ ইজ এনাফ। আমরা এটি আর গ্রহণ করতে পারছি না। আমরা মিয়ানমার সিকিউরিটি ফোর্সের এই হীন কাজের নিন্দা জানাই”।  

যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি অনতিবিলম্বে মানবিক সহযোগিতা প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি, সহিংসতা বন্ধ, জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের পূর্ণ প্রবেশাধিকার, রোহিঙ্গা শরনার্থীদের নিরাপদ ও নিশ্চয়তার সাথে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনসহ কফি আনান কমিশনের রিপোর্টের পূর্ণ বাস্তবায়নের উপর জোর দেন।  

প্রায় একই ভাষায় কথা বলে নিরাপত্তা পরিষদের অন্য সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিগণ। তারা বাস্তুচ্যুত ও অসহায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মানবিক সাহায্য প্রদান করায় বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশের জনগণের ভূয়সী প্রসংশা করেন। সকলেই সহিংসতা বন্ধ, কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালা বাস্তবায়ন এবং উদ্বাস্তু প্রত্যাবাসনের উপর গুরুত্বারোপ করেন।   

নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যগণের বাইরে বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড এর প্রতিনিধিগণ বক্তব্য রাখেন। এছাড়া অফিস অব দ্যা হাই কমিশন অব হিউম্যান রাইটস, অফিস ফর দ্যা কো-অর্ডিনেশন অব হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাফেয়াস, ইউএনএইচসিআর এর প্রতিনিধি, ওআইসি এবং ইউরোপিও ইউনিয়নের প্রতিনিধিগণ বক্তব্য রাখেন।

জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন বলেন, “দুর্ভাগ্যজনক এই যে মিয়ানমার সরকারের দেওয়া বিবৃতি আর রাখাইন প্রদেশের প্রকৃত পরিস্থিতির মধ্যে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের অফিসের র‌্যাপিড রেসপন্স মিশনের সাম্প্রতিক রিপোর্টে এমনটিই তুলে ধরা হয়েছে। ২৫ আগস্টের পর থেকে আজ সকাল পর্যন্ত ৫ লাখ ৩৬ হাজার মানুষ মিয়ানমার সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। সব মিলিয়ে উদ্বাস্তুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯ লাখে”।  

গত মাসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রদত্ত ভাষণে মিয়ানমার পরিস্থিতির সমাধানে যে ৫টি পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করা হয় রাষ্ট্রদূত মাসুদ তাঁর বক্তৃতায় তা তুলে ধরে বলেন, “সহিংসতা ও একটি জাতিকে নির্মূলের প্রক্রিয়া বন্ধ, মিয়ানমারে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফান্ডিং মিশন প্রেরণ, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সেফ জোন তৈরি, জোরপূর্বক উচ্ছেদকৃত মানুষদের নিজ ভূমিতে স্থায়ী প্রত্যাবর্তন এবং কফি আনান কমিশনের সুপারিশের পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে”।  

রাষ্ট্রদূত মোমেন আরও বলেন, “মিয়ানমারের সামরিক জান্তার উস্কানি এবং বাংলাদেশের আকাশ সীমা লঙ্ঘন সত্ত্বেও বাংলাদেশ সর্বোচ্চ সহিষ্ণুতা প্রদর্শণ ও মিয়ানমারের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে”।   

রাষ্ট্রদূত বলেন, দুদেশের মধ্যে একটি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের সিদ্ধান্ত হলেও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আরও বিশদ আলোচনার প্রয়োজন হবে। এ ধরনের কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, “অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে আন্তর্জাতিক মহল বিশেষ করে নিরাপত্তা পরিষদের অংশগ্রহণ ও তদারকি ছাড়া মিয়ানমারের সাথে একটি দীর্ঘমেয়াদি ও অর্থপূর্ণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মূল সমস্যা সমাধান করা কঠিন হবে।  

স্থায়ী প্রতিনিধি প্রধানমন্ত্রীর উক্তি উল্লেখ করে বলেন, “এই সংকটের শেকড় মিয়ানমারে এবং এর সমাধানও মিয়ানমারে নিহিত”।   

সম্পর্কিত খবর