‘লাভজনক’ কাচুবাদাম চাষে ঝুঁকছে পাহাড়ের মানুষ

‘লাভজনক’ কাচুবাদাম চাষে ঝুঁকছে পাহাড়ের মানুষ

অনলাইন ডেস্ক

জলবায়ু পরিবর্তন, মাটির উর্বরতা হ্রাস, একই জমিতে পুনঃপুন চাষ এবং ফসলের উন্নত জাত ব্যবহার না করার ফলে জুমভিত্তিক চাষাবাদ-নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসছেন পাহাড়িরা। অন্যদিকে, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, উৎপাদিত পণ্য বিক্রির ‘সহজ’ বাজার তৈরি, লাভজনক ফল-ফসলের ব্যাপক ফলন, প্রাচীন বদ্ধমূল ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে বান্দরবানসহ দেশের সব পাহাড়ি এলাকায়।

সেখানকার উদ্যোক্তারা সনাতন পদ্ধতির জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল না থেকে আধুনিক ও ‘লাভজনক’ কৃষি ফসলের দিকে ঝুঁকছেন। তেমনই একজন ওয়াজেদুল ইসলাম মবিন।

মবিন ও তার তিন বন্ধু মিলে বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইসারি ইউনিয়নে ১০০ একর জমিতে ‘কাজু অ্যান্ড কফি এগ্রো’ গড়ে তুলেছেন।

মবিন বলেন, ‘এক সময় চিন্তা করতাম পাহাড়ে নতুন কী করা যায়। পরে চিন্তা করলাম বাংলাদেশে যেহেতু কাজুবাগান নেই এটা নিয়ে একটু ট্রাই করি। আমরা নিজেরা ছয় হাজার চারা লাগালাম।

পরবর্তী সময়ে সরকারের প্রকল্প থেকে আরো আট হাজার চারা পাইলাম। আমাদের চারার গ্রোথগুলো খুব ভালো। সেগুলোতে ফুল ও ফল খুব ভালো হয়েছে। বাগান থেকে আমরা ফল পাইছি। তবে, এবার আমরা সেই বাগানে সাথী ফসল হিসেবে কফির গাছ লাগাইছি। ’

বাগানে কম্বোডিয়ান এম টুয়েন্টি থ্রি জাতের চারা লাগানো হয়েছে। এই জাতের কাজু বাদাম সব চেয়ে উন্নত এবং মজাদার। প্রকল্পের সব চারা কম্বোডিয়ান এম টুয়েন্টি থ্রি জাতের বলে তার ভাষ্য।

তিনি আরো বলেন, ‘চারা লাগানোর জন্য সার প্রকল্প থেকে দেওয়া হইছে, পাশাপাশি দুটি সোলার প্যানেলের মাধ্যমে গভীর নলকূপ থেকে পানি তুলে ডিপ ইরিগেশনের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে গাছগুলোতে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। সেটাও প্রকল্প থেকে দেওয়া হয়েছে।

অপরদিকে, রাঙ্গামাটির সদর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরের গ্রাম শফিপুর গ্রামে ৪০ একর জমি বর্গা নিয়ে কাজু বাদাম বাগান করেছেন আসাদুল্লাহ। প্রায় তিন বছর আগে কয়েকজন উদ্যমী অংশীদারকে নিয়ে এই বাগান গড়ে তোলেন তিনি। এই কাজু বাগানের সরকারের প্রকল্প থেকে চার হাজারের মতো চারাও পেয়েছেন আসাদুল্লাহ। কিছু চারার গ্রোথ খুবই ভালো বলে জানান তিনি। বাগানটিতে প্রায় ৫-১০ জন কর্মী। আসাদুল্লাহ জানান, পাহাড়ে বাগান করার সবচেয়ে বড় ‘চ্যালেঞ্জ’ বাগান পরিষ্কার করা। সেজন্য তারা ৪০ হাজার টাকা সরকারি সহায়তাও পেয়েছেন তারা। বাগানে পানি দেওয়ার জন্য সরকারি ‘কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ’ প্রকল্প থেকে সোলার সেচপাম্পও দেওয়া হয়েছে। আগামীতে আরো সেচপাম্প দেওয়া হবে বলেও আশ্বাস পেয়েছেন আসাদুল্লাহ।

ইতোমধ্যে কাজু বাগানে ফল আসা শুরু করেছে বলে জানালেন আসাদুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘গত বছর বাগানে বেশ কিছু গাছে ফলন আসছে, এরপর আশা করতেছি ডিসেম্বর জানুয়ারি থেকে গাছে ফুল আসবে। এরপর এপ্রিল এবং মের দিকে বাদাম তোলা শুরু হবে। আশা করছি এ বছর বেশ কিছু গাছ থেকে ভালো ফল পাব। শহিদুল স্যারের সাথেও কথা হয়েছে, উনিও আগামীতে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা আশা করছি এই বাগানের কাজু বাদাম একদিন বিদেশে রপ্তানি হবে।

অন্যদিকে, শেরপুরের গারো পাহাড়ে এবার পরীক্ষামূলকভাবে উচ্চমূল্যের কাজু বাদামের চাষ হচ্ছে। ইতোমধ্যে এসব এলাকার বাগানগুলোর কাজু বাদাম পরিপক্ব হতে শুরু করেছে এবং চাষিদের মুখে হাসিও ফুটতে শুরু করেছে। ফলে সীমান্তের পাহাড়িদের মনে আশার আলো জেগে উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা ভাবছেন, অবহেলিত ও প্রত্যন্ত পাহাড়ি জনপদের অর্থনৈতিক চাকা ঘুরে যেতে পারে এ উচ্চমূল্যের কাজু বাদাম চাষে। ঝিনাইগাতী উপজেলার গজনি এলাকার বাগানের কৃষক সোলেমান বলেন, কৃষি বিভাগের এ পাইলট প্রকল্প হচ্ছে এ কাজু বাদাম চাষ। আমার বাগানে গতবছর থেকেই ফুল আসতে শুরু করে এবং এবার ফুল ও ফল হয়ে পাকতে শুরু করছে। আমার ৫০ শতক জমিতে ২০০ গাছ রয়েছে। আশা করছি আগামী বছর থেকে ফলন আরো বাড়বে এবং প্রতি গাছে প্রায় ১৫ থেকে ২০ কেজি করে বাদাম পাওয়া যাবে।

‘কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ’ প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) শহীদুল ইসলাম বলেন, ভবিষ্যতেও আমাদের এ ধরনের সহায়তা অব্যাহত থাকবে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ওয়াহিদা আক্তার বলেন, পাহাড়ে আগে থেকেই কিছু কিছু কাজুবাদাম চাষ হতো, কিন্ত পাহাড়ে এই ফলটির অপার সম্ভাবনার কথা ভেবে আমাদের কৃষিমন্ত্রী যখন একটা প্রকল্পের উদ্যোগ নেন। আমাদের আশা ছিল এই প্রকল্পের মাধ্যমে সেখানে কাজু বাদামের একটা বিপ্লব ঘটবে। বাস্তবেও তাই হয়েছে। এখন পাহাড়ের আশপাশে অনেক কাজুবাদামের প্রকৃয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে উঠেছে। ছোট-বড় শত শত উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। বর্তমানে সেখানে বিদেশ থেকে ‘র’ কাজুবাদাম প্রোসেস করে আবার বিদেশে পাঠাচ্ছে। কিন্তু আগামীতে দেশে এই কাজুবাদাম আনার প্রয়োজন হবে না। আমরাই করতে পারবো।

তিনি বলেন, আগামী এক দশকের মধ্যে এই কাজুবাদাম উচ্চমূল্যের ফসল হিসেবে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখবে। ইতোমধ্যে অনেক উদ্যোমী তরুণ কাজুবাদাম চাষ করে নতুন স্বপ্ন বোনা শুরু করেছেন, আগামীতে তা আরো ভালো হবে।