জীবন দিয়ে দেশকে গর্বিত করে গেলেন পৃথুলা

পৃথুলা রশিদ

জীবন দিয়ে দেশকে গর্বিত করে গেলেন পৃথুলা

অনলাইন প্রতিবেদক

পৃথিবীতে যত ধরণের দুর্ঘটনা আছে, বিমান দুর্ঘটনা তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। অধিকাংশ আরোহীরই এক্ষেত্রে মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে। তবে চাইলে অনেক ক্ষেত্রেই বেঁচে যেতে পারেন পাইলট। কারণ, তারাই সবার আগে বিষয়টি টের পান এবং নিজের জীবন বাঁচানোর নানা উপকরণ ককপিটেই থাকে।

থাকে দুর্ঘটনায় পড়তে যাওয়া বিমান থেকে প্যারাস্যুট নিয়ে বাইরে লাফিয়ে পড়ার সুযোগ। তবে যাত্রীদের বিপদে ফেলে নিজের জীবন নিয়ে পালিয়ে বাঁচতে চান না পাইলটরা। চাননি নেপালে বিধ্বস্ত হওয়া ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজের সহকারি পাইলট পৃথুলা রশিদও। তাই নিজের জীবন দিয়ে বাঁচিয়ে গেছেন ১০ নেপালি যাত্রীর প্রাণ।
জীবন দিয়ে বাংলাদেশকে করে গেছেন গর্বিত। আর এ কারণেই এই বীর নারীকে ‘ডটার অব বাংলাদেশ’ আখ্যা দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছে নেপালের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম। সোশ্যাল মিডিয়ায়ও অনেক নেপালি পৃথুলার প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।

ওই বিমানের বেঁচে যাওয়া একাধিক যাত্রী জানিয়েছেন, পৃথুলা চাইলে নিজে বেঁচে যেতে পারতেন। সেই সুযোগ তার ছিল। তবে তিনি তা করেননি। দুর্ঘটনায় নিজের কথা না ভেবে আগে সেই যাত্রীদের রক্ষার চেষ্টা করেন পৃথুলা। ১০ জন নেপালি যাত্রীকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে নিরাপদে সরিয়ে দিতে নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করতে করতেই একসময় মৃত্যু কাছে টেনে নেয় পৃথুলাকে।

তবে পৃথুলা রশিদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়নি। ওই দশ নেপালি যাত্রীর সবাই দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়েছেন। তারা সবাই এখন বেঁচে আছেন। উড়োজাহাজটিতে চার ক্রুসহ মোট ৭১ আরোহীর মধ্যে ৫০ জন মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। সেই নিহতের তালিকায় রয়েছে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের তরুণ বৈমানিক প্রিথুলা রশিদের নামও। ওই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২৬ বাংলাদেশি।

এদিকে ওই বিমান দুর্ঘটনায় নিহত ২৬ জন বাংলাদেশির মধ্যে সবচেয়ে আলোচনা হচ্ছে কো-পাইলট পৃথুলা রশীদকে ঘিরে৷ মৃত্যুর পরও কিছু মানুষ তাঁর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন৷ বিমান বিধ্বস্তের পর যখন একে একে নিহতদের খবর আসছে, তখন বিমানের পাইলট এবং কো পাইলট কে ছিলেন সে ছবিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরছিল। কো-পাইলট ছিলেন পৃথুলা রশীদ, যিনি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। নারী হওয়ার 'অপরাধে' মৃত্যুর পরও রেহাই পাননি তিনি। অনেকেই তাঁর যোগ্যতা আর দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। অথচ, পরে দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া কয়েকজন জানান, এই পৃথুলাই নিজের জীবন দিয়ে বাঁচিয়ে গেছেন ১০ জনের প্রাণ।

দুর্ঘটনার পর পৃথুলাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দুইটি পক্ষ তৈরি হয়ে যায়। একপক্ষ পৃথুলার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, নানা সমালোচনা করেন। অপর পক্ষ দাঁড়ান সেই সমালোচনাকারীদের বিপক্ষে। তবে নেপালি গণমাধ্যমগুলোতে যখন পৃথুলাকে নিয়ে একের পর এক ইতিবাচক সংবাদ প্রকাশ হতে থাকে, তখন সেই সমালোচনার ঢেউ ছোট হতে থাকে। অনেকেই তাদের মন্তব্য সোশ্যাল মিডিয়া থেকে মুছে ফেলেন। তবে নারী হয়ে বিমানের চালকের আসনে থাকায় যারা পৃথুলাকে নিয়ে সমালোচনা করেছেন তাদেরও একহাত নিয়েছেন নেটিজেনদের একাংশ।

তানভীর হোসাইন জনি টুইটারে লিখেছেন, ''ভীনদেশি নেপাল তাকে বলছে, 'ডটার অফ বাংলাদেশ'। আর নিজ দেশের মানুষ দিচ্ছে গালি, সেও কেবল 'নারী' হবার কারনে! ছিঃ ছিঃ ছিঃ''

সাদিয়া নাসরিন ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, ‘‘পৃথুলার অপরাধ কম নয়৷ এই পুরুষ শাসিত সমাজে পৃথুলা উর্ধাকাশ ভেদ করে আরো আরো আরো উপরে উঠেছিল৷ অত উপরে উঠেছিল বলেই আমরা অনেকেই যা পারি না, আমরা অনেকেই যা করি না পৃথুলা তাই পেরেছিল, তাই করেছিল৷ নিজে মরতে মরতে দশজন ভিনদেশির জীবনকে নিরাপদে তাঁদের স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে গেল৷ তারপর এই বীরকন্যা চুপচাপ মৃত্যুকে গ্রহণ করলো৷ নেপালের গণমাধ্যম এই বীরকন্যাকে ‘ডটার অফ বাংলাদেশ' বলে উল্লেখ করেছে৷ আর আমরা এই বাংলাদেশের মানুষরা (পড়ুন পুরুষ) এই মেয়েটিকে বিমান দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করে মিডিয়া ট্রায়াল শুরু করেছে৷''

মাশরুফ হোসেইন লিখেছেন, ‘‘মরার আগে এই মেয়েটা যত জনকে পেরেছে বাঁচিয়ে গেছে৷ মরেও এর শান্তি হয় নাই, পুরুষতান্ত্রিক তেলাপোকাগুলো শোরগোল তুলেছে যে মেয়েদের দিয়ে প্লেন চালানো হয় না৷ এই তেলাপোকাগুলো আরো দশবার জন্মালেও নিজ যোগ্যতায় প্লেনের ককপিট দেখবার যোগ্যতা অর্জন করবে না৷ পাইলটের অদক্ষতায় যদি দুর্ঘটনা হয়, সেক্ষেত্রেও তার লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ নিয়ে সমালোচনা করার অধিকার কারো নেই৷ আলাদা করে পৃথুলার কথা লিখছি, কারণ তাঁকে মৃত্যুর পরেও গালি শুনতে হচ্ছে স্রেফ নারী হওয়ার কারণে৷ এক পৃথুলার আত্মত্যাগ জন্ম দিক আরো শত শত পৃথুলার!''

কাজী সাবির লিখেছেন, ‘‘এরপর থেকে প্লেনে ওঠার আগে জেনে নিবেন যে পাইলট নারী কিনা, দুর্ঘটনা হলে তার মমতায় আপনার জীবনটা বেঁচেও যেতে পারে!''

তৃষিয়া নাশতারান তুলে ধরেছেন আমাদের মধ্যে লিঙ্গ বৈষম্যের চরম দিকটা৷ লিখেছেন, ‘‘প্লেনটা চালাচ্ছিলেন ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান৷ সেটা নিশ্চিত হওয়ার পরে পুরুষের চালনশৈলী বিষয়ক কোনো সমালোচনা আমার চোখে পড়েনি৷ বরং আবিদ সুলতানের ক্যারিয়ারের বৃত্তান্ত লিখে, তিনি কত ব্রাইট অফিসার সেটা লিখে খবর এসেছে৷ তিনি একটানা তিনটা ফ্লাইটে সেদিন ক্লান্ত, বিধ্বস্ত ছিলেন সেটা জেনেছি৷ কী কারণে পাইলট ওই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিলেন সেটা নিয়ে বিশ্লেষণ হচ্ছে এবং সেটাই স্বাভাবিক৷ আবিদ সুলতানের জায়গায় পৃথুলা রশিদকে রেখে ভাবুন একবার৷ একজন পাইলট শুধুই একজন পাইলট৷ তিনি নারী বা পুরুষ হিসেবে আলাদা সম্মান কিংবা সমালোচনা কেন পাবেন? কেউ সংবেদনশীল হতে না পারলে অন্তত চুপ থাকতে তো পারেন৷''

প্রিথুলা ছিলেন সোমবার বিধ্বস্ত হওয়া ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজের সহকারি পাইলট এবং ইউএস বাংলার প্রথম নারী পাইলট। বিমান চালনা ছিল তার ভালবাসার জায়গা। মা-বাবার একমাত্র সন্তান পৃথুলা। ২০১৬ সালের জুলাই মাস থেকে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের সঙ্গে যুক্ত তিনি। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর আরিরাং অ্যাভিয়েশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে বিমান চালনার ওপর ডিগ্রি নেন। ২০১২ সালে আরিরাং অ্যাভিয়েশনের তৃতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হন। দুই বছরের বাণিজ্যিক পাইলট লাইসেন্স (সিপিএল) কোর্স শেষ করে নিবন্ধিত হন। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে শোকে বাকরুদ্ধ পৃথুলার মা-বাবা। সোমবার থেকে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন তাঁরা। পৃথুলার মা বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। স্বজনরা শান্তনা দিচ্ছেন। কিন্তু কোন শান্তনাই যে পৃথুলার অভাব পূরণ করতে পারবে না।

সম্পর্কিত খবর