উবানের ভাষায় তোফায়েল আহমেদ জন্মগতভাবেই অকৃত্রিম

উবানের ভাষায় তোফায়েল আহমেদ জন্মগতভাবেই অকৃত্রিম

Other

"তোফায়েল আহমেদ। তাঁর কারিশমা হচ্ছে, জন্মগতভাবে তিনি অকৃত্রিম এবং রাজনৈতিক কাজে কঠিন পরিশ্রমী। কাজ করেছেন শেখ মুজিবের অনুচর হয়ে। তাঁর পত্নী এবং অন্যান্য ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন তখন বাংলাদেশে।

আমি তাঁদেরকে নিয়ে আসার একটি পরিকল্পনা দিলাম। জবাবে তিনি বললেন, 'আল্লাহর ওপর তাদের নিরাপত্তার ভার ছেড়ে দেই না কেন আমরা? লাখো লাখো বাঙালি একই রকমের বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। সবাই তো আসতে পারে না। ’

মুজিব বাহিনীর নেপথ্য পরিকল্পক ভারতীয় জেনারেল এস এস উবান তাঁর 'ফ্যানটমস অব চিটাগংঃ দ্য ফিপথ আর্মি ইন বাংলাদেশ' গ্রন্থে উনসত্তুরের গণ-অভ্যুত্থানের মহানায়ক তোফায়েল আহমেদ সম্পর্কে উপর্যুক্ত অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন।

দেশবরেণ্য রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদের ১৯৪৩ সালের ২২ অক্টোবর বরিশালের ভোলায় জন্মগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান। তাঁর জীবন বড় বৈচিত্র্যময়। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনারও মন্ত্রীত্ব করেন দশ বছর। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য দীর্ঘসময়। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকায় '৯১ ও '৯৬-এ জয়ী হন দুটি আসনে।   ক্ষমতা-যশ-খ্যাতি সবই পেয়েছেন। জীবনের তাঁর বড় প্রাপ্তি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব ছিলেন মন্ত্রীসম-মর্যাদায়। সর্বকালের সর্বশেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানের সাহচর্যটা ইতিহাসের অংশ। কেননা তিনি শেখ মুজিবকে গৌরবান্বিত করেছেন 'বঙ্গবন্ধু' উপাধি ভূষণে। তোফায়েল আহমেদ বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের কাছে শুধু নন, জাতীয় রাজনীতিতেই জীবন্ত কিংবদন্তি। লৌহমানব খ্যাত ফ্লিডমার্শাল আইয়ুব খানের পতন ঘটিয়ে সেনাছাউনিতে কাঁপন ধরিয়ে দেন। পাল্টে দেন রাজনীতির গতিপ্রকৃতি। সেই পথেই ১৯৭০ এর নির্বাচনে বাঙালির বিজয়-একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ।

ছয়দফা-আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শুরু হয় শেখ মুজিবের বিচার। ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ডাকসু' ভবনে তোফায়েল আহমেদের সভাপতিত্বে বৈঠক হয়। ছাত্রলীগের আব্দুর রউফ-খালেদ মোহাম্মদ আলী, ছাত্রইউনিয়নের সাইফুদ্দিন মানিক-সামসুদ্দোহা ও ছাত্রইউনিয়নের মোস্তফা জামাল হায়দার- দীপা দত্ত ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। তোফায়েল আহমেদ ১৭ জানুয়ারি ১১দফা ঘোষণা করলে সরকারি সংগঠন   'এন.এস এফ' মাহবুবুল হক দোলন ও ডাকসু জিএস নাজিম কামরান চৌধুরীর ছাত্রসংগ্রাম পরিষদে যোগ দেন।

৮১ দিনের অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন গণঅভ্যুত্থান ঘটায়। ২৫ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইউব খান পদচ্যুত হন। ২০ জানুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের মূল ফটকের সামনে মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে নিহত হন ছাত্রইউনিয়নের আসাদুজ্জামান আসাদ। ২৪ জানুয়ারি মিছিলে গুলিয়ে হত্যা করা হয় ঢাকার  নবকুমার ইনস্টিটিউটের ছাত্র মতিউর রহমানকে। ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সেনানিবাসে সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যার তিনদিনের ব্যবধানে ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডঃ শামসুজ্জোহাকে হত্যা করা হয়। এ ছাড়াও নিহত হন আনোয়ার রুস্তুম, মিলন ও আলমগীর। সেনানিবাসে সার্জেন্ট ফজলুল হক গুলিবিদ্ধ হলেও অলৌকিকভাবে তিনি বেঁচে যান। এসব হত্যায় ফুঁসে ওঠে পূর্বপাকিস্তান।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিশেষ ট্রাইবুনালের চেয়ারম্যান এস এ রহমান, কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন, প্রাদেশি মন্ত্রী সুলতান আহমদ ও মং সু প্রু এবং ক্ষমতাসীন  কনভেনশন মুসলিম লীগের প্রাদেশিক সভাপতি নওয়াব হাসান আসকারীর বাসভবন জ্বালিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ ছাত্রজনতা।

শ্লোগানমুখর হয়ে ওঠে সারাদেশ।   'জহুরের রক্ -স্বাধীনতার মন্ত্র', পিন্ডি না ঢাকা - ঢাকা, ঢাকা', তোমার আমার ঠিকানা-পদ্মা মেঘনা যমুনা' কুর্মিটোলা ভাঙ্গবো - শেখ মুজিবকে আনবো' ইত্যাদি শ্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে ঢাকা। গণঅভ্যুত্থানের মুখে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব কারামুক্ত হন। ২৩ ফেব্রুয়ারি রমনা রেসকোর্স ময়দানে অভ্যুত্থানের মহানায়ক তোফায়েল আহমেদ বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করেন এক আবেগঘন ভাষণে সিক্ত করে। ছাত্র নেতারা আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিব সঙ্গে দেখা করেন তাঁর ধানমন্ডির বাসভবনে। তারা নেতাকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আহুত  গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানে অমত দেন।

শেখ মুজিব তখন বলেন, আমার নেতা সোহরাওয়ার্দী সাহেব শিখিয়েছেন- জনগণের নেতা হতে চাইলে জনগণ কী চায় সেটা বোঝার চেষ্টা করবে, জনগণ যা চায় তাই করবে, জনগণ যা শুনতে চায় তাই বলবে, এবং আমি আমার নেতার কথা মতোই চলবো। শেখ মুজিবের সহজ সরল আবেগঘন  কথাগুলোর ভেতরে ছাত্রনেতারা তাদের করণীয় দিকনির্দেশনা লাভ করেন।

আরও পড়ুন


গেল ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহী মেডিকেলের করোনা ওয়ার্ডে ১২ জনের মৃত্যু

ইরানের যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত করে ক্ষমা চায়নি যুক্তরাষ্ট্র: জারিফ

মেসি জাদুতে ইকুয়েডরকে উড়িয়ে সেমিতে আর্জেন্টিনা

ভারত মহাসাগরে ইসরাইলি কার্গো জাহাজে হামলা


১৯৭০ সালের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে তোফায়েল আহমেদ  সভাপতি ও আসম আব্দুর রব সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সিরাজুল আলম খান মাঠে তোফায়েল আহমেদকে বক্তা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তালিম দিতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের (জহুরুল হক হল) মাঠে।

তোফায়েল আহমেদ একেক জন নেতার ফাঁকে ফাঁকে বক্তৃতা করে নিজের কথাগুলো বলে ফেলতেন। ধীরে ধীরে তাঁর বক্তৃতা শ্রুতিমধুর হয়ে ওঠে। মানুষও আকৃষ্ট হতে থাকে। এক সময় পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, তোফায়েল আহমেদের বক্তৃতা শোনার জন্যই সভার শেষ পর্যন্ত আগ্রহভরে বসে থাকতো ছাত্রজনতা। সত্তুরের নির্বাচনে সূচিত হয় আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয়। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্বের শপথ নেবেন, তখনই শুরু হয় ছয়দফা নিয়ে  প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া- ভুট্টোর নয়া ষড়যন্ত্র। একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালির ওপর চালায় বর্বরোচিত গণহত্যা। বঙ্গবন্ধুকে করা হয় গ্রেফতার। শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। মুজিব নগর সরকারের অধীনে জেনারেল ওসমানীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। জেনারেল উবানের ভাষায় এসময়ই অশুভ তৎপরতা নির্মূলে নিশ্ছিদ্র প্রস্তাবে একদল উৎসর্গীকৃত প্রাণ তরুণ নেতৃত্বে গঠিত হয় মুজিব বাহিনী।

শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে। উবান বলেন, এঁদের ছিলো মুজিবের প্রতি প্রগাঢ় আনুগত্য। এঁরা যুদ্ধের লক্ষ্য সম্পর্কে প্রেরণাদীপ্ত অকুতোভয় চতুষ্টয়।

লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

news24bd.tv এসএম