‘এই মুহূর্তে রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব রাষ্ট্রদ্রোহীদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ’

‘এই মুহূর্তে রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব রাষ্ট্রদ্রোহীদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ’

সেলিম মাহমুদ

জাতির পিতার প্রতি অবমাননাকারী রাষ্ট্রদ্রোহীদের আমি শুধু কঠোর শাস্তিই দাবি করছি না, রাষ্ট্রের মর্যাদা ও অস্তিত্বের স্বার্থেই এই নিকৃষ্ট নরপশুদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ 'Quarsive Power' অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রয়োগ করা উচিত। অপরাধের জন্য শাস্তি প্রয়োগ জুরিসপ্রুডেন্স তথা আইন বিজ্ঞানের একটি সনাতনী বিষয়। কিন্তু যখন কোনো ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠী স্বয়ং রাষ্ট্রের উপর আঘাত হানে, এটি তখন শুধু শাস্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। ন্যায় বিচারের সাধারণ নীতি এক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না।

রাষ্ট্রকে তখন নিবর্তনমূলক, প্রতিরোধমূলক ও আক্রমণাত্মক হতে হয়। আধুনিক আইন বিজ্ঞানের মূলমন্ত্রই এটি। বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর সকল দেশের লিগ্যাল সিস্টেম অর্থাৎ আইনি ব্যবস্থায়ই এই বিধান রয়েছে।

বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক এবং বাঙালি জাতির পিতা।

এই রাষ্ট্র তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ এক ও অভিন্ন সত্ত্বা। বঙ্গবন্ধুর উপর আঘাত মানে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উপর আঘাত, বাংলাদেশের অস্তিত্বের উপর আঘাত। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বে যারা বিশ্বাসী, তারা কখনো এই ধরণের কাজ করতে পারে না। এই ধরনের কাজ সবচেয়ে ঘৃণ্যতম রাষ্ট্রদ্রোহিতা। রাষ্ট্রদ্রোহী এই দুস্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে রাষ্ট্র তার Quarsive power অর্থাৎ শক্তি প্রয়োগ করার পাশাপাশি রাষ্ট্রের জনগণকে এই অপশক্তিকে মূলোৎপাটনের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, মূলত স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির কারণেই পঁচাত্তুরে সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়েছিল। তারপর দীর্ঘ তিন দশক খুনি চক্র আর তাদের সুবিধাভোগী গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার আর মিথ্যাচার করেছে। পনেরোই আগস্টের পর থেকে এই চক্র জাতির পিতার নাম মুছে ফেলার অপচেষ্টা চালিয়েছিল। তারা সফল হয়নি, কারণ জাতি বেঁচে থাকলে জাতির পিতাও বেঁচে থাকেন, রাষ্ট্র বেঁচে থাকলে রাষ্ট্রের জনকও বেঁচে থাকেন।  

কুষ্টিয়ার ঘটনা প্রমাণ করে, এই সমাজে জাতির পিতার হত্যাকারীরা এখনো বিচরণ করছে। এই হামলা পঁচাত্তুরের হামলারই এক নতুন সংস্করণ। এদের নির্মূল করতে হবে। ভাস্কর্য ইস্যুটা নিছক ধর্মীয়  অপব্যাখ্যার বিষয় ছিল না। আমরা অনেকেই এটিকে ধর্মান্ধতা বা ধর্মীয় কুপমণ্ডকতা হিসেবে দেখছি। আসলে এটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি সুগভীর ষড়যন্ত্র। রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অদম্য বাংলাদেশকে থামিয়ে দেওয়ার এক সুগভীর ষড়যন্ত্র এটি। জাতির পিতার নেতৃত্বে মুক্তি সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে বাংলাদেশকে বিচ্যুত করার এক ষড়যন্ত্র এটি। শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধাভোগী এই প্রজন্মের তরুণেরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সচিত্র দেখিয়ে দিলো যে, পৃথিবীর অধিকাংশ মুসলিম প্রধান দেশেই ভাস্কর্য রয়েছে।

আমরা দেখলাম, বহু আগে থেকেই এই সকল দেশ তাদের জাতীয় বীর এবং জাতীয়তাবাদী নেতাদের ভাস্কর্য নির্মাণ করে আসছে। আমার কাছে সেই সকল উদাহরণও গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, স্বাধীন বাংলাদেশের নিজস্ব সত্ত্বা রয়েছে। বাংলাদেশেই যুগ  যুগ ধরে ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে।   এই নিয়ে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী কখনো কোনো প্রশ্ন তোলেনি। মুজিব বর্ষে এসে হঠাৎ তারা এটি আবিষ্কার করলো ? 

আমাদের মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রের সকল আচার অনুষ্ঠানাদি রাষ্ট্রীয় সংবিধান এবং তার আওতাধীন বিধি বিধানের মাধ্যমেই অনুষ্ঠিত হয়। এই রাষ্ট্র কী এবং তার মালিকানা কার - এই বিষয়গুলো আমাদের সংবিধানে পরিস্কারভাবে উল্লেখ রয়েছে।

অনেকেই ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসছেন খণ্ডিত ভাবে। জাতির পিতা আমাদের যে সংবিধান আর আইন ব্যবস্থা দিয়ে গেছেন, সেটি সহজাতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ। সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। সংবিধানে আলাদাভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা যদি বলা নাও থাকতো, তাহলেও এই রাষ্ট্র সবসময়ই ধর্মনিরপেক্ষ। কারণ বঙ্গবন্ধুর দেওয়া সংবিধান অনুযায়ী আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো জনগনের সার্বভৌমত্বের  (Sovereignty of People) উপর প্রতিষ্ঠিত। এর আইনি ব্যবস্থা এবং কাঠামোও একই ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। আবার, পৃথিবীর কিছু কিছু দেশের আইনি ব্যবস্থা মুলত ধর্মভিত্তিক যাকে 'divine law' বলা হয়। এই ধরনের আইনি ব্যবস্থা ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের (Sovereignty of God) নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। আমাদের সংবিধান ও আইনি ব্যবস্থায় এই ধরনের ব্যবস্থার কোনো সুযোগ নেই। এছাড়া, বঙ্গবন্ধু প্রণীত সংবিধানের প্রস্তাবনায় এবং পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা কর্তৃক সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের প্রস্তাবনায় ধর্মনিরপেক্ষতার বিধান পুন:অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় সংবিধান সহ অন্যান্য আইনে যা-ই থাকুক না কেন, রাষ্ট্র পরিচালনা সহ অন্যান্য সকল প্রাসংগিক ক্ষেত্রে ধর্মীয় আইনের কোনো বিধান প্রযোজ্য হবে না।

কারণ  প্রস্তাবনা হচ্ছে সংবিধানের হৃদপিন্ড। প্রস্তাবনার সাথে সংবিধানের অন্যান্য বিধান এবং অপরাপর আইনের সাথে কোন বিরোধ দেখা দিলে প্রস্তাবনার বিধান প্রাধান্য পাবে।

আমাদের আইন ব্যবস্থা অনুযায়ী ধর্মীয় বিধান শুধুমাত্র personal law বা ব্যক্তিগত আইনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অর্থাৎ সম্পত্তির উত্তরাধিকার, বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ, ভরণপোষন, অভিভাবকত্ব ইত্যাদি ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধান প্রযোজ্য। এর বাইরে দেশে প্রচলিত অন্যান্য কোনো  আইনে ধর্মীয় বিধান নেই। গুটি কয়েক স্বাধীনতা বিরোধী দুষ্কৃতিকারী আজকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে সেটি পরিস্কার ভাবে রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক অপরাধ। তারা একদিকে ইসলামী আইনের অপব্যাখ্যা দিচ্ছে।

অন্যদিকে রাতের অন্ধকারে রাষ্ট্রের উপর আঘাত করছে। আসলে ধর্মীয় অপব্যাখ্যার বিষয়টি একটি আবরণ মাত্র। প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সৃষ্ট রাষ্ট্র বাংলাদেশের উপর আঘাত করা যেটি তারা পঁচাত্তুরের আগস্ট থেকে শুরু করেছিল।

আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে, এই হামলায় বিএনপি-জামাতের ষড়যন্ত্র আছে। বাংলাদেশের উপর এই আঘাত আমরা মেনে নেবো না। জাতি হিসেবে পঁচাত্তুর থেকে পিতৃহত্যার কলংকের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছি আমরা। হাজার বছর পরও এই কলঙ্ক মোচন হবে কিনা আমার জানা নেই। এর মধ্যে পিতার জন্ম শতবার্ষিকীতে পিতার উপর এই আঘাতে আমাদের  হৃদয়ে নতুন করে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। এই রক্তক্ষরণ কিছুতেই থামছে না। কোনো কিছুতেই না। তবে সারা দেশে নতুন প্রজন্ম আজ যেভাবে জেগে উঠেছে, তাতে আমি আশাবাদী। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে, শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশে আজ নতুন প্রজন্ম প্রযুক্তির বদৌলতে সব তথ্য জানতে পারছে। পঁচাত্তুরের খুনি চক্র আর তাদের সুবিধাভোগী ও লিগেসি বহনকারী দুষ্টচক্রের ইতিহাস বিকৃতি আর মিথ্যাচারের দিন শেষ। এই বিষয়ে বাইবেলের একটি ভার্স অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

সেখানে বলা হচ্ছে, "ye shall know the truth and the truth shall make you free."  অর্থাৎ একদিন তুমি সব সত্য জানতে পারবে এবং সেই সত্যই তোমাকে মুক্তি দেবে"। আমার বিশ্বাস, ষড়যন্ত্রকারীদের বিষ দাঁত আমরা ভেঙে দেব ইনশাল্লাহ।

আরও পড়ুন: শেখ হাসিনার রাষ্ট্রে মাস্তানী চলে না

পৃথিবীর দেশে দেশে রাষ্ট্রবিরোধী গোষ্ঠী বিভিন্ন সময় এই ধরণের ভাস্কর্যের উপর হামলা চালিয়েছিল। কারণ দুস্কৃতিকারী ও রাষ্ট্রবিরোধী চক্র পৃথিবীর অনেক দেশেই আছে। জাতীয় বীরদের ভাস্কর্যসহ সকল ঐতিহাসিক স্থাপনা ও সম্পদ রক্ষার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭৪ সালে Veterans Memorial Preservation Act প্রণীত হয়। ভারতে ১৯৭১ সালে অনুরূপ আইন
The Prevention of Insults to National Honour Act প্রণীত হয়। রাষ্ট্রবিরোধী এই রকম গোষ্ঠী গত বছর ভারতের উত্তর প্রদেশে ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী এবং ভারতের সংবিধান প্রণেতা ড۔ অম্বেদকরের ভাস্কর্যে রাতের অন্ধকারে হামলা চালানো হয়েছিল। আমাদের দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী জাতির পিতার ভাস্কর্যের উপর হামলার মতো অপরাধ রাষ্ট্রদ্রোহিতা মূলক অপরাধ। এই ধরনের অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে।

লেখক: সেলিম মাহমুদ, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

news24bd.tv তৌহিদ

সম্পর্কিত খবর