গাজীপুরে কিস্তির টাকা না পেয়ে ঘরে তালা দিলো এনজিও

ঋণগ্রহীতা শামীমা আক্তার ও তার সন্তান।

গাজীপুরে কিস্তির টাকা না পেয়ে ঘরে তালা দিলো এনজিও

নিজস্ব প্রতিবেদক

গাজীপুরের শ্রীপুরে চাকরি হারিয়ে এনজিও'র কিস্তি পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় ঋণ গ্রহীতার ঘরে তালা মেরে দিয়েছে আম্বালা ফাউন্ডেশন নামের এক এনজিওর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এখন স্বামী ও তিন সন্তান নিয়ে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে হচ্ছে ঋণগ্রহীতাকে।

বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে ঘরে তালা লাগানোর বিষয়টি জানতে পারেন ঋণ গ্রহীতা। গত বুধবার বিকেলে শ্রীপুর পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের চন্নাপাড়া গ্রামের ফকির বাড়ি জামে মসজিদ এলাকার বাসের সুপারভাইজার আলা উদ্দিন ও গার্মেন্টস্ শ্রমিক শামীমা আক্তারের ঘরে তালা লাগানোর ঘটনা ঘটে।

ঋণ গ্রহীতা শামীমা আক্তার (২৮) ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল থানার বৈলর ইউনিয়নের দেওয়ানিবাড়ি গ্রামের মোঃ আলা উদ্দিনের স্ত্রী। প্রায় ২০/২২ বছর আগে স্বামী আলা উদ্দিনের বাবা আবুল বাশার শ্রীপুরের চন্নাপাড়া গ্রামে জমি কিনে নিজ বাড়িতে বসবাস করে আসছেন। শামীমা পার্শ্ববর্তী ভিনটেজ ডেনিম লিমিটেড নামের একটি তৈরী পোষাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানে অপারেটর পদে চাকুরি করতেন। সম্প্রতি তিনি চাকুরি হারিয়েছেন।

স্বামী আলা উদ্দিন এনা পরিবহন বাসের সুপারভাইজার পদে কাজ করেন।

ঋণ গ্রহীতা শামীমা আক্তার জানান, গত বছরের মে-জুন মাসে মাসিক ৯ হাজার ৫০০ টাকা কিস্তিতে আম্বালা ফাউন্ডেশনের শ্রীপুর শাখা থেকে ১ লাখ টাকা ঋণ নেন তিনি। ঋণের টাকা প্রতি মাসেই যথা সময়ে পরিশোধ করে আসছিলেন। জানুয়ারি মাসে গার্মেন্টস্ থেকে চাকুরি হারিয়ে একদিকে ফেব্রুয়ারি মাসে ঋণের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হন তিনি, অপরদিকে শ্বাশুড়ি অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সংসারে সন্তানদের পড়ালেখার খরচ, অসুস্থ শ্বাশুড়ির চিকিৎসা সব মিলিয়ে চাকরি হারিয়ে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারেননি তিনি।

গত মঙ্গলবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) সকালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শ্বাশুড়িকে দেখতে ঘরে তালা দিয়ে হাসপাতালে যান। বৃহস্পতিবার বিকেলে ফিরে এসে ঘরের দরজায় দুইটি তালা দেখতে পেয়ে প্রতিবেশীরা এনজিও কর্মীরা তালা লাগিয়েছেন বলে জানান।

শামীমা বলেন, আমি যখন ১ লাখ টাকা ঋণ নিই, তখন আমাকে ৩২ হাজার নগদ টাকায় বাধ্যতামূলক ভাবে একটি সেলাই মেশিন ধরিয়ে দেয়া হয়। সবমিলিয়ে ঋণ বাবদ যাবতীয় খরচ ও সঞ্চয় বাদে আমাকে ১ লাখ টাকা স্থলে মাত্র ৫৮ হাজার টাকা দেয়া হয়। আমি তখন সেলাই মেশিন না নিতে চাইলে আমাকে ঋণ দেয়া হবে না বলে তিনি জানান। আমি ওই টাকায় একটি অটো রিকশা কিনে পরিচালনা করছি। প্রতি মাসের প্রথম বুধবার কিস্তি পরিশোধের কথা, আমার মাত্র এক মাস কিস্তির টাকা বকেয়া পড়েছে, তাই তারা (এনজিও কর্মীরা) আমার ঘরে তালা লাগিয়েছে। আমার যদি চাকুরিটা না যেতো তাহলে ঋণের টাকা বকেয়া পড়তো না, খেয়ে না খেলে আগে ঋণের টাকা পরিশোধ করেছি। আমি এখন আমার ৮ম শ্রেণী পড়ুয়া ১৫ বছরের মেয়ে শাহরিয়া আফরিন, মাদ্রাসার ছাত্র ১৩ বছর বয়সী ছেলে মো. মিনহাজ, ৬ বছর বয়সী ছেলে আলভিকে নিয়ে ঘরের সামনে বিকেল থেকে অপেক্ষা করছি। আমি তাদের সাথে যোগাযোগ করেছি, তারা বলে আমরাও কিস্তির জন্য আপনার ঘরের সামনে গিয়ে বসে থাকি আমাদের খুব কষ্ট হয়, এখন বুঝেন আমাদের কেমন লাগে!

শামীমার স্বামী আলা উদ্দিন বলেন, দুই জনের আয়ে মা-বাবা ও সন্তান নিয়ে কোন মতো চলতে হয়। এর মধ্যে মা অসুস্থ হয়ে পড়ায় এ মাসের কিস্তি বকেয়া পড়েছে। আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করেছি কিস্তি দিতে কিন্তু মা হাসপাতালে ভর্তি থাকায় দিতে পারিনি। তাই তারা আমার ঘরে তালা মেরে দিয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে আম্বালা ফাউন্ডেশন শ্রীপুর শাখার মাঠকর্মী কবির হোসেন বলেন, আমাদের লোনটা নিতে গেলে ১ লাখ টাকায় ১০ হাজার সঞ্চয় লাগে, ১ হাজার টাকা বীমা, আনুষঙ্গিক ২৬৫ টাকা খরচ আছে। আর জোর করে সেলাই মেশিন দেয়ার বিষয়টি হলো, যেদিন আমি ঋণ প্রস্তাব করি ওনিই আমাকে বলেছিল, এক লাখ টাকা লোন দিলে আমি একটি সেলাই মেশিন নিবো। পরদিন যখন স্যারেরা ভিজিট করে লোনটি বাদ দিতে যান তখন ওনিই আমাকে বলেন আমার লোনটা বাদ দিয়েন না। মেশিনটা আমাকে নগদ টাকা দিয়ে দেন। সেই শর্তে মেশিনটা দেয়া হয়েছে।

আর ঘরে তালা লাগানোর বিষয়ে তিনি বলেন, একটি ঋণের সদস্য যখন বাসায় থাকেন না তখন জামিনদারকে ধরবে এটাই স্বাভাবিক। আমি সবসময়ই তাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। কোন কল তারা ধরছিল না। আমরা গতকাল এসে তাকে বাসায় পাইনি। যাওয়ার সময় ঘরে জামিনদারের উপস্থিতিতে তালা লাগিয়েছি।

আরও পড়ুন: বেইলী রোডের কাচ্চি ভাইয়ে আগুন

কিস্তি না পেয়ে ঘরে তালা লাগানোর বিষয়ে আম্বালা ফাউন্ডেশনের শ্রীপুর শাখার ব্যবস্থাপক আশিকুল ইসলামের বক্তব্য চাওয়া হলে তিনি মাঠকর্মীর দেয়া বক্তব্য থেকে সরে আসেন। তিনি বলেন, এই একটা ছোট্ট বিষয় নিয়ে কি একটা বিরক্তিকর পরিস্থিতি মধ্যে আছি তা বলার মতো না। শামীমা আক্তারকে দেয়া লোনের কিস্তি সঠিক সময়ে আসছিল না। প্রতি মাসেই মুল কিস্তি থেকে ৫০০-১ হাজার টাকা কম দিতো। গত বুধবার সন্ধ্যার কিছু সময় আগে আমার মাঠ কর্মী কিস্তির টাকার জন্য তার বাসায় যায়। কিন্তু তাদের ঘরের দরজা খোলা থাকলেও তারা বাসায় ছিল না। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে তারা না আসায় আমরা তাদের আসার অপেক্ষা করছিলাম। সবশেষ রাতে আসার সময় ঋণের জামিনদারকে ডেকে এনে তার সামনেই ঘরে তালা লাগিয়েছি।

এ বিষয়ে জানতে আম্বালা ফাউন্ডেশনের এরিয়া ম্যানেজার টিটু চক্রবর্তীর সাথে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, কিস্তির দেয়ার কথা বলে কর্মকর্তাদের বসিয়ে রেখে বাড়ি থেকে চলে গিয়েছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানিক নিয়মে ঋণ খেলাপিদের বাড়িতে তালা লাগানোর নিয়ম নেই। এটা পরিস্থিতির শিকার।

এ বিষয়ে শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাহ্ জামান বলেন, এবিষয়ে কেউ থানায় আসে নি। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

news24bd.tv/ab

এই রকম আরও টপিক