গাজীপুর সিটিতে ভোট কাল, কমিশনের সামনে সুষ্ঠু নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ

সংগৃহীত ছবি

গাজীপুর সিটিতে ভোট কাল, কমিশনের সামনে সুষ্ঠু নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ

অনলাইন ডেস্ক

জাহাঙ্গীরকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার, জাহাঙ্গীরের মায়ের ভোটে দাঁড়ানো, বিএনপির ভোট কোন পক্ষে যাবে- নানা প্রশ্নে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন বেশ জমে উঠেছে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার (২৫ মে) ভোট হবে এই সিটিতে। নির্বাচন খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ফলে সবার দৃষ্টি এখন গাজীপুরে।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেশের সবচেয়ে বড় এই সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে আয়োজন করা বর্তমান নির্বাচন কমিশনের জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ।

মঙ্গলবার (২৩ মে) ছিল নির্বাচনী প্রচারণার শেষ দিন। বৃষ্টির বাধায় প্রার্থীদের প্রচার কিছুটা বিঘ্নিত হয়। প্রচারের শেষ দিনে দুজন মেয়র প্রার্থী তাঁদের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন।

এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খান।

তাঁর বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছেন আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা ও সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। জাহাঙ্গীরের মা জায়েদা খাতুন মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় একাধিক নেতা সংবাদ মাধ্যমকে জানান, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছেন। জাহাঙ্গীর আলমের মায়ের পক্ষে যতসংখ্যক নেতাকর্মী প্রকাশ্য বা গোপনে কাজ করবেন বলে দলের আশঙ্কা ছিল, বাস্তবে তা ঘটছে না।

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে গঠন করা দলের একাধিক সদস্য গণমাধ্যমকে জানান, নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ঘোষণার পরে গাজীপুরে বেশ কিছু নেতাকর্মী জাহাঙ্গীরের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। কিন্তু পরে তাঁরা নৌকার পক্ষে মাঠে নামেন। নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নের প্রচার শুরু করেন। গাজীপুরের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষায় ভোটারদের আস্থা তৈরিতে নেতাকর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ফলে নৌকার জয়ের বিষয়ে দলের নেতাকর্মীদের আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় একাধিক নেতা জানান, ৪৮০টি ভোটকেন্দ্রভিত্তিক কমিটি গঠন করে মাঠে কাজ করছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এই কেন্দ্র কমিটিগুলোই ভোটের দিন ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে আসা এবং ভোট দিতে সহযোগিতার কাজ করবে। নৌকার বড় প্রতিদ্বন্দ্বী জাহাঙ্গীরের মা জায়েদা খাতুনের পক্ষে কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি গঠন করা হয়নি। ফলে নির্বাচন প্রস্তুতিতে অনেকটাই এগিয়ে আছে আওয়ামী লীগ।

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে গঠিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সমন্বয় টিমের সদস্য এস এম কামাল হোসেন  বলেন, ‘গাজীপুরের নেতাকর্মীরা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছেন। ভোটারদের কাছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন তুলে ধরেছেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা বিশ্বাস এসেছে যে গাজীপুরের উন্নয়নের জন্য নৌকায় ভোট দিতে হবে। ’

গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকাটিতে তিনজন সংসদ সদস্য রয়েছেন। তাঁরা হলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি। এই তিন সংসদ সদস্যের অনুসারীরাই নৌকার পক্ষে কাজ করছেন। নির্বাচনী আচরণবিধির কারণে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী মাঠে নামতে না পারলেও তাঁদের অনুসারীদের নৌকার পক্ষে কাজ করতে তাঁরা নির্দেশনা দিয়েছেন।

গতকাল সারা দিন গাজীপুরের কোনাবাড়ী, কাশিমপুরের বিভিন্ন এলাকায় দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে প্রচার চালান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দলের নেতাকর্মীরা প্রতিটি এলাকায় ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করেছে। সব ভোটকেন্দ্রভিত্তিক কমিটি করে আমাদের নেতাকর্মীরা নৌকার পক্ষে সক্রিয়। জাহাঙ্গীরের পক্ষে দলের কোনো নেতা অবস্থান নেননি। ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগকে কেউ হারাতে পারবে না। ’

আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, জয়দেবপুরের দিকে কয়েকটি ওয়ার্ডে বরাবরই বিএনপির ভোটার বেশি। ২৪, ২৫, ২৬, ২৮ নম্বর ওয়ার্ডসহ কয়েকটি ওয়ার্ডে সব সময়ই বিএনপির প্রার্থীরা এগিয়ে থাকেন। জাহাঙ্গীর আলম বিএনপির ভোট নিজের পক্ষে টানার চেষ্টা করছেন।

গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক একজন নেতা বলেন, জয়দেবপুরের কয়েকটি ওয়ার্ডে জাহাঙ্গীরের মায়ের কিছু ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এ ভোট তাঁর জয়ের জন্য যথেষ্ট হবে না।

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে গঠিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দলের সমন্বয়ক মির্জা আজম বলেন, ‘জাহাঙ্গীর লন্ডনে গিয়ে তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। বিএনপি প্রার্থী না দিলেও তারা এখন জাহাঙ্গীরকে ইন্ধন দিচ্ছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের সব নেতাকর্মী ঐক্যবদ্ধ। ফলে ৪৮০ ভোটকেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট দেওয়ার মতো লোক তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। এখন তিনি চাইছেন নির্বাচন বিতর্কিত করতে। ’

শেষ প্রচারণা

মিছিল, স্লোগান, ব্যানার-ফেস্টুনে গতকাল জমজমাট ছিল গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থীদের শেষ মুহূর্তের প্রচার। উন্নয়নের নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটারদের দরজায় কড়া নেড়েছেন তাঁরা। বিকেলের ঝড়-বৃষ্টি দমাতে পারেনি তাঁদের। মেয়র প্রার্থীদের পাশাপাশি ৫৬টি ওয়ার্ডের সাধারণ কাউন্সিলর এবং ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডের প্রার্থীরা স্বজন ও কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে নিয়ে শেষ দিনে চষে বেড়িয়েছেন এলাকার অলিগলি। মধ্যরাত পর্যন্ত চলে প্রচার।  

আজমত উল্লা খান সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত টঙ্গীর নিজ বাসায় নির্বাচন পরিচালনা কমিটি, থানা ও কেন্দ্র কমিটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। দুপুরের পর তিনি গাজীপুর শহরের দলীয় কার্যালয়ে গিয়েও একই ধরনের বৈঠক করেন।

এ সময় আজমত উল্লা খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। চ্যালেঞ্জ থাকলেও নৌকার জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী। ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে কোনো প্রার্থীর প্রতি হয়রানিমূলক আচরণ করা হচ্ছে না, হবেও না। সাধারণ মানুষ ও ভোটারদের কাছ থেকে আশাব্যঞ্জক সাড়া পাচ্ছি। তাঁরা ২৫ তারিখের নির্বাচনে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আমাকে জয়যুক্ত করবেন। ’

জায়েদার প্রতিশ্রুতি

নির্বাচনী প্রচারের শেষ দিনে ইশতেহার ঘোষণা করেন মেয়র প্রার্থী জায়েদা খাতুন। তিনি গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে নির্বাচিত হলে আগামী পাঁচ বছরের জন্য নগরবাসীর হোল্ডিং ট্যাক্স মওকুফ, নারী উদ্যোক্তাদের বিনা সুদে ঋণদান, আউটার রিং রোড নির্মাণ, পর্যাপ্ত সংযোগ ব্রিজ নির্মাণ, যাতায়াতের একাধিক বিকল্প রাস্তা তৈরি এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার স্থায়ী সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেন। দুপুরে শহরের ছয়দানার নিজ বাড়িতে ইশতেহার ঘোষণার সময় ছেলে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত ও সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম উপস্থিত ছিলেন।

রনির অঙ্গীকার

গাজীপুর মহানগরকে একটি পরিচ্ছন্ন সবুজ নগরী গড়ার প্রত্যয়ে গতকাল টঙ্গীর নিজ বাসায় ১৯ দফা নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন হাতি প্রতীকের স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী সরকার শাহনূর ইসলাম রনি। নির্বাচিত হলে নাগরিকসেবা সহজ, রাস্তা সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন, লেভেলক্রসিংগুলোতে ওভারপাস নির্মাণ, আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত স্কুল-কলেজ গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘গাজীপুরে নির্বাচন নয়, চর দখলের মতো মেয়রের চেয়ার দখলের নানা আয়োজন চলছে। ’ 

কাউন্সিলরদের প্রচারণা

গতকাল বিকেলে বৃষ্টি উপেক্ষা করেই নির্বাচনী প্রচার চালাতে দেখা যায় টঙ্গীর ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নূরুল ইসলাম নুরুকে। তাঁর প্রতীক লাটিম। কয়েক শ নারী-পুরুষ সমর্থক নিয়ে তিনি মা গার্মেন্ট, তিস্তা সড়ক, ন্যাশনাল টিউব সড়কসহ ওয়ার্ডের অলিগলিতে প্রচার চালান।

নূরুল ইসলাম নুরু বলেন, ‘গত দুই নির্বাচনেও বিজয়ী হয়েছি। তার আগে ছিলাম টঙ্গী পৌরসভার কাউন্সিলর। এলাকায় নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেছি। কাজ ও ভালোবাসার টানে ভোটাররা এবারও আমাকে নির্বাচিত করবেন বলে আশা করছি। ’

চান্দনা চৌরাস্তার ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী রফিকুল ইসলাম রফিক হাজারো তরুণ ও প্রবীণ সমর্থককে সঙ্গে নিয়ে প্রচার চালান। রফিক বলেন, ‘গত নির্বাচনেও বিজয়ী হয়েছিলাম। এলাকার রাস্তাঘাট করেছি। বিপদে মানুষের পাশে থেকেছি। যেখানেই যাচ্ছি মানুষ আমাকে বুকে টেনে নিচ্ছেন। অনিয়ম না হলে আমার বিজয় নিশ্চিত। তবে আমার প্রতিপক্ষ ভোটকেন্দ্র দখলের পাঁয়তারা করছে। ’

থেমে ছিলেন না সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী প্রার্থীরাও। তাঁরাও এলাকায় দলবেঁধে প্রচার চালিয়েছেন।

কমিশনের  চ্যালেঞ্জ

কিছুদিন হলো জাহাঙ্গীরকে দল থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তার মা জায়েদা খাতুন ভোটে দাঁড়িয়েছেন। বিএনপিরা তাকে সমর্থন দিচ্ছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।  তাছাড়া জাতীয় নির্বাচন আসন্ন, তাই এই নির্বাচনে জয়ের জন্য মরিয়া হয়ে আছে আওয়ামী লীগ। এই পরিস্থিতিতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করা কমিশনের জন্য চ্যালেঞ্জ। তাছাড়া নতুন এই কমিশনের ওপর জনগণ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কতটুকু আস্থা রাখবে তা অনেকাংশে এই নির্বাচনের ওপর নির্ভর করছে।  

news24bd.tv/আইএএম