ভুল স্বীকার না করে ইউনূস সেন্টারের দোষ ঢাকার চেষ্টা

ড. ইউনূসের ‘ট্রি অব পিস' নিয়ে মিথ্যাচার 

ভুল স্বীকার না করে ইউনূস সেন্টারের দোষ ঢাকার চেষ্টা

অনলাইন ডেস্ক

বিতর্ক যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের। শ্রমিক ঠকানোর মামলায় সাজাপ্রাপ্ত এই নোবেল বিজয়ীর বিরুদ্ধে এবার অভিযোগ উঠেছে পুরস্কারের রেপ্লিকাকে পুরস্কার হিসেবে বর্ণনা করার।

গতকাল বুধবার (২৭ মার্চ) পুরস্কার পাওয়া নিয়ে বিতর্ক তৈরির পর এবার ইউনূস সেন্টার থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, ‘প্রফেসর ইউনূসকে দেওয়া ‘‘ট্রি অব পিস’’ ২০১৪ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া একই ভাস্করের মতো। ’ 

এদিকে, আজ সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে ড. ইউনূসের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন ‘প্রতরণামূলক’ এই কাজকে ‘ভুল’ হিসেবে অভিহিত করে তার দায় চাপান ইউনূস সেন্টারের কর্মচারীর ওপর।

বুধবার শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান, ‘ইউনেসকো ড. ইউনূসকে এ ধরনের (ট্রি অব পিস) বা এই নামে কোনো পুরস্কার দেয়নি। ’ এর প্রেক্ষিতে বিষয়টি নিয়ে খোঁজ শুরু হয়।

বিতর্কের শুরু গত বৃহস্পতিবার (২১ মার্চ) ইউনূস সেন্টারের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে, যেখানে জানান হয়, একাদশ গ্লোবাল বাকু সম্মেলনের শেষ দিনে ড. ইউনূসের হাতে ‘দ্য ট্রি অব পিস’ সম্মাননা তুলে দেওয়া হয়। এ সম্মেলনে বিশেষ বক্তা হিসেবে ভাষণ দিয়েছেন তিনি।

সম্মেলনের আয়োজক ছিল নিজামি গনজভি ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার।

এদিকে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ইউনেসকোর ‘দ্য ট্রি অব পিস’ পুরস্কার পাওয়ার খবরটি সত্য নয় বলে জানিয়েছে ইউনেসকোর ঢাকা অফিস। বুধবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ ইউনেসকো জাতীয় কমিশন (বিএনসিইউ) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে। সেখানে এই ঘটনাকে ‘প্রতারণামূলক এবং পরিকল্পিত মিথ্যাচার’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, প্যারিসের ইউনেসকো সদর দপ্তর ড. ইউনূসের এই পুরস্কার পাওয়ার বিষয়ে একেবারেই অবহিত নয়।

আজারবাইজানের এনজিও নিজামি গনজভি ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের একটি উদ্যোগ ‘গ্লোবাল বাকু ফোরাম’। গত ১৫ ও ১৫ মার্চ এ ফোরামের একাদশ সভা হয় আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে। নিজামি গনজভি ট্রাস্ট পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ট্রাস্টগুলোর একটি। আয়োজনেও থাকে জাঁকজমক, অংশগ্রহণকারীদের দেওয়া হয় নানা সুযোগ-সুবিধা। এ কারণে নিজামি সেন্টারের আয়োজনে যোগ দেন বিশ্বের খ্যাতনামা অনেকেই।

এবারের একাদশ গ্লোবাল বাকু ফোরামে উপস্থিত ছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বর্তমান ও সাবেক মন্ত্রী, সরকারপ্রধান, রাজনীতিবিদ, এনজিও প্রতিনিধি, কবি, শিল্পী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সমাজসেবক প্রমুখ। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন নোবেলজয়ীও ছিলেন। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস, নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী কৈলাস সত্যার্থী, রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটসের প্রেসিডেন্ট কেরি কেনেডি।

নোবেল পুরস্কারজয়ী ড. ইউনূস সেখানে উপস্থিত থেকে বক্তব্যও রাখেন। সম্মেলনকালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেত্রেয়াসুস ও জাতিসংঘের অন্যতম আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল উইনি বিয়ানইমা, আজারবাইজানের প্রধানমন্ত্রী আলী আসাদভের সঙ্গে কুশল বিনিময়ও করেন ইউনূস।

ইসরায়েলি শিল্পী-ভাস্কর মিজ হেদভা সের ইউনেসকোর সাংস্কৃতিক কূটনীতির শুভেচ্ছাদূত। দ্য ট্রি অব পিস হলো হেদভা সেরের একটি ভাস্কর্য। শিল্পকর্মটি হলো গাছের ডালে আকাশের দিকে মুখ করে থাকা একটি পাখি, যা জাতিসংঘের শান্তির মূল্যবোধকে প্রকাশ করে।

বাংলাদেশে যেমন স্বাধীনতা পদকের ডিজাইন করা শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ব্যক্তিগতভাবে কাউকে তার ডিজাইনের রেপ্লিকা দিলে সেটিকে স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্তি হিসেবে প্রচার করা হলে প্রতারণা করা হবে, তেমনিভাবে ড. ইউনূসের এই কার্যক্রমকে অনেকে ‘ধূর্ততা’ বলে মন্তব্য করছেন। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখেন, যতবারই ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে কোনো আইনি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, ততবারই তিনি নানাভাবে আন্তর্জাতিক মহলকে সক্রিয় করতে চেষ্টা করেছেন।

উল্লেখ্য, দেশে বিচার বিভাগের মাধ্যমে আইনি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার চিঠিসহ আরও ৪০ জন বৈশ্বিক নেতাকে দিয়ে বিবৃতি বিজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করা হয়।

ড. ইউনূসের প্রতারণার বিষয়টি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে ইউনেসকোর ঢাকা অফিসের বিবৃতিতেও। বিএনসিইউ-এর ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল জুবাইদা মান্নানের সাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘সম্প্রতি ঢাকার কয়েকটি দৈনিক পত্রিকায় এবং ইউনূস সেন্টারের অফিসিয়াল ওয়েব পেজে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ইউনেসকোর কর্তৃক ‌‘ট্রি অব পিস’ পুরস্কার প্রদানের সংবাদটিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়াধীন বাংলাদেশ ইউনেসকো জাতীয় কমিশনের (বিএনসিইউ) দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। ইউনূস সেন্টার থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তির বরাত দিয়ে পত্রিকায় যে সংবাদ ছাপা হয়েছে, তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৬ মার্চ আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত ১১তম গ্লোবাল বাকু ফোরামে ড. ইউনূসকে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়। কিন্তু ইউনেসকো ঢাকা অফিস জানিয়েছে, প্যারিসে ইউনেসকো সদর দপ্তর এই বিষয়ে একেবারেই অবহিত নয়। ১১তম বাকু ফোরাম যেখানে এই সম্মাননা দেওয়ার সংবাদ প্রচার হয়েছে সেখানে ইউনেসকোর কোনো অফিসিয়াল প্রতিনিধিত্বই ছিল না। ’

এতে আরও বলা হয়, ‘ইউনূস সেন্টার কর্তৃক দাবিকৃত সম্মাননা ইউনেসকোর কোনো পুরস্কার বা সম্মাননাও নয়। ড. ইউনূসকে ‘ট্রি অব পিস’ নামক একটি ভাস্কর্য স্মারক বা সম্মাননা প্রদান করেন ইসরায়েলি ভাস্কর্য শিল্পী মিজ হেদভা সের। মিজ হেদভা নিজে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন যে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ‘ট্রি অব পিস’ প্রদানে ইউনেসকোর কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। নিজামি গনজভি ইন্টারন্যাশন্যাল সেন্টারের আমন্ত্রণে ইসরায়েলি ভাস্কর্য শিল্পী মিজ হেদভা সের ড. ইউনূসকে এটি প্রদান করেন। মিস হেদভা সের ইউনেসকোর সাংস্কৃতিক কূটনীতি বিষয়ক গুইউইল অ্যাম্বাসেডর, কিন্তু ইউনেসকোর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিনিধি নন এবং ইউনেসকোর কোনো পুরস্কার বা সম্মাননা দেওয়ার এখতিয়ার রাখেন না। ’

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘সুতরাং, উল্লিখিত বাস্তবতার নিরিখে বাংলাদেশ ইউনেসকো জাতীয় কমিশন ড. মুহাম্মদ ইউনূস পরিচালিত ইউনূস সেন্টার কর্তৃক পাঠানো এবং প্রচারিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং প্রতারণামূলক বলে মনে করে তার নিন্দা জানাচ্ছে। বাংলাদেশ ইউনেসকোর অন্যতম সক্রিয় সদস্য রাষ্ট্র। ভবিষ্যতে ইউনেসকোর মতো জাতিসংঘের এমন একটি মর্যাদাপূর্ণ এবং সুখ্যাতিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের নামের অপব্যবহার থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং ইউনূস সেন্টারকে সতর্ক করা হলো। এই বিষয়টি যেহেতু প্রতারণামূলক এবং পরিকল্পিত মিথ্যাচার সেহেতু তাদের বিরুদ্ধে কেন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে না তার ব্যাখা চাওয়া হবে। ’

অবশ্য এ বিষয়ে ড. ইউনূসের কোনো দোষ দেখছেন না তার আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন। উল্টো ড. ইউনূসের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত ইউনূস সেন্টারের 'ভুয়া পুরস্কার' পাওয়ার তথ্যের সমালোচনা করায় শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর সমালোচনা করেন তিনি। এই আইনজীবী 'ইউনেসকো তাকে (ড. ইউনূসকে) কোনো সম্মাননা দেননি' বলে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর বক্তব্যকে ‘দুঃখজনক‘ মন্তব্য করে বলেন, ‘ড. ইউনূস তো নিজেই সমুদ্র, তিনি কেন পুকুর চুরি করবেন। তাকে সম্মাননা দেওয়ার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা, ব্যক্তি উদগ্রীব থাকে। তাকে যে ভাষায় শিক্ষামন্ত্রী অপমান করেছেন তার নিন্দা করার ভাষা নেই। ’

নিজেদর অবস্থান ব্যাখ্যা করলেও তাদের পূর্বের বিবৃতি যে ভুল ছিলো, সেটি স্বীকার করে কোনো বিবৃতি প্রদান করেনি ইউনূস সেন্টার। বরং প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া পুরস্কার এবং ড. ইউনূসের পাওয়া পুরস্কার দেখতে একই রকম এবং একটি ব্যক্তিগত জিমেইল অ্যাকাউন্ট থেকে পাঠানো মেইল দেখিয়ে আরও একবার নিজেদের পূর্ববর্তী বক্তব্যের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে ইউনূস সেন্টার।

news24bd.tv/SHS