ওদের শাদা হাত কালো হাত ভেঙে দিন

ওদের শাদা হাত কালো হাত ভেঙে দিন

রাহাত মুস্তাফিজ

ঢাকার লোকাল বাসে উঠে ঘুমিয়ে পড়া আমার প্রিয় অভ্যাসগুলোর মধ্যে ছিলো একটা। পকেটমারের সমূহ সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এসব বাসে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়া যায়। প্রচুর শব্দ দূষণ অনুকূলে থাকায় এমনকি নাক ডাকার মত বিশ্রী ব্যাপার নিয়েও দারুণ ঘুম দেওয়া যায়।  

তো এমন এক শব্দময় ঝলমলে ঘেমো বিকেলে শ্যামলি থেকে ৮ নাম্বার বাসে উঠেছি।

যাবো শনির আখড়া। দীর্ঘপথ। ঘুমানোর জন্য অতি উত্তম যাত্রা। সাকুল্যে দুই আড়াই ঘণ্টার মামলা।
অবশ্যই যানজট কাউণ্ট করে।  

বাসে উঠে সোজা পেছনে চলে গেলাম। লোকাল বাসের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, পেছনের দিকে সীট ফাঁকা পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কণ্ডাক্টরদের চেষ্টা থাকে দূরের যাত্রীদের ঠেলেঠুলে পেছনে চালান করে দেওয়ার৷ এতে দণ্ডায়মান যাত্রীর সংখ্যা বাড়িয়ে নেওয়া যায় গাণিতিক হারে।


আরও পড়ুন: মহানবীর (দ:) ব্যঙ্গচিত্র ও বাক-স্বাধীনতা


তবে ভাগ্য সবদিন প্রসন্ন থাকে না। দেখা যায় যে সীটটি খালি হবে ভেবে সামনে গিয়ে লোহার রড ধরে ঝুলছি, সেটা খালি না হয়ে সামনে, পেছনে, পাশে একে একে খালি হচ্ছে।

আপনি বসতে যাওয়ার আগে বাজপাখির মত উড়ে এসে অন্যকেউ সীটটির দখল নিয়ে ফেলেছে। আবার দেখা গেলো বিরক্ত হয়ে সম্ভাব্য দখল ছেড়ে দিয়ে অন্য একটি সীটকে টার্গেট করলেন, কিন্তু আপনার কপাল এতটাই মন্দ যে আপনি সরে যাওয়ার পরপরই ওই সীটের যাত্রী উঠে গেলো।

মাঝে মাঝে সারাটি পথ ঝুলেঝুলে গন্তব্যে ফিরলেন। এইতো ঢাকার নিত্যদিনের মধ্যবিত্ত জীবন। অবশ্য আপনি চক্ষুলজ্জা ফেলে দিয়ে সম্ভাব্য দখলী সীটের যাত্রীকে জিজ্ঞেস করতে পারেন, ভাই কই নামবেন? আমার চক্ষু ও লজ্জা স্বাভাবিকের তুলনায় কিছুটা বেশি থাকায় অমন জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়ে ওঠেনি কখনো।  

যাহোক সেদিন ভাগ্য ভালো থাকায় উঠেই পেছনে ফাঁকা সীট পাওয়া গেলো। তাও জানলার দিকে। একটা ভালো ঘুমের প্রস্তুতি নিয়ে চোখ দুটি নিভিয়ে দিলাম। ক্লান্ত থাকলে আমার বড়জোর ৩০ সেকেণ্ড লাগে ঘুমিয়ে যেতে। এমন এক বাসঘুমের ভেতর হঠাৎ নাকে এসে দড়াম করে তীব্র একটা গন্ধ বাড়ি মারলো।

 বায়তুল মোকাররমের সামনের ডাস্টবিন ভেবে আধোঘুমের ভেতরেই গন্ধটাকে ইগনোর করলাম। কিন্তু নাহ্, গন্ধ তো যায় না। হৈ হৈ করে বাস এগিয়ে যাচ্ছে, সেই সাথে ডাস্টবিনও যাচ্ছে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে চোখ খুলে বাইরে তাকাতে হলো। দেখি বাস মতিঝিলের কাছাকাছি।

গন্ধের উৎস সন্ধানে পাশের সীটে তাকাতে আরেকবার বাড়ি খেলাম। গন্ধের। পরিস্থিতি অসহনীয়। সীটে বসে থাকলে দম আঁটকে মারা পড়তে হবে। আমার আর শনির আখড়া যাওয়া হবে না।

উঠতে উঠতে পাশের জনরে জিজ্ঞেস করলাম, "ভাই, দারুণ সেন্ট মাখছেন, এই সেন্ট কই পাওয়া যায়?" 
অতিশয় বিগলিত হয়ে ভাই সাহেব জবাব দিলেন, এইটা সেন্ট না, আতর আতর! আমার স্ত্রীর ভাই ফ্রান্স থেকে নিয়া আসছে।  
আমি আর কী বলবো! ফরাসি জিনিস। এসব দেশের প্রোডাক্টের ভাব ও ঝাঁঝ তুলনামূলক বেশিই হবার কথা। তবে এই ঘটনার পর ওই লোকের ফ্রান্স ফেরত শ্যালকরে আমি দীর্ঘদিন ধরে মনে মনে খুঁজেছি।

হারামজাদা একজন সরলসিধা বোন জামাইরেই কেবল ঠকায় নাই। আমার বাসঘুমের বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছে।  
পরে জেনেছি, দুনিয়ার এমন কোনো ইন্টারন্যাশনাল ব্রাণ্ড নাই যার মাল আমরা উৎপাদন করি না। এরমধ্যে ফরাসি ব্রাণ্ডও আছে প্রচুর।  
জিঞ্জিরা, ধোলাইখালে আপনি চাইলেই ফ্রেঞ্চ গিভেঞ্চি (Givenchy) বা ডিওর (Dior) ব্রাণ্ডের পারফিউম পেতে পারেন।  

কিংবা আপনার যদি দামি ফরাসি ব্রাণ্ড হার্মেস (Harmes) বা পিয়েরে কার্ডিনের (Pierre Cardin) ঘড়ির প্রতি আকর্ষণ থাকে, চলে যান জিঞ্জিরা। ১১ লাখ টাকার হার্মেস দুইশ টাকা, ৪ লাখ টাকার পিয়েরে কার্ডিন একটু দামাদামি করলে অনায়াসে দেড়শো'তে পেয়ে যাওয়ার কথা।  

অথবা আপনি সানগ্লাস পেতে চান? একদম ঝকঝকে ফরাসি শেলিন (Celine) ব্রাণ্ডের ৪২ হাজার টাকার গ্লাস মাত্র একশ বিশ টাকায় পাবেন।

বলাকা সিনেমা হলের সামনের ফুটপাত থেকে আমি নিজেই কিনেছি। আল্লার কিরা।  
তাই পৃথিবীর অন্যদেশের কথা বলতে পারবো না। বাংলাদেশে ফরাসি পণ্য বর্জন আন্দোলন সফল করা সম্ভব। একশতভাগ সম্ভব।  

তবে রাজু ভাস্কর্যের সামনে ব্যানার নিয়ে দাঁড়ায়ে লাভ নাই। পুলাপান নিয়া জাস্ট জিনজিরা ও ধোলাইখাল চলে যান। বাংলাদেশে ফরাসি ব্রাণ্ডের রমরমা বাজার তৈরির পেছনে এই শালারপুতেদের হাত। এঁদের কালো হাত, শাদা হাত ভেঙে গুড়িয়ে দিন। রাহাত মুস্তাফিজ, লেখক।

news24bd.tv নাজিম

সম্পর্কিত খবর