নিজের স্বপ্নকে সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেবেন না

নিজের স্বপ্নকে সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেবেন না

Other

সন্তানকে তার স্বপ্ন নিয়ে বড় হতে দিন। বড় জোর আপনি ওকে স্বপ্ন দেখতে সাহায্য করতে পারেন। কিন্তু কখনই আপনার স্বপ্নকে সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন না। এটা ঠিক যে সন্তান পৃথিবীতে আসার পর থেকে বাবা-মায়ের অনেক স্বপ্ন তৈরী হয়।

সন্তান যাতে ভালো স্কুল-কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে, এজন্য অনেক বাবা-মা উদয়াস্ত পরিশ্রম করেন অর্থ উপার্জনের জন্য, নিজের জীবনের বহু স্বাদ আহলাদ বিসর্জন দেন। এই ত্যাগ, এই পরিশ্রমের বিনিময়ে তারা আশা করেন- সন্তান তাদের স্বপ্ন পূরণ করবে। অর্থ ও সুযোগের অভাবে নিজেরা যেটা পারেননি, সেটা করে দেখাবে আত্মজ বা আত্মজা। কিন্তু বাবা-মা একবারও সন্তানের কাছে জানতে চান না, তাদের স্বপ্ন কি, তারা কি চায়! 

আমার বড় ছেলে এখন হাইস্কুলে পড়ছে।

ও যখন এলিমেন্টারি স্কুলে পড়ত, দেখতাম ওর সহপাঠি অনেক ছাত্র কত কিছু করছে। আড়াইটায় স্কুল ছুটি হতে বাসায় গিয়ে কোনক্রমে নাকে মুখে খেয়ে ওরা ছুটত মসজিদে। সেখানে তিনটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত কোরআন শিক্ষা নিত। তারপর ছয়টায় বাসায় ফিরে নাস্তা খেয়ে হোমওয়ার্ক করতে বসত। অনেকের হোমওয়ার্ক শেষ করতে রাত এগারোটা-বারোটা বেজে যেত। তারপর আবার পরদিন ভোরে উঠে স্কুলে যাবার জন্য প্রস্তুতি। শনি ও রবিবার উইকএন্ডের সকালে  তাদের খান কিংবা ববি-তারেক কোচিং সেন্টারে নিয়ে যেত মায়েরা। বিকেলে কারাতে কিংবা তায়কান্দো ক্লাস থাকতো।

আমিও শুরুতে ভাবতাম, আমার ছেলেকে ওদের মত বহু কিছুতে যুক্ত করব। যুক্ত যে করিনি সেটা নয়। তবে ওর পর্যান্ত বিশ্রাম ও আনন্দ করার সময় দিয়ে। শৈশবের উদ্দীপনা একজন শিশুর কাছ থেকে কেড়ে নিলে ও আর সেটা কখনও ফিরে পাবে না। প্রবাসে অনেক পিতামাতাকে ভিন্ন শহরে টিকে থাকার জন্য অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়। কষ্টার্জিত সেই অর্থ দিয়ে বিপুল অঙ্কের বিনিময়ে ছেলেমেয়েদের স্থানীয় কোচিং সেন্টারে ভর্তি করায় তারা। অনেক সময় মায়েরা তাদের নিজের গয়না বিক্রি করে দেয়। বাবারা এক শিফটের জায়গায় দুই শিফটে কাজ করে। সন্তানকে স্পেশালাইজড স্কুল কিংবা আইভি লিগের কলেজে ভর্তি করার জন্য নিজের সমস্তটুকু জীবনীশক্তি ব্যয় করে তারা। যে কারণে তারা মনে করে সন্তানের ভবিষ্যত নির্ধারণ করা তাদের অধিকার।  

বাঙালি সমাজে শুধু নয়, পৃথিবীর সব দেশের বাবা-মায়েরই কম বেশী এই প্রবণতা দেখা যায়। সিন্ডারেলা স্টোরি নামে কিছুদিন আগে একটা মুভি দেখলাম। সেখানে হাইস্কুলের শেষ বছরের ছাত্র অস্টিন পড়াশুনা করতে চায় প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে আর ওর বাবা চায় ছেলে নামকরা ফুটবলার হবে। কারণ সে নিজে একজন ফুটবল কোচ। এই দুয়ের দ্বন্দ্বে অস্টিন খুব মনমরা থাকে। স্কুল লীগের একটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে সে মাঠ ছেড়ে চলে যাবার চেষ্টা করে। তখন ওর বাবা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে যে, ‘এভাবে মাঠ ছাড়লে স্টেট ফুটবল টিমে খেলার স্বপ্ন তোমার পূরণ হবে না’। অস্টিন তখন বলে, ‘এটা তোমার স্বপ্ন বাবা, আমার না’। এটা বলে সে মাঠ থেকে চলে যায়।  

আমরা যেমন সন্তানদের ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার করার স্বপ্ন দেখি, পাশ্চাত্য দেশের বহু বাবা-মা এই ধরনের সনাতনী স্বপ্ন দেখে। বছর চারেক আগে একবার সাবওয়ে স্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি, তখন এক বৃদ্ধ লোক আমার বড় ছেলের কাছে জানতে চাইল, ‘তুমি বড় হয়ে কি হতে চাও?’ আমার ছেলে তখন উত্তর দিল, ‘কমিক বুক রাইটার। ’ শুনে বয়স্ক লোকটা হাসল, ‘তুমি এটা তুমি পার্ট টাইম করতে পার। তবে ডাক্তার কিংবা ল ইয়ার হবার চেষ্টা কর। কারণ সেখানে অর্থ আছে। ’ 

বেশীরভাগ বাবা-মা চায়, যে অর্থ ও সময় তারা বিনিযোগ করছে সন্তানের পিছনে, তারা যেন সেটা ফিরিয়ে দিতে পারে। এজন্য পরীক্ষিত কোন পেশায় তাদের দেখতে চায়। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, লইয়ার অনেকটা নিরাপদ পেশা। সেখানে গায়ক, চিত্রশিল্পী, ডিজাইনার, অভিনেতা কিংবা খেলোয়াড় হওয়াটা অনেকখানি ঝুঁকিপূর্ণ। বেশীরভাগ বাবা-মা ছেলেমেয়েদের এই পেশায় দেখতে চান না। তারা শুধু সন্তানদের উচ্চ শিক্ষিত করতে চায়। সৃজনশীল পেশাকে মনে করে কম লেখাপড়া জানা, খ্যাপাটে লোকের কাজ। কিন্তু সময় এসেছে এই ধরনের মানসিকতা পরিবর্তনের।  

আমরা যারা আমেরিকায় প্রথম প্রজন্মের মানুষ তারা শৈশবে বাবা-মায়ের কড়া শাসনে অভ্যস্ত ছিলাম। আমাদের মধ্যে খুব কম মানুষ মিলবে যারা বাবা-মায়ের হাতে মার খায়নি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে মানসিকতা পাল্টে গেছে। আগে বাবা-মা বেশীরভাগ সময় জানতে চাইত না- আমরা কি হতে চাই? অনেক সময় জানলেও নিজেদের ইচ্ছাকে চাপিয়ে দিত। তখন মিডিয়া এত শক্তিশালী ছিল না বলে মানুষ কিছু বদ্ধমূল ধারণা নিয়ে বেড়ে উঠত। সন্তান যে আলাদা একটা ব্যাক্তি, স্বতন্ত্র মানু…

লেখাটি মনিজা রহমান-এর ফেসবুক থেকে নেওয়া (মত-ভিন্নমত বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )

news24bd.tv/আলী