বন্ধু কথা এবং কিছু বিচ্ছিন্নতা

বন্ধু কথা এবং কিছু বিচ্ছিন্নতা

জসিম মল্লিক

আমি মাত্র অল্প কয়দিন আগে আমেরিকা থেকে ঘুরে এসেছি। সেটা ছিল ২০০০ সাল। এর অল্প কিছুদিন পরই ৯/১১ হয়েছিল। সেই ঘটনা পৃথিবীর যাবতীয় হিসাব নিকাশ পাল্টে দিয়েছিল।

সহজ জিনিস কঠিন হয়ে উঠেছিল। নিউইয়র্কে আমার কয়েকজন বন্ধু আমাকে বলল মল্লিক থেকে যা। দেশে গিয়ে কি করবি! আমি তাদের বললাম কিছুতেই আমি আমার সন্তানদের রেখে থাকতে পারব না। তখন বন্ধুরা বলল, একসময় ওরাও আসতে পারবে।
কিন্তু আমি যে এক মাসের জন্য ঘুরতে এসেছি তাতেই আমার ছোট্ট অরিত্রির জন্য মন কেমন করে। একদিনতো অরিত্রির জন্য কেঁদেছিলামও লুকিয়ে। মনে আছে  যখন জেসমিন আমাকে এয়ারপোর্টে নিতে আসল, অরিত্রিওকেও সাথে এনেছিল, তখন অরিত্রির বয়স পাঁচ বছর। গাড়ির মধ্যে আমাকে কেমন লাজুক চোখে দেখছে। যেনো ভাবছিল এই অপরিচিত মানুষটা কে! আমি কখনোই আমার সন্তানদের কাছে অপরিচিত হতে চাই নি।

আমি যে কখনো বিদেশে স্থায়ী হবো ভাবিনি। আমার অনেক কিছুই আকস্মিক। পূর্বাপর পরিণতি না জেনেই সিদ্ধান্ত নেই। কানাডা আসার সিদ্ধান্তটাও ছিল সে রকম আকস্মিক। দেশে থাকতে আমি কয়েকবার চাকরির প্রতি বিতশ্রদ্ধ হয়েছিলাম। এখানে এসেও হয়েছি। কোনো কিছু থেকে মন উঠে গেলে সেখানে আর থাকতে পারি না। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারি না। তারপরও জীবনে অনেক কিছুই ইচ্ছের বিরুদ্ধে করতে হয়। সেই রকম এক পরিস্থিতিতে হঠাৎ আমার মনে হলো বিদেশে চলে যাব। সবাইকে নিয়ে। কিন্তু উপায় জানি না। একদিন প্রেসক্লাবে এক আড্ডায় রাজা ভাই আমাকে বলল আমার এক বন্ধু আছে শাহ জহির ওর কাছে গেলে বুদ্ধি দিতে পারবে। আমি বললাম সে কি করে! রাজা বলল, কানাডার ইমিগ্রেশন করে। সাউথ ইষ্ট ইন্টারন্যাশনাল নাম। আমি বললাম ইমিগ্রেশন জিনিসটা আসলে কি! সবাই মিলে যাওয়া যায়? রাজা হেসে বলল হ্যাঁ যাওয়া যায়।


তাজমহল রোড। মোহাম্মদপুর। একদিন দুপুর। আমি অপেক্ষা করছি গেস্ট রুমে। একটু পর আমার ডাক পড়লো। আমি তার রুমে ঢুকলাম। দেখি ফর্সা টুকটুকে একজন মানুষ বসে আছেন। লোকটা বাঙ্গালি না অন্য দেশী ভেবে একটু দ্বিধায় পড়ে গেলাম। মনে মনে ভাবলাম কানাডা যাব বাংলা বলাটা রিস্ক হতে পারে। হয়ত প্রথম সাক্ষাতেই বাতিল হয়ে যেতে পারি। আমি ইংরেজীতে বললাম, আপনার বন্ধু রাজা আমাকে পাঠাইছে। আমি কানাডার ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে সে পরিষ্কার বাংলায় বলল, হুম রাজা আপনার কথা বলেছে আমাকে। তখন আমি নিশ্চিত হলাম মানুষটি বাঙ্গালি। সেদিন বেশ ভালোই কথাবার্তা হলো। আমার রেজুমি এ্যাসেসমেন্ট করে কানাডায় আবেদন করার ব্যাপারে গ্রীন সিগন্যাল পাওয়া গেলো। এরপর অপেক্ষা। এই অন্তবর্তীকালীন সময়ে আমরা বন্ধু হয়ে গেলাম। আমাদের প্রায় প্রতি বৃহষ্পতিবার রাতে দেখা হয় হোটেল সোনার গাঁওয়ের বলরুমে। কখনো কখনো অফিসে। মাঝখানে একটা পরিবর্তন ঘটাতে হলো। সেটা হলো আমার ফাইল নয়াদিল্লী থেকে ট্রান্সফার করে লসএঞ্জেলেস পাঠানো হলো। সময় কম লাগবে তাই। সত্যি বলতে কি যেখানে পাঁচ বছর লেগেছে অন্যদের সেখানে আমার দুই বছরের মধ্যেই হয়ে গেছিল ইমিগ্রেশন।


আমি ইন্টারভিউ দিতে গেলাম লসএঞ্জেলেস। উঠলাম বন্ধু পিয়ালের বাসায়। সেটা ছিল ২০০৩ সালের ফ্রেব্রুয়ারী মাস। ইন্টারভিউতে আমি কোয়ালিফাই করলাম। এদিকে জেসমিন আর ছোট্ট অরিত্রি বেঁকে বসল। তারা বিদেশে যাবে না। অরিত্রি তার স্কালাষ্টিকার বন্ধুদের রেখে কিছুতেই যেতে পারবে না। কিন্তু আমি বাংলাদেশ ছাড়তে চাই। আমার ভিতরে এক ধরণের একগুঁয়েমি আছে। যা ভাবি তা করতে হবে। সে বছর জুন মাসে চলে আসলাম কানাডা। অটোয়ায় এক বছর থেকে টরন্টো চলে আসলাম। এরপর কানাডায় পাঁচবছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে কিন্তু শাহ জহিরের সাথে কোনো যোগাযোগ হয় না। কানাডা আসার পর একবার ফোন করে জানতে চেয়েছিল আমি কেমন আছি। সব ঠিকঠাক আছে কিনা। ক্লা্ইন্টদের প্রতি একটা দ্বায়িত্ববোধ থেকে এটা সে করে। কিন্তু আমিতো তার বন্ধুও।


সে একটু ভিন্ন টাইপ মানুষ। আপনজনদের প্রতি তার অভিমান তীব্র। আমি মানুষের মন নিয়ে অনেক চর্চা করি। গত পনেরো বছরে আমাদের মধ্যে কয়েকবার মান অভিমান ঘটেছে। কিন্তু যখনই আমি সামনে যাই সে সব ভুলে যায়। কানাডা আসার পাঁচ বছর পর যখন একদিন গুলশান ক্লাবে আমাদের দেখা হলো সে তার ভূবন ভোলানো হাসি দিয়ে বলল কিরে মল্লিক! আয়। যেনো হারানো বন্ধু আবার ফিরে পাওয়া। আমার অবজারভেশন থেকে কিছু ব্যাপার বুঝতে পারি। প্রকৃতি আমাকে বুঝতে সাহায্য করে। বন্ধুত্ব অনেক কিছু দিতে পারে। আমরা বিশ্বস্ততা এবং স্মৃতির এমন সব স্তর পার করেছি যে আমাদের উপলব্ধি অনেক সুদৃঢ়। মানুষকে কাছে টানার এক আশ্চর্য ক্ষমতা আছে জহিরের মধ্যে। আপাতঃ তাকে একটু আত্মকেন্দ্রিক মনে হলেও তার বন্ধুত্ব অসাধারণ ও আকর্ষনীয়।  
টরন্টো, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৫

(স্মৃতির নির্জনতা গ্রন্থ থেকে। প্রকাশক অনন্যা। প্রকাশকাল ২০১৬ একুশের গ্রন্থমেলা)

লেখক: জসিম মল্লিক, সাংবাদিক, কানাডা

( সোশ্যাল মিডিয়া বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )

news24bd.tv/আলী