আমি হয়তো ভালো বাবা নই!

আবুল হাসনাৎ মিল্টন’

আমি হয়তো ভালো বাবা নই!

Other

১.

এখানে ক্লাস থ্রি-তে প্রথম রাজ্যস্তরে ন্যাপলান পরীক্ষা হয়। অনেকটা বাংলাদেশের পিএসসি, জেএসসির মত। ন্যাপল্যান সম্পর্কে আমার খুব একটা ধারণা ছিল না। গত বছর করোনার কারণে ন্যাপলান পরীক্ষা হয় নি, তাই পার্থিবেরও পরীক্ষাটা দিতে হয় নি।

 

এবার পরীক্ষার দুই সপ্তাহ আগে পূর্ণতার ন্যাপলান পরীক্ষার তারিখ জানলাম। এটা অবশ্য আমারি দোষ, আমি খোঁজ রাখি নি। কিন্তু তখন আর চাইলেও সপ্তাহে তিনজন গৃহশিক্ষক রেখে, সপ্তাহান্তে সিডনিতে কোচিং করানোর মত সময় নাই। ওকে বছরের শুরুতে কোন এক সময় আমি বইয়ের দোকান থেকে ন্যাপলান এক্সারসাইজের একটা বা দুটো বই কিনে দিয়েছিলাম মনে পড়ে।

পার্থিবের জন্য যে দুটো বই কিনে দিয়েছিলাম, ও শেষ করেছে। পূর্ণতা সম্ভবত বইগুলো লুকিয়ে ফেলেছে। মাঝেমধ্যে আমি খুঁজে পাই, আবার হারিয়ে যায়। কী আর করা? অত:পর সে ন্যাপলানের পরীক্ষাগুলো দিল। পরীক্ষা শেষে আমি জিজ্ঞেস করি, ‘মা, পরীক্ষা কেমন হল?’ দেখি ওর কোন বিকার নাই।

২.
আজ স্কুল থেকে প্রিন্সিপ্যালের ইমেইল পেলাম। স্কুলের অফিসের সামনে পূর্ণতার ন্যাপলান টেস্টের রেজাল্ট রাখা আছে, চাইলে স্কুলে গিয়ে নিয়ে আসতে পারি। অথবা সোমবার হোমওয়ার্ক আনার সময়ও আনা যেতে পারে। আমি সোমবার আনবো বলে মনে মনে ঠিক করি, কিন্তু নূপুরজানের তর সয় না। অগ্যতা স্বাস্থ্যবিধি মেনে রওয়ানা দিলাম।  

৩.
অফিসের সামনে টেবিলের ওপর রেজাল্টগুলো বন্ধ খামে পরপর সাজিয়ে রাখা, চার-পাঁচটা খামের পরেই পূর্ণতার নাম। পাশের কাগজে সই করে পূর্ণতার রেজাল্টভর্তি খামটা নিয়ে ফিরে এলাম। স্কুলটা বাসার একদম কাছে, গাড়িতে বড়জোর দুই মিনিট সময় লাগে।  

৪.
পথে ইচ্ছে করেই আমি খামটা খুলি নি। কারণ ও বড় জোর পাস নম্বর পাবে, এমন কী দুয়েকটা বিষয়ে ফেল করলেও আমি অবাক হবো না। বাসায় এসে নূপুরজানের হাতে রেজাল্টের খামটা দিলাম। পূর্ণতা তখন পেছনের উঠোনে একটা ম্যাগপাই পাখিকে খাওয়ানোয় ব্যস্ত। গত দুদিন ধরে সে এই পাখিটাকে খাওয়াচ্ছে। গত পরশুদিন হঠাৎ এসে বললো, বাবা, আমি কি ওই পাখিটাকে একটা ব্রেড খেতে দিতে পারি? আমি বললাম, অবশ্যই। ফ্রিজ থেকে একটা ব্রেড বের করে টুকরো টুকরো করে ওর হাতে দিলাম। ও ঘাসের ওপর ব্রেডের টুকরোগুলো ছড়িয়ে দেবার পর পাখিটা খুঁটে খুঁটে সব খেলো। পূর্ণতা একটু দূরে দাঁড়িয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে পাখির খাওয়া দেখছে। আজও পাখি নিয়ে ব্যস্ত পূর্ণতা রেজাল্টের কথা শুনে কোন আগ্রহ দেখালো না।  

৫.
নূপুরজান মনোযোগ দিয়ে পূর্ণতার রেজাল্ট দেখছে। আমি অপেক্ষায় আছি, মেয়ের রেজাল্ট খারাপ হবার সব দায় আমার কাঁধে চাপিয়ে কখন সে বিস্ফোরিত হয়! বেশ কিছুক্ষণ কোন সাড়াশব্দ নেই দেখে আমি কাছে গিয়ে রেজাল্ট শীটে উঁকি দিলাম। মেয়ে আমার অসাধারণ রেজাল্ট করেছে। স্টেট এভারেজ, স্কুল এভারেজ তো দূরের কথা, মেয়ে আমার প্রায় সব বিষয়ে একেবারে শীর্ষের ঘরে। আমার ধারণা সে টপ টেন পার্সেন্টের মধ্যে আছে।  

৬.
গত এক বছর ধরে নূপুরজান অন্য শহরে ট্রেনিং করেছে। বাচ্চারা অধিকাংশ সময় আমার সাথেই ছিল। আমি সারাক্ষণ তাদের পেছনে লেগে থাকি নি। বরং তাদের সাথে পড়াশুনা নিয়ে আমার একটা অলিখিত চুক্তি ছিল। প্রতিদিন গল্পের বই পড়া, বিভিন্ন বিষয়ে বইয়ের প্রতিদিনের জন্য নির্ধারিত এক্সারসাইজগুলো করা, খাতার এক বা দুইপাতায় কিছু একটা লেখা, এবং মিনিট দশেক পিয়ানো ও গিটার অনুশীলন করা। বিনিময়ে তারা প্রতিদিন একঘন্টার জন্য কম্পিউটারে গেমস খেলতে পারবে। এই একঘণ্টা কম্পিউটারের লোভে তারা নিজ উদ্যোগেই প্রতিদিনের হোমওয়ার্ক করতো। মাঝেমধ্যে আমি তাদের এক্সারসাইজগুলো দেখতাম, ভুলগুলো নিয়ে আলোচনা করতাম। কারো উপর কোন চাপ নাই, দুপক্ষের জন্যই উইন উইন সিচুয়েশন।

৭.
আমি বাচ্চাদের জীবনটা তাদের মত করে গড়বার পক্ষপাতি। এখনি এই করো, সেই করো, এটা শেখো, ওটা শেখোতে আমি নাই। ওরা যা-ই করে, তা যেন উপভোগ করে, আমি সেদিকটায় বেশী গুরুত্ব দেই। পার্থিব ফুটবল খেলে, পূর্ণতা জিমন্যাস্টিক্স শেখে, দুজনেই আর্ট ক্লাসে যায়। বাকি যা কিছু জীবনের জন্য প্রয়োজনীয়, সময়েই ওরা তা শিখে নেবে। এখনি এ নিয়ে হাহুতাশ করার পক্ষপাতি আমি নই।  

৮.
ক্যাডেট কলেজে ক্লাশ সেভেনে যাবার আগে একমাত্র সন্তান হিসেবে আমি খুব কমই নিজের হাতে ভাত খেয়েছি, মা-ই খাইয়ে দিতেন। এই আমি ক্যাডেট কলেজের সেই কঠিন প্রাক-সামরিক জীবন কী অনায়াসে পেরিয়ে এসেছি। এই মধ্যপঞ্চাশে এসে আমি রান্নাসহ ঘরের অধিকাংশ কাজই নিজে করি। সাথে আমার কনসালট্যান্সি, লেখালেখি, সমাজ সেবা, সবই তো করি।

এটাই জীবনের ধর্ম, এটাই মানুষের সক্ষমতা। যে কোন পরিস্থিতিতেই মানুষ মানিয়ে নিতে পারে। মানুষের উপরে কখনো আস্থা হারাতে নেই। আমার সন্তানরাও পারবে। তারা তাদের পছন্দমত ভবিষ্যত গড়ে নেবে। আর যে কোন পর্যায়ে যদি কোন সহায়তা লাগে, আমরা তো আছিই। এমন কী, আমি না থাকলেও তাদের বড় কোন অসুবিধা যেন না হয়, সে ব্যবস্থাও আমি করে রেখেছি। বাকিটা মহান সৃষ্টিকর্তার হাতে, আমি তো তার উপর সবসময়ই ব্যাপক আস্থাশীল।  

৮.
পূর্ণতা নাজ হাসনাৎ, আপনাকে অভিনন্দন আম্মাজান। আপনার সাফল্যে আমরা ছাড়াও আপনার দাদাভাই ও নানা-নানী খুব খুশী হয়েছেন। আপনার জন্য বাবার অবিরাম ভালবাসা। চিয়ার্স!


লেখাটি চিকিৎসক আবুল হাসনাৎ মিল্টন-এর ফেসবুক থেকে নেওয়া।

news24bd.tv নাজিম

এই রকম আরও টপিক