বাড়তি করের চাপে আবাসন খাতে 'ধসের শঙ্কা'  

প্রতীকী ছবি

বাড়তি করের চাপে আবাসন খাতে 'ধসের শঙ্কা'  

অনলাইন ডেস্ক

আয়কর আইন ২০২৩-এর আওতায় উৎসে কর বিধিমালা জারি করে দেশের সব এলাকার প্লট, ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্ট এবং বাণিজ্যিক স্থাপনার ‘গেইন’ কর দ্বিগুণ করা হয়েছে। ‘প্রযোজ্য’ হারে বাড়ানো হয়েছে উৎসে কর। এই  অতিরিক্ত করের চাপে আবাসন খাতে ধস নামতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন।

আবাসন খাতের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ‘রাজস্বের মারপ্যাঁচে নিবন্ধন ব্যয় ক্ষেত্রবিশেষে ২৪ গুণ হয়েছে।

নিবন্ধন খরচ এখন ইতিহাসের সর্বোচ্চ।

অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলেছেন, বাড়তি কর শেষ পর্যন্ত ক্রেতার ঘাড়ে চাপবে। এতে প্লট-ফ্ল্যাটের দাম বাড়বে। অনেকের পক্ষে এত দামে প্লট-ফ্ল্যাট কেনা সম্ভব হবে না।

আবাসন খাতে ধস নামবে। ’

চাকরি শেষে এককালীন টাকা পেয়ে চট্টগ্রাম শহরে একটি প্লট বা ফ্ল্যাট কেনার পরিকল্পনা করেও উঁচু কর হারের কারণে পিছিয়ে যান মো. রউফ। তিনি বলেন, ‘জীবনের শেষ সঞ্চয় দিয়ে একটি প্লট বা ফ্ল্যাট কিনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কর যে হারে বেড়েছে প্লট-ফ্ল্যাটের দাম অনেক। এত টাকা আমার নেই। ’

কাজী সৌরভ একজন তরুণ ব্যবসায়ী। গত কয়েক বছর ব্যবসা ভালো হওয়ায় এ বছর রাজধানীতে জমি কেনার কথা ভেবেছিলেন। হঠাৎ জমি-নিবন্ধনে উৎসে কর ২৪ গুণ হওয়ায় মো. রউফের মতো তিনিও এ চিন্তা বাদ দিয়েছেন।

নিবন্ধন-কর সবচেয়ে বেশি গুনতে হবে রাজধানীর গুলশান, বনানী, মতিঝিল, দিলকুশা, নর্থ সাউথ রোড, মতিঝিল সম্প্রসারিত এলাকা ও মহাখালী এলাকার স্থাবর সম্পত্তির মালিকদের। এসব এলাকায় সম্পত্তি কিনলে ক্রেতাকে জমি, ফ্ল্যাট বা স্থাপনা নিবন্ধনের জন্য কাঠাপ্রতি দলিল-মূল্যের ৮ শতাংশ বা ২০ লাখ টাকার মধ্যে যেটি বেশি সেটি গুনতে হবে, যা সম্পত্তি-কর হিসেবে সর্বোচ্চ।

আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা বলেন, ‘বাড়ি বানাতে বেশিরভাগ ক্রেতা তিন বা চার কাঠার প্লট কেনেন। কেউ কেউ ব্যবসার প্রয়োজনে আট বা দশ কাঠা জমিও কেনেন। প্রতি কাঠা জমির দাম ৪০ লাখ টাকা হিসাবে তিন কাঠার একটি প্লটের দাম হয় এক কোটি ২০ লাখ টাকা। দলিলে প্রতি কাঠার দাম ১৫ লাখ টাকা লেখা হলে তিন কাঠা জমির দাম হয় ৪৫ লাখ টাকা। নিবন্ধন খরচ হবে কাঠাপ্রতি দলিল-মূল্যের ৮ শতাংশ বা ২০ লাখ টাকার মধ্যে যেটা বেশি সেটা। কাঠাপ্রতি ২০ লাখ টাকা হিসাবে শুধু কর বাবদ খরচ হবে ৬০ লাখ টাকা। এটা কি বাস্তবসম্মত?’

আবাসন খাতের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)-এর সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন (কাজল) বলেছেন, ‘নতুন বিধানে প্লট-ফ্ল্যাট কিনতে খরচ কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। কয়েক বছর ধরে নিবন্ধন-ব্যয় কমানোর দাবি করছি, কিন্তু তা হয়নি। ’ প্রধানমন্ত্রীর কাছে জাতীয় বাজেটে আবাসন খাতের জন্য নেওয়া ব্যবস্থা বদলের দাবি জানান তিনি।

বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপারস অ্যাসোসিয়েশন (বিএলডিএ)- এর সভাপতি ও বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতেও প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ হার কমানোর দাবি জানানো হয়েছে।

চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘নতুন বিধিমালা অনুযায়ী দেশের যেকোনো এলাকায় স্থাবর সম্পত্তি বা জমি ও ফ্ল্যাটের মালিকানা হস্তান্তরে এলাকাভেদে ২৪ গুণ বা বেশি কর গুনতে হবে। ক্রেতাকে জমি, ফ্ল্যাট বা স্থাপনা নিবন্ধনের জন্য শুধু কর হিসেবেই কাঠাপ্রতি ৩ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হবে। আগে ছিল ১৬৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা।

২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন এলাকার জমি, জমিসহ বাড়ি, স্থাপনা, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট অথবা ফ্লোর স্পেস হস্তান্তরে কর ছিল দলিলমূল্যের ৪ শতাংশ। কিন্তু ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে হয়েছে দলিল-মূল্যের ৮ শতাংশ অথবা এলাকাভেদে কাঠাপ্রতি বিশ লাখ, বার লাখ, দশ লাখ, আট লাখ, ছয় লাখ বা তিন লাখ টাকা। এলাকাভেদে কোথাও কর ২৪ গুণের বেশিও হয়েছে। ’

প্রসঙ্গত, আয়কর বিধিমালার ‘সম্পত্তি হস্তান্তর হতে কর আদায় শীর্ষক’ ৬ নম্বর ধারা অনুসারে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় সম্পত্তি-নিবন্ধন কর ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮ শতাংশ করা করা হয়েছে। গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বাইরের এলাকা ও জেলা সদরের পৌর এলাকায় এ কর ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের যেকেনো পৌরসভার আওতাধীন সম্পত্তি-কর ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪ শতাংশ এবং বাকি এলাকায় ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২ শতাংশ করা হয়েছে। কোন এলাকার কত নিবন্ধন-কর রাজধানীর গুলশান, বনানী, মতিঝিল, দিলকুশা, নর্থ সাউথ রোড, মতিঝিল সম্প্রসারিত এলাকা ও মহাখালী এলাকায় নিবন্ধন-কর প্রতি কাঠায় দলিল-মূল্যের ৮ শতাংশ বা ২০ লাখ টাকার মধ্যে যেটি বেশি সেটি। কারওয়ান বাজার এলাকায় দলিল-মূল্যের ৮ শতাংশ বা ১২ লাখ টাকার মধ্যে যেটি বেশি সেটি; চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ ও সিডিএ এভিনিউ এলাকায় দলিল-মূল্যের ৮ শতাংশ বা ৮ লাখ টাকার মধ্যে যেটি বেশি; নারায়ণগঞ্জ, ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, বাড্ডা, সায়েদাবাদ, পোস্তগোলা ও গেন্ডারিয়া এলাকায় দলিল-মূল্যের ৮ শতাংশ বা ৮ লাখ টাকার মধ্যে যেটি বেশি; ঢাকার উত্তরা, সোনারগাঁও, জনপথ, শাহবাগ, পান্থপথ, বাংলামোটর ও কাকরাইল এলাকায় দলিল-মূল্যের ৮ শতাংশ বা ১২ লাখ টাকার মধ্যে যেটি বেশি এবং ঢাকার নবাবপুর ও ফুলবাড়িয়া এলাকায় দলিল-মূল্যের ৮ শতাংশ বা ৬ লাখ টাকার মধ্যে যেটি বেশি। জমিতে যদি কোনো স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্লোর স্পেস থাকে তাহলে প্রতি বর্গ মিটারে ৮০০ টাকা হারে অথবা ওই স্থাপনা, বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট অথবা ফ্লোর স্পেসের দলিল-মূল্যের ৮ শতাংশের মধ্যে যেটি বেশি তার হারে অতিরিক্ত কর প্রযোজ্য হবে। ঢাকার উত্তরা (সেক্টর ১-৯), খিলগাঁও পুনর্বাসন এলাকা, আজিমপুর, রাজারবাগ পুনর্বাসন এলাকা ও চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ, হালিশহর, পাঁচলাইশ ও নাসিরাবাদ-মেহেদিবাগে দলিল-মূল্যের ৮ শতাংশ বা ৩ লাখ টাকার মধ্যে যেটি বেশি, ঢাকার বনানী ডিওএইচএস, ধানম-ি, বারিধারা ডিওএইচএস, মহাখালী ডিওএইচএস, নিকেতন ও বারিধারায় দলিল-মূল্যের ৮ শতাংশ বা ১ লাখ টাকার মধ্যে যেটি বেশি এবং ঢাকার রাজউক পূর্বাচল আবাসিক মডেল টাউন, বসুন্ধরা ও ঝিলমিল আবাসিক এলাকায় দলিল-মূল্যের ৮ শতাংশ বা ৩ লাখ টাকার মধ্যে যেটি বেশি তা দিতে হবে। ঢাকার উত্তরা, নিকুঞ্জ, বাড্ডা পুনর্বাসন এলাকা, গে-ারিয়া পুনর্বাসন, শ্যামপুর পুনর্বাসন, আইজি বাগান ও টঙ্গী এলাকায় দলিল-মূল্যের ৮ শতাংশ বা ১ লাখ ২০ হাজার টাকার মধ্যে যেটি বেশি; ঢাকার শ্যামপুর, পোস্তগোলা শিল্প এলাকা ও জুরাইন শিল্প এলাকায় দলিল-মূল্যের ৮ শতাংশ বা ১ লাখ টাকার মধ্যে যেটি বেশি; ঢাকার খিলগাঁও ও রাজারবাগ পুনর্বাসন এলাকায় দলিল-মূল্যের ৮ শতাংশ বা দেড় লাখ টাকার মধ্যে যেটি বেশি এবং ঢাকার গোড়ান ও হাজারীবাগ ট্যানারি এলাকায় দলিল-মূল্যের ৮ শতাংশ বা ৬০ হাজার টাকার মধ্যে যেটি বেশি।

এই রকম আরও টপিক