স্কুল বন্ধ হলেও পড়ালেখা বন্ধ রাখা যাবে না

স্কুল বন্ধ হলেও পড়ালেখা বন্ধ রাখা যাবে না

তাসলিমা পারভেজ

আমি একজন শিক্ষক। ৩১ বছর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছি। ফলে আমার জীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে শিশুদের সঙ্গে।

পাঠদান করতে গিয়ে আমাকে সব সময় শিশুদের মন মানসিকতার দিকে নজর রাখতে হয়েছে।

তাদের মেধা ও শারীরিক বিকাশ দেখেছি মনযোগ দিয়ে। স্কুলে শিশু শুধু কিছু বিষয় শিখে চলে যায়, বিষয়টা এমন সরল নয়। ক্লাসরুম একটা শিশুর মনের জগতে অনেক বড় ভুমিকা রাখে যার প্রভাব সে জীবন ভর সঙ্গে নিয়ে চলে।  

এখন একটা ভিন্ন রকম সময় আমরা পার করছি।

আমাদের দেশে ৮ মার্চ প্রথম করোনা আক্রান্ত (কোভিড-১৯) রোগী শনাক্ত হয়। এর আগে চীনের উহান প্রদেশে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার খবর গণমাধ্যমের কল্যাণে আমরা জেনেছি। ভাইরাস ছড়িয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। আমরা না চাইলেও সেই ভাইরাস  চলে এসেছে আমাদের দেশেও। এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে অনেকে মারা গেছেন, অনেকেই চিকিৎসা ও পরিচর্যা পেয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছেন। ফলে, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া মানেই মারা যাওয়া নয়।

যাহোক, ১৭ মার্চ থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে অনলাইন ক্লাস চালু রয়েছে। কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রাম বাংলার অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী অনলাইন ক্লাস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অনেক স্কুল অনলাইন ক্লাস করার সক্ষমতা দেখাতে পারেনি, অনেকের হাতে অনলাইন ক্লাস করার মতো প্রযুক্তি যেমন নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট, স্মার্ট মোবাইল ফোন বা লেপটপ, কম্পিউটার নেই। তারপরও সংসদ টিভিতে পরিচালিত শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে অনেকেই পড়ালেখা এগিয়ে নিতে পারছেন। এক্ষেত্রে সরকারের ভুমিকাকে একটা ধন্যবাদ দিয়ে রাখতে পারি। তবে আরো পরিকল্পিতভাবে, সংসদ টিভির সঙ্গে দেশের বেসরকারি টিভিগুলোকেও সঙ্গে নিয়ে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের পড়ালেখা এগিয়ে নিয়ে গেলে, ভালো হয়।

শিক্ষার  ক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকা প্রধান। এখন যেহেতু শিক্ষককে কাছে পাওয়া যাচ্ছে না, পারিবারের বড়দের ওপর এখন শিক্ষকের দায়িত্ব এসে পড়ছে।

তাদের উচিত হবে শিশুদেরকে অনেক সময় দেওয়া, তাদের পড়ার সঙ্গী হওয়া।

শিশু পড়তে পড়তে যতোটা শেখে, খেলতে খেলতে শেখে তার চেয়েও বেশি। খেলার মাধ্যমে শিশুর শারীরিক গঠন হয়। এটা দেখা যায়। চোখে দেখা যায় না এমন বেশ কিছু বিকাশও শিশু অর্জন করে খেলার মাধ্যমে। এই যেমন বন্ধুত্ব করা, নেতৃত্ব দেওয়া, অন্যদের প্রতি সহমর্মী থেকে জয় উদযাপন করা, সুন্দর ও স্বভাবিকভাবে পরাজয় মেনে নেওয়া ইত্যাদি। এসবই শিশুকে বড় করে ও বড় মানুষ বানায়।

শিশুদের প্রতি ভালোবাসা সবারই আছে। বিশেষ করে শিশুর জন্য বাবা-মায়ের ভালোবাসার কোনো তুলনা হয় না। ফলে, করোনা মহামারির জন্য শিশুকে স্কুলে পাঠানোর বিষয়ে অভিভাবকদের ভেতরে বেশ ভয় কাজ করেছে, এখনও করছে। সরকারও শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য ৩ অক্টোবর পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করেছে। পরিস্থিতি অনুকূলে না এলে হয়তো এই ছুটি আরও বাড়বে। এটি বাস্তবমুখী ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। কিন্তু এই সময়টা শিশুদের শেখা ও পড়া যেন একেবারেই বন্ধ হয়ে না যায়, সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। সে দায়িত্ব এখন নিতে হবে পরিবারকে।  
ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে এখন শিশুদেরকে জনবহুলস্থানে ও ভীড়ের মাঝে নিয়ে যাওয়া নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।

ফলে, আমি মনে করি বাড়ির ভেতরে, ঘরে বা নিরাপদ স্থানে শিশুদের হাত-পা নেড়ে খেলার ব্যবস্থা করে দেওয়া উচিত। তারা এখন আঁকবে, গান গাইবে, মনের মতো লিখবে, ক্লাসের পড়াগুলোও প্রতিদিন অল্প অল্প করে শিখবে। সবচেয়ে বড় কথা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিবেচনা করে এখন স্কুল বন্ধ আছে। তাই শিশুদেরকে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলতে উৎসাহিত করতে হবে।

যা হোক, সোনামনিদের জন্য বলতে হয়, এখন কিছুটা কষ্টের সময় পর হলেও সামনে নিশ্চয়ই সোনালী দিন অপেক্ষা করছে। সুস্থ সবল থেকে আমদেরকে সেই সোনালী দিন বরণ করতে হবে।

লেখক: প্রধান শিক্ষক (অব.) সরকারি প্রাথিমিক বিদ্যালয়।

news24bd.tvতৌহিদ

সম্পর্কিত খবর