আইনের তপোবন ও ডিন স্যার

আইনের তপোবন ও ডিন স্যার

হুসাইন ফজলুল বারী

আইনচর্চাটা আমার তেমন হয়না। রুটি-রুজির প্রয়োজনে পড়া আইনের বইগুলো যেনো পারিবারিক পছন্দে বিয়ে-করা হেঁসেলবাসি কোনো গেরস্ত বউ। সেজন্যই বুঝি আইনের প্রতি এতো অবহেলা। এর বিপরীতে লিটারেচার, হিস্ট্রি, ফিলজফি, থিয়জফি বা মুড়ির ঠোঙ্গার ছাপার অক্ষর পর্যন্ত মুগ্ধ বিস্ময়ে পড়ি।

এরা যেনো আমার গোপন শোকেসে রাখা আতরের-গন্ধমাখা চিরকালীন প্রেম।

বিশুদ্ধ বেকার অবস্হায় একবার চাকরির ইন্টারভিউতে গেলাম। আধো বাংলায় ড. হামিদা হোসেন জানতে চাইলেন, এতো বিষয় থাকতে কেনো আইন বিষয়ে পড়লাম। তাইতো, এটা তো কখনও ভাবিনি।

শুরুতে বেশ হচকচিয়ে গেলাম।

স্মৃতির মিনার ভেঙে ডুব দিই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। জারুলতলের ক্যাম্পাসে। সোনালু ফুলের বন্যায়- আইন অনুষদে! মুখরিত শাটল ট্রেনে আর ‘মউয়ের দোয়ানে’।

ইংরেজি আর আইনে চান্স পেলাম। ভাবলাম, ইংরেজি সাহিত্য পড়বো, শেক্সপিয়র, চসার বা এডগার এলান পো হয়ে যাবে আমার নিত্য সহচর। কী মজা! শেষমেষ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত শিক্ষক আ ন ম ওয়াহিদুর রহমান (দর্শন বিভাগ) বললেন, ইংরেজি বিভাগে কঠিন জট। প্রফেসর এম শাহ আলম একদল নিবেদিত তরুণ শিক্ষক নিয়ে আইন বিভাগ বেশ ভালো চালাচ্ছেন। আইন বিভাগে ভর্তি হও, ভালো করলে শিক্ষক হতে পারবে, নইলে জজ বা উকিল। আইনের পরিভাষা ও সংস্কৃতি মূলত: ইংরেজি। আইন একটা বিশেষায়িত জ্ঞান, এমনিতেই ইংরেজি পোক্ত হয়ে যাবে। কথাটা বেশ মনে ধরলো। আমার শিক্ষক বাবা সম্মতি দিয়ে আজ্ঞা দিলেন, আইন পড়বি-ভালো কথা, কিন্তু বেআইনি কোন কাজ করিসনা।

news24bd.tv

আমাদের চতুর্থ ব্যাচের অভিষেক। শিশু আইন বিভাগের কর্ণধার হিসেবে এম শাহ আলম স্যার মঞ্চে ছিলেন  সূর্যের মতো প্রদীপ্ত। ওইদিনই স্বপ্নচারী ছোটখাট মানুষটির  অনুপ্রেরণাদায়ী বক্তব্য শুনি। সেখানে প্রধান অতিথি হয়ে এলেন সাবেক উপাচার্য প্রফেসর আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজউদ্দিন। ডিন স্যারের কাছেই অবাক হয়ে আমরা জানলাম, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই ইতিহাসবিদ একজন ব্যারিস্টার এবং আইন গবেষক। মুসলিম আইন, শরিয়া, আইন সংস্কার বিষয়ে অতি সুপুরুষ এ স্যারের দুটি অসাধারণ গ্রন্থ অক্সফোর্ড হতে প্রকাশিত। আমাদের সতীর্থ এরশাদ উর্দু গজল গেয়ে আসরে মাদকতা ছড়িয়ে দিলো। খালেদ স্যার গাম্ভীর্য ভেঙে ‘ওয়ান মোর’ বলে হাঁক দিলেন। অপার্থিব সুরের মায়া শেষে কেউ একজন ‘বিপাশার চোখ’ আবৃত্তি করেছিলেন। নবীন সতীর্থরা ‘রাম গরুড়ের ছানা’ আবৃত্তি করলে পুরো অডিটোরিয়ামে হাসির ছোঁয়াচে আক্রান্ত হলো।   আমরা সবাই হাসছি- হি হি।    ক্লান্ত হয়ে আমরা পাহাড়ি পথ বেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনে উঠি।

আরো পড়ুন:


তিনি একজন অতি বিরল মানুষ


আইন অনুষদে আমাদের প্রথম বিষয় জুরিসপ্রুডেন্স বা আইনবিজ্ঞান।   বাবা নিউ মার্কেট থেকে একরাতে এনে দিলেন প্রখ্যাত আইনবিজ্ঞানী স্যামন্ড রচিত জুরিসপ্রুডেন্স। ছোটখাট একজন এ কে ফজলুল হক হবার স্বপ্নে-বিভোর আমি এ বই জড়িয়ে ধরে ঘুমাই। খুব ভোরে উঠে কয়েক পাতা উল্টিয়ে আগামাথা কিছু বুঝা তো দূরের কথা, বইয়ের নাম পর্যন্ত উচ্চারণও করতে পারছিনা। ইংলিশ-অবসেসড অভিমানি আমার বেশ অসহায় বোধ হয়।

সোনালি-জারুল-আর কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি মাড়িয়ে  আইনশিক্ষায় আমাদের শঙ্কিত পদযাত্রা শুরু। সময়নিষ্ঠ ডিন স্যার আমাদের দোতলার সেমিনার কক্ষে  স্মিতহাস্যে চকচকে দৃষ্টি নিয়ে হাজির। আমিও স্বপ্নের অঞ্জন চোখে মেখে  বইখাতা নিয়ে পড়িমরি করে ক্লাসে প্রবেশ করেছি।   স্যার চোখ গোল করে প্রসন্নমুখে সহজ ভাষায় নিজস্ব ঢংয়ে আইনবিজ্ঞানের কথা বলছেন। স্নেহমাখা কথামালার ঢেউ তুলে আমাদেরকে অলৌকিক ইস্টিমারের বসিয়ে যাত্রা শুরু করেন আইনের সায়রে। শুরুতে ঠিক বুঝে উঠতে পারিনা, স্যার কী বলছেন।   তবু  ঘুম-জড়ানো সকাল নয়টার ক্লাসে ব্যবহারতত্ত্বের মায়াবী জগতে আমাদের অভিষেক হয়েই গেলো। কে জানত, এমনি করে আমার মত এক কুণ্ঠিত আইন শিক্ষার্থী যাবজ্জীবন আইনের ইন্দ্রজালের cul de sac এ বাঁধা পড়বো। কখনও অনিচ্ছুক কোন সহপাঠী ক্লাসরুমে দেরি করে আসলে তিনি ভ্রু কুঞ্চিত করে হাহাকার করে উঠতেন, যেন তার সর্বস্ব নিলামে উঠছে কিংবা এই বুঝি তার রচিত হিরের রাজ্য  খান খান হয়ে ভেঙে পড়ছে। শাহ আলম স্যারের সেই  রহস্যপুরীর সেমিনারে সুবর্ণপ্রভা রথে চড়ে হাজির হতেন আইনের দিকপাল অস্টিন,বেনথাম, কেলসেন, মেকলে বা মন্টেস্কু প্রমুখ। ডিন স্যার এমন পরম মমতায় এদের নাম উচ্চারণ করেন যেনো এরা স্যারের কোনো প্রিয় স্বজন।   স্যারের স্বজন বলে  অমর সেই আইনবিদগণও হয়ে যান আমাদের একান্ত সুহৃদ।

news24bd.tv

ধীরে ধীরে আইনবিজ্ঞানের বিরস তত্ত্ব ডিন স্যারের কথামালার যাদুতে আকর্ষণীয় হয়ে উঠে। পায়ের আঙুলের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে যখন আইনের বিকাশ আর শাস্তির তত্ত্ব নিয়ে দেশ- বিদেশের কথা বলেন, স্যারকে মনে হয় আমাদের জেরেমি বেন্থাম। শ্রেণীকক্ষে কেউ অবান্তর প্রশ্ন করলেও খুশিতে টগবগ করে উঠেন, আমাদের আগ্রহকে প্রদীপের সলতের মত উস্কে দেন।   বিনয়ের অবতার হয়ে মাঝে মাঝে বলেন, আমি মনে হয় তোমাদের ঠিক বোঝাতে পারছিনা। এভাবে অনুরাগী শিক্ষার্থীরা সবক পাই-দখল, মালিকানা, স্বত্ব,শাস্তি, আইনের উৎস ও প্রকরণের।

একদিন হেমন্তের স্নিগ্ধ সকালবেলা বলা নেই কওয়া নেই ডিন স্যার ক্লাসে হাজির হলেন আমাদের পাঠ্যবই ‘দ্য লং ইকোজ’ নামক আকরগ্রন্থের রচয়িতা বদরুল হায়দার চৌধুরীকে নিয়ে। তিনি প্রধান বিচারপতি হিসেবে অবসর নিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করে অকৃতকার্য হয়েছেন সম্প্রতি। শিশুর মতো মুগ্ধদৃষ্টি নিয়ে স্যারসহ আমরা প্রিভেনটিভ ডিটেনশন নিয়ে বিচারপতি মহোদয়ের swangsong শুনি।

মাত্র গুটি কয়েক তরুণ শিক্ষকদেরকে নিয়ে স্যার তখন কণ্ব ঋষির নিষ্ঠা নিয়ে  নিস্তব্দ  পাহাড়ি তপোবনে ভালবাসার মালঞ্চ রচনায় ব্যস্ত। মুক্তিযোদ্ধা স্যারের কথা, কাজ, চিন্তায় দেশের প্রতি- মানুষের প্রতি আলাদা দরদ উথলে পড়ে।   সাবেক বিপ্লবী জাকির স্যার কালো চশমা পরে অনুষদে আসেন। তিনি রোমান আইন আর আইনের ইতিহাস পড়ান। বেশ কড়া শিক্ষক কিন্তু পড়ানোর স্টাইল মুগ্ধকর। সাবেক জজ মোর্শেদ স্যার পরিমিত বিন্যাসে মুসলিম আইন পড়ান। স্যার ঘড়ির কাটা ধরে ক্লাসে আসেন। মিতবাক এ স্যারের কথায় চট্টগ্রামের নোনাজলের ঘ্রাণ। তাঁর কাছে আমরা আগ্রহ নিয়ে পড়ি মুসলিম ফারায়েজ । স্যারের কন্ঠে আমরা শুনি, সোনালি যুগের আইনের  ক্রমবিকাশ,চার মযহাবের কথা, শিয়া-সুন্নির দ্বন্দ্বের আইনি বিশ্লেষণ। আমার কেনো যেনো একবার মনে হলো, ইমাম শাফীর আইনি ভাবনা অধিক সুবিন্যস্ত। নাছোড়বান্দা বনধু আকাশ তা কিছুতেই মানবেনা, ঝাড়া আধঘন্টার লেকচারে বুঝিয়ে দিলো, কেনো হানাফি স্কুল শ্রেষ্ঠতর। শিয়াদের মাঝে প্রচলিত পরিভ্রাজকের স্বল্পকালীন মুতা বিবাহের কথা শুনে আমাদের ইন্দ্রিয়পরায়ণ কারো কারো আক্ষেপ, শিয়াপন্থী হলে বুঝি বেশ হতো!

আরো পড়ুন:


রাজনৈতিক কর্মী যখন ছিঁচকে চোর


এদিকে বেলালের ভাঙ্গা ঝুপড়িতে উচ্ছাসি শিক্ষার্থীদের আড্ডা বসেছে। কেউবা ধুম্রজালে আচ্ছন্ন। কারা যেনো দলবেধে গিটার বাজিয়ে গান গাইছে, সংগে চায়ের কাপের ঝড়। কেউবা অপূর্ব দক্ষতায় টেবিলে তবলার সংগত দিচ্ছে। জানলাম- মূল শিল্পী পৃথুল যুবক- সৈকতদা। ওদিকে সোনালুফুল-ছাওয়া পথ মাড়িয়ে একদল তরুণী আমাদের মনে হাহাকার জাগিয়ে কোথায় যেনো চলে যাচ্ছে। আর আমি লাইব্রেরিতে ঢু মেরে দেখি- পাংশুমুখে নিমগ্ন হয়ে মোটা মোটা বই থেকে নোট নিচ্ছেন এক তরুণ। মৃধাভাই ঠোঁটে আঙুল দিয়ে নীরবতার ইংগিত করে জানালেন, ইনি আমাদের সোনার ছেলে রিদওয়ান ভাই!

বাইরে এসে দেখি, কেতাদুরস্ত খালেদ স্যার গাড়ি থামিয়ে দীপ্তপায়ে তার চেম্বারে যাচ্ছেন। এদিকে সোনালুর অযুত পাপড়ি মাড়িয়ে কোনো এক এলেকেশী ওষ্ঠ চেপে পাহাড়ি ঢালুপথ বেয়ে নামছে। আফসোস, কেনো যে আইন অনুষদের সোনালুর পাপড়ি হয়ে জন্মালাম না! আমি আর সাদী কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় দাঁড়িয়ে কপট বিরহে সিগারেটে টান দিই। অনভ্যস্ততায় আমার খুকখুক কাশি পায়। আমাদের দৃষ্টি তখন খেলার মাঠ পেরিয়ে দূরের তেপান্তরের মেঘ-পাহাড়ে। শক্তি চট্টোপাধ্যায় কেনো সিগারেটকে অভিমানী প্রিয়ার ঠোঁটের সাথে তুলনা করেছেন তা নিয়ে আমাদের তর্ক শুরু।

ঝিম ধরা দুপুরের স্তব্দতার মাঝে বাইরে কোথায় বুঝি পর পর পটকা ফুটলো! ত্রস্ত কাকের আর্তচিৎকারে ক্যাম্পাসে আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। পক্ষীমাতার মতো ডানা মেলে বেরিয়ে এসে বিষাদমাখাকণ্ঠে শাহ আলম স্যার উচ্চস্বরে বলছেন, কী হয়েছে, কী হয়েছে! তার পেছনে সীমন্তে সিঁদুরমাখা আমাদের আধিকারিক দোলনচাঁপা সেন। (অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলে রাখি, ক্যাম্পাসে এত রাজনৈতিক গোলযোগ সত্ত্বেও মূলত স্যারের কারণেই আমাদের আইন অনুষদে তেমন একটা সেশন জট ছিলনা। )

আমাদের বেন্থামরূপি ডিন স্যার পাহাড়ি ক্যাম্পাস ছেড়ে এক সময় আইন কমিশনে যোগ দিয়েছেন। বেশ কিছুদিন পর স্যার আবার ফিরে আসলে আমাদের অনুষদে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়। তখন আমরা তাঁর কাছে দীক্ষা পাই আন্তর্জাতিক সংগঠনের।   নিবিষ্ট গবেষক আব্দুল্লাহ আল ফারুক স্যারের কোন এক সমৃদ্ধ ক্লাসে এসে শাহ আলম স্যার আমাদেরকে আইন ও চুক্তির ব্যাখ্যা করবার  এক গুচ্ছ সোনালি সূত্রের সন্ধান দেন। সেই সব ভাঙিয়ে উকালতি করতাম, পরে এক সময় ধূলি-ধূসরিত নথি ঘেঁটে যুদ্ধরত কৌঁসুলিদের নিরস্ত করে এজলাসে বসে রায় লিখি- নির্মম কালির আঁচড়ে নীল কাগজে খসখস করে স্বাক্ষর করি- কারাদণ্ড কিংবা খালাস; ডিক্রি কিংবা ডিসমিস।

প্রসঙ্গত বলে রাখি, আমাদেরকে সাংবিধানিক আইন পড়িয়ে আবার ঢাকায় ফিরে এলেন মেধাবী সেলিম স্যার আর পরিশ্রমী কার্জন স্যার।   সুদর্শন মণ্ডল স্যার আর হাস্যমুখি সীমা ম্যাডাম আমাদের নিয়ে পড়াতে বসেন পরম ভালবাসায়। আমরা একটু বড় হলে ফৌজদারি আইনের রক্তমাখা অবয়ব আর গল্পের ঝাঁপি নিয়ে আসর মাতিয়ে তোলেন স্মার্ট খালেদ স্যার।   ছিপছিপে জ্ঞানসাধক আবদুল্লাহ আল ফারুক স্যারের পড়াশুনার ব্যপ্তি আর গবেষণার আকাশচুম্বী দিগন্ত দেখে বেশ ঈর্ষা হয়। নির্মোহ নির্মল স্যার মুখ গম্ভীর করে ক্লাসে পড়িয়ে পরে পরীক্ষার খাতার অবজেক্টিভ মূল্যায়ন করেন। সদ্য যোগ দেয়া খ্রিস্টিন ম্যাডাম, লিজা ম্যাডাম আর  রিদওয়ান স্যাররা এমন মমতায় আমাদেরকে কাছে ডেকে নেন যে, আমরা মুখ ফসকে তাদের ডেকে ফেলি আপা বা ভাই।

এমনি করে আইন তার মখমলের নেকাব খুলে রঙিন ওষ্ঠ মেলে হাজির হতো জারুল বেষ্টিত আমাদের ক্যাম্পাসে। আমি আওড়াই, জীবনান্ন্দ-গ্রস্ত এক তরুণ কবির পংক্তি- ‘ঠোঁট তার রাঙা ছিলো ডালিমের খোসা থেকে ধারকরা রঙে’। বিচারিক রহস্যময়ী এ কণ্বদুহিতার  বহুবর্ণ অবগুণ্ঠন লুটিয়ে পড়ে ঘাসফুলের শয্যায়। ভালোবাসার স্পর্শে তার শিথিল বল্কল-পরিচ্ছদও খসে পড়ছে। তৃষিতের মতো এর বাঁকে বাঁকে অমিয়সুধা পান করে আমরা বুঝি ধন্য হয়ে উঠি।   
মাঝে মাঝে ডিন স্যারের কথায় আমরা সৌরভ পাই বিক্রমপুরের সোঁদা মাটি আর গাঙের জলের, রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ আর রাশান বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সোনাঝরা দিনযাপন আর জ্ঞানচর্চার।   ক্রিকেট খেলা নিয়ে স্যারের আলাদা অনুরাগও ছিল লক্ষণীয়; আশরাফুল কনিষ্ঠ সেঞ্চুরিয়ান হওয়ায় স্যার আবেগে কেঁদে ফেললেন। বলে রাখি, স্যার শুধু তাত্ত্বিক আইনের কঠিন সূত্র পড়িয়েই স্যার ক্ষান্ত হতেন না, বরং ব্যবহারিক আইন শিক্ষার জন্য বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করলেন ক্লিনিক্যাল লিগ্যাল এডুকেসন প্রোগ্রাম। এখানকার ব্যবহারিক ক্লাসে আইনজীবী, বিচারক, আর নিবেদিত শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে আমরা কল্পিত ঘটনায় বিচারকের আসনে বসি, আইনজীবী হয়ে কোমর বেঁধে আইনি লড়াই চালাই, সাক্ষ্য সাজাই আর রায় লিখি।   এক ফাঁকে খবির স্যার নিজস্ব ধারায় রসিয়ে রসিয়ে গল্প শুনিয়ে আমাদের উজ্জীবিত করে তোলেন। কখনও কখনও আমাদের সেমিনার কক্ষে এসে অতিথি বক্তা হিসেবে রাজধানী হতে উড়োজাহাজে চড়ে হাজির হন ব্যরিসটার এম আমিরুল ইসলাম, প্রফেসর মিজানুর রহমানের মত মহান আইনজ্ঞরা।

অনেক বছর পর স্যার কিছুটা অসুস্থতা নিয়েই আইন কমিশনে বসে আক্ষেপ করেন, এত কষ্ট করে রচিত কমিশনের রিপোর্ট কেউ আমলে নেয়না।   বিলেত ফেরত আমি স্যারকে কদমবুচি করে বললাম, স্যার তাড়াহুড়া করে আকদ হয়ে গেছে। স্যার যখন জানলেন আমার স্ত্রী আইনজীবী- ব্যরিসটার, তখন আমার স্ত্রীর জন্য ফক্সেস ক্যানডি উপহার দিয়ে বললেন, বউমা কী আমাকে চেনে? আমি হেসে বললাম,  বাংলাদেশের কোন আইন স্নাতক যদি প্রফেসর শাহ আলমের নাম আর গবেষণার সাথে পরিচিত না হয়, তার আইন ডিগ্রি ‘বারী সংহিতা’ মতে বাতিল।   কিশোরের উচ্ছ্বাস নিয়ে স্যার হেসে বললেন, তুমি তো দেখি একটুও বদলাওনি।

ফিরে যাই হামিদা হোসেনের ইন্টারভিউয়ের কাছে। কেন আইন পড়লাম এ প্রশ্নের জবাবে কুণ্ঠিতমুখে বললাম, জজ-ব্যারিস্টার বা এরুপ কোনো কাজের কথা ভেবে আইনে ভর্তি হয়েছিলাম ইংরেজি সাহিত্য বিসর্জন দিয়ে, কিছুটা নিজের অসম্মতিতে। আইনপেশা নিয়ে দেবী লক্ষ্মীর আশীর্বাদের কথাও শুনেছিলাম। প্রথম বর্ষে শাহ আলম স্যারের হাত ধরে খুঁজে পাওয়া আইনের সেই  মৃগশাবককে  ধাওয়া করে একসময় হারিয়ে ফেলেছি।

ভেবেছিলাম, একদিন সেই হরিণীকে শিকার করে ক্যাম্পফায়ারে ঝলসিয়ে দলবেধে মজা করে খাবো। সহপাঠী বাহার আর হান্নানের অকালে পরপারে চলে যাওয়ায় তা আর হলো কই? জারুলতলের পথ পেরিয়ে, টেমসের পাড় ঘুরে , ভূধরে-সাগরে-বিজন-নগরে ভালোবাসার তীর হাতে সেই আইন-হরিণীকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাড়া করলাম। বেশ কয়েক বছর পর শেভনিং বৃত্তি নিয়ে বিলেতে এসে  একদিন বিষন্ন বেলায় লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার আ্যবিতে গেলাম। ভারতীয় দন্ডবিধির প্রণেতা লর্ড মেকলের সমাধিপাশে ডিন স্যারের দুরবিনে প্রথম দেখা সেই কৃষ্ণসার আইন-মৃগকে আবিষ্কার করি আশ্রমদুহিতা শকুন্তলারূপে। হাতবাড়িয়ে খিলখিল করে সে আমায় ডাকছে- আয়, কাছে আয়। আমি যেনো তখন কামার্ত সম্রাট দুষ্মন্ত।

news24bd.tv

পাদটীকাঃ শাহ আলম স্যারের কবর জিয়ারত করতে  মিরপুর বুদ্ধিজীবী গোরস্তানে বিভোর হয়ে হাজির হয়েছি, আমি একা।   এক খাদেমের সহায়তায় চুপটি করে ঘুমিয়ে থাকা স্যারের কবরের পাশে পৌঁছে বুঝলাম, ফুলের তোড়াটা ভুলে গাড়িতে ফেলে এসেছি। হাতে পুষ্পস্তবক  নেই তো কী হয়েছে, টপটপ করে আমার চোখ থেকে কামিনীর পাপড়ির মত অশ্রুকণা ঝরে মিশে যাচ্ছে  গোরের জমিনে অযাচিতভাবে বেড়ে উঠা ঘাসের বন্যায়।   এর চেয়ে প্রিয় আর কীই বা উপহার দিতে পারতাম আমাদের প্রয়াত স্যারকে।  শেষে পাঠ করলাম স্যারের একমাত্র পুত্রের করুণ মৃত্যুর কিছুদিন পর আমাদের ক্লাসে কাঁপা হাতে বিলি 
করা আয়াতুল কুরসির স্তবক:

God! There is no God but He;
The Living, the Eternal;
neither slumber takes Him nor sleep;
to Him belongs whatever is in the heavens
and whatever is on and in the earth.
who would intercede with Him
but with His permission?
He knows what is in front of them
and what is behind;
and they will not comprehend
anything of His knowledge,
but what He willed;
His seat encompassed
the heavens and the earth,
and nor is He hampered by their safe keeping,
He is the Lofty and the Sublime! (Quran 2:255)

লেখক: বিচারক, যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক।


মত ভিন্নমত বিভাগের লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। এই বিভাগের সব লেখা লেখকের নিজস্ব চিন্তার প্রতিফলন।