নিজের টিপ খুলে একজনের কপালে সেঁটে দিলেন

নিজের টিপ খুলে একজনের কপালে সেঁটে দিলেন

Other

টুকরো মিষ্টি স্মৃতি।

মিতা হক প্রয়াত হয়েছেন ১১ই এপ্রিল। রবীন্দ্রসঙ্গীতে আমাদের কালের গায়িকাদের মধ্যে অত্যন্ত সমাদৃত তিনি। ওঁর বড় কাকা ও সঙ্গীতগুরু ওয়াহিদুল হককে কেন্দ্র করে শিষ্যশিষ্যা-গুণগ্রাহীদের পরিম-লে, ছায়ানটের অঙ্গনে, রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের উদ্যাগ-আয়োজনে দেখাসাক্ষাতের বেশি আমাদের পরিচয়ের গ-ি বড় হয়নি।

তবে আমি বরাবরই ওঁর গানের মুগ্ধ শ্রোতা। খোলা সুরেলা গলা, গানের ভাব ঠিকমতো ফুটিয়ে তোলা  ও যথা স্বরস্থানে কণ্ঠ রাখায় নিষ্ঠা ও দক্ষতা আমাদের আকৃষ্ট করেছে।  

এক রকম লড়াই করে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী উদযাপন থেকে পরের কয়েক দশকে প্রধানত সন্জীদা খাতুন ও তাঁর সহযাত্রীদের নেতৃত্বে ছায়ানটকেন্দ্রিক বিপুল প্রচেষ্টায় আমাদের দেশে এক ঝাঁক গুণী শিল্পী তৈরি হয়ে খ্যাতি অর্জন করেছেন। মিতা তাঁদেরই একজন।

সাম্প্রতিক অনেক বছর তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। কয়েক বছর আগে ওঁর নিজের গড়া গানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সুরতীর্থর ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণে যাদুঘর মিলনায়নে আয়োজিত রবীন্দ্রনাথের ভাঙা গান নিয়ে অনুষ্ঠানটি নিবিষ্ট শ্রোতা হয়ে উপভোগ করেছি। মূল গান ও রবীন্দ্রনাথের গান পর পর শোনায় খুব উপকার হয়েছে।  

গান ছাড়া মিতার ব্যক্তিত্বের অকপট সরলতা ও অন্যকে আপন করে নেওয়ার মাধুর্য্য আমরা অনেকেই জেনেছি। টুকরো স্মৃতি থেকে দু'ট এখানে উল্লেখ করছি।  

একটি এক পয়লা বৈশাখের। আমাদের দুই কন্যার বয়স তখন এক বছরের সামান্য বেশি। আমার স্ত্রী পারুল ওদেরকে  কোলে-কাঁধে নিয়ে রমনার বটমূলে এসছি ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে। শেষ হলে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দিকটাতে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মিতা হকের সঙ্গে দেখা। হৈ হৈ করে উঠলেন যমজ কন্যা দেখে। অনেক আদর করলেন এবং ‘কী দেব কী দেব’ বলে নিজের টিপ খুলে একজনের কপালে সেঁটে দিলেন। সারাক্ষণ যেমন দু’হাত বাড়িয়ে বাবা-মার কোল বদল করে  একে-অন্যে দুষ্টুমি করছিল, তেমনই করতে লাগলো বেয়াদব দু’টো মিতা হককে না চিনে এবং ভ্রুক্ষেপ না করে।  

সেই টিপটা অনেক দিন ছিল আমাদের কাপড়ের আলমারিতে যত্নে রাখা। সময়ের প্রবহমানতায়, বাসা বদলের ঝক্কিতে কবে হারিয়ে গেছে। পরমা-উপমা এখন থাকে নাইরোবিতে। দেখলাম উপমা ১২ই এপ্রিল মিতার গাওয়া ‘মনে রবে কি না রবে আমারে’ গানটি ইউটিউব থেকে ওর ফেসবুক ওয়ালে রেখেছে।  

দ্বিতীয় গল্পটি আরও আগের। ১৯৮২-৮৪’র দিকে ওয়াহিদুল হক তাঁর মাকে নিয়ে হাতির পুলের কাছে একটি বাসায় থাকতেন। সকালে অনেকজন ছেলেমেয়ে আসতো গান শিখতে। ওয়াহিদ ভাইর আস্কারা পেয়ে আমি, সাপ্তাহিক একতার তরুণ সংবাদকর্মী,  কিছুদিন গিয়েছি আমার ব্যক্তিগত বাহন মোটরসাইকেল নিয়ে। এটা ক্লাস বসিয়ে টাকা-পয়সা নিয়ে গানের মাস্টারি না। ওয়াহিদভাই কখনো তা করেননি। গুরুপৃহের দ্বার অবারিত। যার খুশি আসছে, মাঝখানে কেউ বলে চলেও যাচ্ছে। গুরুর কাছে যে যতটুকু নিতে পারে। পরবর্তী সময়ে বিখ্যাত হয়ে ওঠা শিল্পী, সংস্কৃতিসেবী ও বুদ্ধিজীবীদের অনেককে সেখানে দেখেছি।

একদিন ওয়াহিদভাই উঠে ভেতরে গেছেন মায়ের কাছে। মিতার তখন কতই বা বয়স, ‘কানাই মাস্টার’ হয়ে ’বিড়াল ছানাদের’ এটা-ওটা বোঝাচ্ছে। আমি তখন বলে উঠি আমার একটা সমস্যা। বি-ফ্ল্যাটে গাইলে তারার ‘গা’ ছাড়িয়ে উঠতে কষ্ট হয়, ‘মা’-তেই গলা চিরে যায়। জি-শার্পে গাইতে চাই না, নিচের দিকে এলে খারাপ লাগে। মিতা বলে ঊঠলো, জোর করে কিছু গাওয়া যাবে না। স্বচ্ছন্দে যেটা হয়। ‘এ’ স্কেল দেখিয়ে বললো, ‘এখানে বেশ গাওয়া যায়। আমি অনেক গান এই স্কেলে গাই। ’ 

সাদা রিডে উদারার ‘সা’ ধরতে হয় বলে আমি ওই স্কেলে হাত বসাতেই পারিনি। স্কেল-চেঞ্জার হারমোনিয়াম সম্পর্কে তখন কোনো ধারনাই ছিল না। দেখিওনি। শিল্পীরা গান ও মিলনায়তনে শ্রোতার সংখ্যা অনুযায়ী স্কেল নির্বাচন করে গেয়ে থাকেন।
আমার গান শেখার প্রগলভতা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ওয়াহিদ ভাইর বাসার আসরগুলো কেবলই স্মৃতি। কিছু মিষ্টি স্মৃতি রেখে গেছেন মিতা হক। গান শুনিয়ে অগণিত শ্রোতাকে অনেক আনন্দ দিয়েছেন তিনি। রেকর্ডেও রেখে গেছেন। তাঁর গানের রেশ দীর্ঘস্থায়ী হবে। মিতা হকের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।

 

মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু: সিনিয়র সাংবাদিক

news24bd.tv/আলী