পঙ্কজ ভট্টাচার্যের অনুসরণযোগ্য সংগ্রামী জীবন   

সংগৃহীত ছবি

পঙ্কজ ভট্টাচার্যের অনুসরণযোগ্য সংগ্রামী জীবন   

অনলাইন ডেস্ক

প্রবীণ রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য আর নেই। সোমবার (২৩ এপ্রিল) রাতে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ এবং পরে বাংলাদেশের সব আন্দোলন-সংগ্রামের একজন নেতৃস্থানীয় কর্মী ও সংগঠক ছিলেন তিনি।

 

পঙ্কজ ভট্টচার্যের জন্ম ১৯৩৯ সালে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া গ্রামে। তাঁর জন্মের পরেও নোয়াপাড়া ছিল রাজনীতির একটি উজ্জ্বল পীঠস্থান। তাঁদের পারিবারও ছিল না এর বাইরে। ফলে স্কুলজীবন থেকেই তিনি রাজনীতিমনস্ক হয়ে ওঠেন।

অচিরেই সেই রাজনীতিমনস্কতা তাঁকে সক্রিয়তাবাদী করে তোলে। ১৯৫৪ সাল থেকে জড়িয়ে পড়েন ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে। পাকিস্তানের দুঃসহ রাজনৈতিক পরিবেশে ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মী হিসেবে তাঁর যে রাজনৈতিক জীবনের উত্থান, সেই জীবনের পথচলা কোনোক্রমেই সহজ ছিল না।

পঙ্কজ ভট্টাচার্য ছাত্র ইউনিয়নকে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে যে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন, এককথায় তা তুলনাবিহীন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ১৯৬৪ সালে তিনি প্রথম কারাগারে যান। অপরাধ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসব পণ্ড করায় সক্রিয়ভাবে তাঁর যুক্ত থাকা। আচার্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের হাতে ডিগ্রির সার্টিফিকেট তুলে দেওয়া এবং ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল সামরিক শাসক আইয়ুব খানের দোসর তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানের। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তা মানতে রাজি ছিলেন না। পরিকল্পনামতো তাঁরা সেই সমাবর্তন সভা পণ্ড করে দেন। মোনায়েম খান বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে সেদিন কোনোমতে পালিয়ে তাঁদের হাত থেকে রক্ষা পান। এ ঘটনার জন্য বেশ কিছু ছাত্রকে নানাভাবে শাস্তি দেওয়া হয়। পঙ্কজ ভট্টচার্যের নামে জারি করা হয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। সেই অবস্থায় গোপনে চলে যান তিনি চট্টগ্রামে। নিজেদের গ্রামের বাড়িতে। দেখা করেন মা-বাবা ও ভাইবোনদের সঙ্গে। দ্বিতীয় দিন তিনি গ্রেপ্তার হন। তাঁকে গ্রাম থেকে চট্টগ্রাম জেলে নিয়ে আসা হয়। এরপরের যে ঘটনা, তা যে কাউকে অশ্রুসিক্ত করবে।  

গ্রেপ্তারের স্বল্প কিছুকাল পরেই চট্টগ্রাম জেল থেকে তিনি পুলিশ হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কুমিল্লা জেলে। চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে আসতেই তিনি দেখতে পান বিপরীত দিকের চাঁদপুরগামী ট্রেনের জন্য প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষারত তাঁর মা-বাবা, ভাই-বোন। সে এক নাটকীয় দৃশ্য। মা-বাবা ও বোনেরা দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাচ্ছেন। আর পঙ্কজ ভট্টচার্য যাচ্ছেন কারাগারে। সবার চোখে পানি। তিনি নিজের আবেগকে সংবরণ করে কুমিল্লাগামী ট্রেনে চেপে বসেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধে ‘ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের’ যৌথ বাহিনী গড়ে তোলা ও পরিচালনায় পঙ্কজ ভট্টাচার্যের ভূমিকা অনন্য।  

জীবনে তিনি মোট চারবার জেল খেটেছেন। এমনকি তাঁর বিরুদ্ধে ১৯৬৭ সালে আনা হয়েছিল ‘স্বাধীন বাংলা ষড়যন্ত্র মামলা’র অভিযোগ। গ্রেপ্তার করে তাঁকে ডিবি অফিসে আনা হয়। তারপর কঠিন জেরার পর তাঁকে পাঠানো হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।

তাঁর জেলজীবনের অভিজ্ঞতাও খুবই সমৃদ্ধ। তিনি জেলে পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গভীর সাহচর্য। দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তিনি তাঁর সাহচর্যে ছিলেন ১৯ দিন। জেল থেকে যেদিন পঙ্কজ ভট্টচার্য ছাড়া পান, তখন তাঁকে মাথা নিচু করে ছোট ফটক দিয়ে নয়, বঙ্গবন্ধু জেল কর্তৃপক্ষকে বলেন পুরো ফটক খুলে দিতে। মাথা উঁচু করে তিনি বেরিয়ে আসেন জেলের বাইরে।

পঙ্কজ ভট্টাচার্য যখন ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে ছিলেন, তখন সাংগঠনিকভাবে তাকে শক্তিশালী করতে ও দেশব্যাপী তার কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে দিতে তাঁর নিজের প্রয়াসের অন্ত ছিল না। অথচ সেই ছাত্রসংগঠনটিই যখন তাঁর নেতৃত্বে থাকা অবস্থাতেই ভেঙে যায়, মস্কো আর চীনপন্থী, অথবা ছাত্র ইউনিয়ন ‘মতিয়া গ্রুপ’ ও ছাত্র ইউনিয়ন ‘মেনন গ্রুপে’ বিভক্ত হয়ে যায়, তখন তার আক্ষেপের অন্ত ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন শেষে, ছাত্র ইউনিয়নের সাংগঠনিক জীবন শেষে তিনি যোগ দেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে। সেই পার্টিও যখন বিভক্ত হয়ে যায় দুটি গ্রুপে—ওয়ালী ন্যাপ ও ভাসানী ন্যাপে—পঙ্কজ ভট্টচার্য ওয়ালী ন্যাপের হয়ে কাজ করতে থাকেন। নেতৃত্বেও আসেন।

দেখতে দেখতে শুরু হয়ে যায় উনসত্তরের উত্তাল গণ-আন্দোলন। মনে রাখতে হবে, এ দেশের প্রতিটি স্তরের গণ-আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন পঙ্কজ  ভট্টচার্য। ফলে জেল খেটেছেন, আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু তাঁর জীবনে বিশ্রাম বলে কিছু ছিল না। সভা-সমাবেশে তিনি তাঁর ভাবগম্ভীর স্বরে যখন ভাষণ দিতেন, দর্শক মন্ত্রমুগ্ধের মতো তা শুনতেন। উদ্দীপ্ত হতেন।

সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও তাঁর ভূমিকা যেমন উল্লেখ করার মতো, তেমনি মুক্তিযুদ্ধে ‘ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের’ যৌথ বাহিনী গড়ে তোলা ও তার পরিচালনায়ও পঙ্কজ ভট্টাচার্যের ভূমিকা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অঙ্গীভূত অংশ। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকাকে খাটো করে দেখার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনেও তাঁর ভূমিকা উল্লেখ করার মতো। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সাহায্যে তাঁর নেতৃত্বে তাঁর দল ন্যাপ যে ভূমিকা পালন করেছিল, অন্য কোনো দলের তেমন ভূমিকা আমাদের চোখে পড়েনি।

বঙ্গবন্ধুর সপরিবার হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ চেষ্টাতেও পঙ্কজ ভট্টচার্যের ভূমিকা ছিল সাহসী ও স্মরণীয়। তবে তিনি গভীরভাবে আহত হয়েছিলেন নিজের দলের মধ্যে নেতৃত্বের কোন্দলে। সে কথা তিনি যেমন তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার সেই সব দিন’-এ উল্লেখ করেছেন, তেমনি ব্যক্তিগতভাবেও বলতেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মোজাফফর ন্যাপে দ্বন্দ্বের ফলে এ দলও খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যায়। কিন্তু তিনি ন্যাপকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে গড়ে তোলেন ‘ঐক্য ন্যাপ’। গড়ে তোলেন সংগঠন ‘সামাজিক আন্দোলন’। শেষ সময় পর্যন্ত শেষোক্ত এই দলেরই কাজে নিজেকে তিনি জড়িত রেখেছেন।

বস্তুত দীর্ঘ ছয় দশকের রাজনৈতিক জীবনে পঙ্কজ ভট্টাচার্য কখনো রাজনৈতিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। সুবিধাবাদী হতে চাইলে তিনি বহু সুযোগ-সুবিধার অধিকারী হতে পারতেন। তাঁর জীবনে এসব কিছুর নজির নেই। মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব এসেছে, তিনি সেই প্রস্তাব অত্যন্ত ভদ্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। সহধর্মিণী নারীনেত্রী রাখী দাশ পুরকায়স্থকে অকালে হারিয়ে তিনি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেও একান্ত আপনজনকে হারানোর সেই বেদনাকে বুকে পুষে রেখে কাজ করে গেছেন। তাঁর সামাজিক-রাজনৈতিক তৎপরতা থেমে থাকেনি। এঁদেরই বলা হয় দুঃসহ দুঃখ-জ্বরা-কষ্টকে জয় করা সেই ব্যক্তিপুরুষ, যাঁদের আদর্শ চিরকাল অনুসরণযোগ্য।  

news24bd.tv/আইএএম