ইসলামে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচার উপায়

প্রতীকী ছবি

ইসলামে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচার উপায়

 সানা উল্লাহ মুহাম্মাদ কাউসার

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রণিধানযোগ্য কারণ হিসেবে পবিত্র কোরআনে আমরা দেখি যে মানুষের কর্মকাণ্ডের ফল হিসেবেই দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে আসে। যেমন : আল্লাহ বলেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের কারণে জলে ও স্থলে বিপর্যয় দেখা দেয়। যার ফলে আল্লাহ তাদের কিছু কিছু কৃতকর্মের ফল প্রদান করে থাকেন, যেন তারা পাপ থেকে ফিরে আসে। ’ (সুরা : রুম, আয়াত : ৪১)

অথচ আল্লাহ তাআলা নিজ গুণে মানুষের নানা ধরনের অপরাধ ক্ষমা করে দেন।

তিনি বলেন, ‘তোমাদের যে বিপদ-আপদ ঘটে তা তো তোমাদের কৃতকর্মের ফল এবং তোমাদের অনেক অপরাধ তিনি ক্ষমা করে দেন। ’ (সুরা : আশ-শুরা, আয়াত : ৩০)

পরিবেশবিজ্ঞানীদের মতে, দেশে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রধান কারণ হলো জলবায়ুর অনভিপ্রেত পরিবর্তনের মাধ্যমে পরিবেশের বৈরিতা। তাঁরা পরিবেশের এই বৈরিভাবের জন্য দায়ী করেন গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের প্রভাবকে। প্রশ্ন হলো, পৃথিবীর উষ্ণায়ন কেন হচ্ছে।

এই উষ্ণতা বাড়ার মূল কারণ গ্রিনহাউস গ্যাসের ইফেক্ট ও ঊর্ধ্বাকাশে ওজোনস্তরের ঘনত্ব কমে যাওয়া।
আঠারো শতকের শিল্প বিপ্লবের পর থেকে মানুষের ব্যবহার্য নানা যন্ত্রপাতি ও কলকারখানাগুলোকেই দায়ী করে বিজ্ঞান। এককথায়, মানুষের তৈরি করা প্রযুক্তির প্রত্যক্ষ কারণেই প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেয়। অর্থাৎ এখানেও মানুষরাই একমাত্র দায়ী।

পবিত্র কোরআনেও একই প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। সুতরাং আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য দায়ী করতে পারি মানুষের কর্মকাণ্ডকে আর উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে বলতে পারি :

১. বৈশ্বিক উষ্ণায়ন

শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেনসহ নানা গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হয়ে বাতাসে মিশছে। বায়ুমণ্ডলে এসব গ্যাস, কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের বার্ষিক গড় দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৪১০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন), ১৮৬৬ পিপিবি (পার্টস পার বিলিয়ন) ও ৩৩২ পিপিবি। ফলে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা আশঙ্কাজনক বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর ঠিক এই কারণেই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পতিত হয় পরিবেশ, যা কোরআনের ভাষ্যমতে স্বভাবতই মানুষের হাতে কামাই করা।

২. পাপকাজ বৃদ্ধি পাওয়া

বিজ্ঞানের অবিশ্বাস্য উন্নতির ফলে বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তিতে যথেষ্ট অগ্রগতি যেমন হয়েছে, তেমনি এর অনিয়ন্ত্রিত ও যথেচ্ছ ব্যবহার মানুষকে নানা ধরনের নতুন নতুন অপরাধে সংযুক্ত করছে। এমনকি নানা ধরনের পাপ-পঙ্কিলতা প্রয়োগ সহজ হওয়ায় অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে চুরি, ছিনতাই, ধর্ষণ, হত্যা, দুর্নীতি, জালিয়াতি, সুদ-ঘুষ ইত্যাদি ক্রমাগত বেড়েই চলছে।

দুর্যোগের রকমফের

ক. ভূমিকম্প, ভূমিধস, সুনামি : ভূমিকম্প সম্পর্কে কোরআনে যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় তা হলো, কোরআনে আরো আছে, ‘তারপর আমার ভূমিকম্প তাদের গ্রাস করে ফেলল। ফলে তারা তাদের নিজেদের গৃহেই মৃত অবস্থায় উল্টো হয়ে পড়ে রইল। ’ (সুরা : আল আরাফ, আয়াত : ৯১)

খ. ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি, বজ্রপাত : ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা কি নিশ্চিত রয়েছ যে তিনি তোমাদের পৃথিবীর কোথাও ভূ-গর্ভস্থ করবেন না কিংবা তোমাদের ওপর কঙ্কর বর্ষণকারী ঝোড়ো হাওয়া (ঘূর্ণিঝড়) প্রেরণ করবেন না? তখন তোমরা তোমাদের কোনো কর্মবিধায়ক পাবে না। ’ (সুরা : আল ইসরা, আয়াত : ৬৮)

গ. খরা বা অনাবৃষ্টি : বৃষ্টিপাত মানুষের প্রতি আল্লাহর রহমত। তিনি বলেন, ‘আর তিনি আকাশ থেকে বারি বর্ষণ করেন, তা দ্বারা তোমাদের জীবিকাস্বরূপ ফলমূল উৎপাদন করেন। ’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২২)

সুতরাং খরা তথা অনাবৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তির নমুনা।

ঘ. বন্যা, জলোচ্ছ্বাস : বন্যা এবং জলোচ্ছ্বাসও আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা পাপের শাস্তি। নুহ (আ.) এর অবাধ্য সম্প্রদায়ের ওপর বন্যার মতো আজাবের বর্ণনা এভাবে এসেছে, ‌‘তারপর মহাপ্লাবন ওদের গ্রাস করে। কেননা ওরা ছিল সীমা লঙ্ঘনকারী। তারপর আমি তাকে ও যারা জাহাজে উঠেছিল তাদের রক্ষা করলাম। ’ (সুরা : আনকাবুত : ১৪-১৫)

এ ছাড়া কোরআনে আরো এসেছে, ‘শেষ পর্যন্ত আমি এই জাতিকে পোকামাকড় বা পঙ্গপাল, উকুন, ব্যাঙ, রক্ত, প্লাবন ইত্যাদি দ্বারা শাস্তি দিয়ে ক্লিষ্ট করি। ’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৩৩)

ঙ. মহামারি : এ সম্পর্কে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হাদিস হলো, যখন কোনো কওমের মধ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে এবং তারা তা প্রকাশ্যেও করতে শুরু করে, তখন তাদের সধ্যে দুর্ভিক্ষ ও মহামারি ব্যাপক আকার ধারণ করে, যা তাদের পূর্ববর্তীদের মধ্যে ছিল না। (ইবনু মাজাহ, আস-সুনান, হাদিস : ৪০১৯)

চ. দুর্ভিক্ষ : মানুষ যখন অতিমাত্রায় পাপে নিমজ্জিত হবে এবং আল্লাহর নাফরমানি করবে, তখন নানা ধরনের আজাবের মধ্যে দুর্ভিক্ষও একটি আজাব হিসেবে আপতিত হবে। যেমন কোরআনে এসেছে, ‘ওর অধিবাসীদের আমি দুঃখ, দারিদ্র্য, রোগব্যাধি ও অভাব-অনটন দ্বারা আক্রান্ত করে থাকি। উদ্দেশ্য হলো, তারা যেন, নম্র ও বিনয়ী হয়। ’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৯৪)

প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচার উপায়

১. তাওয়াক্কুল করা

মুসলমানদের সর্বাবস্থায় আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল (ভরসা) রাখা উচিত। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। ’ (সুরা : তালাক, আয়ত : ৩)

২. ধৈর্য ধারণ করা

যেকোনো বিপদে ধৈর্য ধারণ করা মুমিনদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মহান রব বলেন, ‘আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফলফলাদির ক্ষতির মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও। ’ (সুরা : বাকারাহ,  আয়াত : ১৫৫)

৩. বেশি বেশি তাওবা ও ইস্তিগফার করা

তাওবা ও ইস্তিগফার সম্পর্কে কোরআনে এসেছে, ‘হে মুমিনরা, তোমরা আল্লাহর সমীপে খাঁটি তাওবা করো, এই আশায় যে তোমাদের প্রভু তোমাদের সব পাপ ক্ষমা করে দেবেন আর তোমাদের এমন উদ্যানসমূহে উপবিষ্ট করবেন, যার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত থাকবে। ’ (সুরা : আত-তাহরিম, আয়াত : ০৮)

৪. সদকা করা

সদকা সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, নিশ্চয়ই সাদকা অপমৃত্যু রোধ করে। (তিরমিজি, হাদিস : ৬৬৪; ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৩৩০৯)

অপমৃত্যু বলতে ওই সব মৃত্যুকে বোঝানো হয়েছে, যা থেকে স্বয়ং নবীজি (সা.) পানাহ চেয়েছেন। তা হলো ‘পানিতে পড়ে, আগুনে পুড়ে, ওপর থেকে পতিত হয়ে, যুদ্ধ থেকে পলায়নরত অবস্থায় বা এ ধরনের কোনো কারণে মৃত্যুবরণ করা। হঠাৎ মৃত্যুকেও কেউ কেউ অপমৃত্যু বলেছেন। (মেরকাত : ৪/১৩৪১)

৫. সচেতনতা অবলম্বন করা

ইসলামে সতর্কতা অবলম্বনের জন্য জোর তাগিদ প্রদান করা হয়েছে। বাড়ি-ঘরের আসবাব দেয়ালের সঙ্গে এমনভাবে হুক বা স্টিকার দিয়ে লাগিয়ে রাখতে হবে, যাতে ভূমিকম্পে সেসব গড়িয়ে না পড়ে, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দুর্যোগের সময় কে কোন দায়িত্ব পালন করবে- সেটা বণ্টন করে দিতে হবে, ফাস্টএইড বক্স, ফায়ার এক্সটিংগুইশার রাখাসহ সব সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘হে মুমিনরা, সতর্কতা অবলম্বন করো। ’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৭১)

মহান আল্লাহ আমাদের সব ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করুন, আমিন!

লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক গবেষক, টেকনাফ, কক্সবাজার।