যুদ্ধ ও সংঘাতের বছর ২০২৩

বিশ্বের ৩২টি দেশ বর্তমানে সশস্ত্র সংঘাতের মধ্যে রয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

সালতামামি

যুদ্ধ ও সংঘাতের বছর ২০২৩

দেলোয়ার হোসেন লিটু

করোনা মহামারি শেষ হতে না হতেই বিশ্ব দেখছে আরেক মহামারি। ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে গেছে যুদ্ধ আর সংঘাত। শুরুটা গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া।

যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ২১ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায়। এরপর শুরু গাজায় ইসরায়েলের নৃশংস অভিযান। ইসরায়েলে হামাসের অতর্কিত হামলার পরই শুরু এই অভিযান। এতে এখন পর্যন্ত গাজার ২০ হাজার ২৫৮ ফিলিস্তিনি নিহত ও ৫৩ হাজার ৬৮৮ জন আহত হয়েছেন।

এই দুই বড় যুদ্ধের বাইরেও সারাবিশ্বে ঘটেছে আরও নানা যুদ্ধ ও সংঘাত। পাশের দেশ মিয়ানমার থেকে শুরু করে বিশ্ব দেখেছে আর্মেনিয়া–আজারবাইজান অঞ্চলে নাগোর্নো–কারাবাখ যুদ্ধসহ সিরিয়ায় রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপসহ বিশ্বব্যাপী সশস্ত্র সংঘাতের দিকে নজর রাখা ও এ সম্পর্কিত তথ্য দেওয়া ওয়েবসাইটগুলো জানাচ্ছে—সরাসরি যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হামলা ইত্যাদি মিলিয়ে বিশ্বের ৩২টি দেশ বর্তমানে সশস্ত্র সংঘাতের মধ্যে রয়েছে।

ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ:
এ বছরের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ। দশকের পর দশক ধরে নিপীড়নের জবাব দিতে গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে রকেট হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। এরপর হামাস নির্মূলের নামে নারকীয় হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে ইসরায়েল। আড়াই মাসে মারা যায় নারী-শিশুসহ প্রায় ২১ হাজার ফিলিস্তিনি। কাতারের মধ্যস্থতায় নভেম্বরের শেষে সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে যেতে রাজি হয় তেল আবিব। তবে যুদ্ধ বিরতি শেষ হওয়ার পর আগের তুলনায় বাড়ে হামলা। যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর কারণে নিরাপত্তা পরিষদে পাস হয়নি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ:
গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি শুরু এই যুদ্ধের। ইউক্রেনের বিভিন্ন অঞ্চলে ঢুকে পড়ে রাশিয়ার বাহিনী। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর মদদে পাল্টা হামলা করে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশটি। প্রায় ২ বছর হতে চললেও এখনও সেখানে যুদ্ধ চলমান। বছর শেষের কয়েক সপ্তাহ জুড়ে হামলা পাল্টা হামলা জোরদার হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে রিপাবলিকানরা ৬১ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা প্যাকেজ আটকে দেয়ায় ইউক্রেন বেশ বিপাকে পড়েছে। দেশটিতে দেখা দিয়েছে অস্ত্র ও সেনা সংকট। এদিকে এক ইঞ্চি জমি ছাড়তেও রাজি নয় কোনো পক্ষ। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, উদ্দেশ্যপূরণ না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে।

গৃহযুদ্ধের কবলে সুদান:
ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের কবলে সুদান। এপ্রিল থেকে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে দেশটির সেনাবাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনী। দেশটির সশস্ত্র বাহিনীরই দুই জেনারেল- আবদেল আল ফাতাহ আল বুরহান ও জেনারেল মহম্মদ হামদান দাগালো একে অপরের রক্তপিপাসু। প্রথম জন সুদানের সেনাপ্রধান এবং ২০১৯ থেকে দেশের সর্বোচ্চ শাসনব্যবস্থার জন্য ভারপ্রাপ্ত কাউন্সিলের প্রধান। দ্বিতীয় জন দেশের আধাসামরিক বাহিনী ‘র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স’ (আরএসএফ)-এর প্রধান তথা কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য। দুজন জেনারেলের বিরুদ্ধেই মানবাধিকার লঙ্ঘন, লুটতরাজ, নৃশংসতা ও ধর্ষণে মদদের অভিযোগ রয়েছে। সেই লড়াই এখনও চলছে। প্রাণ হারিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ।

মিয়ানমারে জাতিগত সংঘাত:
বছরের পর বছর ধরে মিয়ানমারে চলছে জাতিগত সামরিক সংঘাত। ২০২১ সালে সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে বড় ধরণের ক্ষতির মুখে পড়েছে দেশটি। শান রাজ্যের তিনটি জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী, যাদেরকে আরও অন্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো সমর্থন দিয়েছে, তারা সরকারের বিরোধিতা করে আসছে। সম্প্রতি বিদ্রোহীরা জান্তা সরকারের বেশ কয়েকটি সামরিক চৌকি, সীমান্ত পারাপার এবং রাস্তা দখল করে নিয়েছে। এই সীমান্ত পারাপার এবং রাস্তা ব্যবহার করে চীনের সাথে স্থল বাণিজ্যের বেশিরভাগ পরিচালিত হতো। প্রায় আড়াই বছরের লড়াই শেষে এখন মনে হচ্ছে যে, সামরিক বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং হয়তো তাদের এখন পরাজিত করাটাও সম্ভব। বিদ্রোহীদের তৎপরতার জবাবে জান্তা সরকার শত শত বিমান হামলা করেছে এবং কামান থেকে গোলা ছুঁড়েছে। যার কারণে হাজার হাজার মানুষ তাদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।

নাইজারে সামরিক অভ্যুত্থান:
২০২৩ সালের ২৬ জুলাই নাইজারের রাষ্ট্রপতি মুহাম্মাদ বাজুমকে দেশটির রাষ্ট্রপতির রক্ষিবাহিনী আটক করার পর রাষ্ট্রপতির রক্ষী বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল আব্দুররাহমান চিয়ানি নিজেকে নতুন সামরিক জান্তা প্রধান হিসেবে ঘোষণা করার মাধ্যমে নাইজারে একটি অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। রাষ্ট্রপতির রক্ষিবাহিনী দেশটির সংবিধান বাতিল করে এবং সীমান্ত বন্ধ রেখে কারফিউ জারি করে। ১৯৬০ সালে ফ্রান্স থেকে স্বাধীনতা লাভের পর এটি দেশটির পঞ্চম সামরিক অভ্যুত্থান, প্রথম অভ্যুত্থান হয়েছিল ২০১০ সালে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং পশ্চিম আফ্রিকার আঞ্চলিক সম্প্রদায় ইকোয়াস এই অভ্যুত্থানটির চরম নিন্দা করার পাশাপাশি দেশটির বর্তমান সামরিক হস্তক্ষেপের ফলস্বরূপ আসন্ন ২০২৩ সালের নাইজারীয় সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

নাগর্নো-কারবাখে জাতিগত উচ্ছেদ:
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বিতর্কিত নাগোর্নো-কারাবাখ এলাকা আজারবাইজানের দখলে যাওয়ার পর থেকে হাজার হাজার জাতিগত আর্মেনিয়ানরা ওই এলাকা ছাড়তে যেতে শুরু করে। এ পর্যন্ত সাড়ে ছয় হাজারের মতো বাসিন্দা ওই ছিটমহলটি ছেড়ে আর্মেনিয়ায় পাড়ি জমিয়েছে। এলাকাটিতে এক লাখ বিশ হাজার জাতিগত আর্মেনিয়ানের বাস ছিল। আর্মেনিয়ার সরকার যুদ্ধের কারণে বাস্তুহারা মানুষকে স্থানান্তরের পরিকল্পনা ঘোষণা করার পর থেকেই তারা এলাকা ছাড়তে শুরু করে। আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, ওই এলাকায় 'জাতিগত নিধন' চলছে। নাগোর্নো কারাবাখ অঞ্চলটি গত তিন দশক ধরে জাতিগত আর্মেনিয়ানরা নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। এই ছিটমহলের প্রতি আর্মেনিয়া এবং তাদের মিত্র রাশিয়ার সমর্থন ছিল। বছরের পর বছর ধরে সেখানে শত শত রুশ সেনা ছিল।

ইয়েমেন-সৌদি গৃহযুদ্ধ:
আরব বসন্তের প্রভাবে ইয়েমেনের দীর্ঘ সময়ের প্রেসিডেন্ট আলি আবদুল্লাহ সালেহর পতন হয় ২০১১ সালে। কিন্তু তাতেও ইয়েমেনবাসীর ভাগ্যে সুফল মেলেনি। ২০১৪ সালে এডেন উপসাগরের তীরবর্তী এ দেশে গণঅভ্যুত্থানের ‘ছাইভস্ম’থেকে জন্ম নেয় হুথি বিদ্রোহীরা। তাদের সব রকমের সাহায্য দিচ্ছে ইরান। এতে ইরান-সৌদি সম্পর্ক আরও জটিল হয়ে ওঠে। হুথি ও ইরান যেহেতু শিয়া মতাবলম্বী, সৌদি তাই প্রতিবেশী আরব সুন্নি দেশগুলোকে নিয়ে হুথিবিরোধী সামরিক জোট গড়ে তোলে। এরপর থেকে ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট প্রায়ই হামলা চালাতে শুরু করে। প্রতিশোধ নিতে হুথিরাও পাল্টা আক্রমণ চালায় সৌদিতে। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় শান্তি প্রস্তাব গৃহীত হলেও তা নড়বড়ে। নতুন করে যেকোনো সময় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তে পারে।

লেবানন-ইসরায়েল সংঘাত:
গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে লেবাননে গৃহযুদ্ধ চলার সময়ে দেশটিতে শিয়াদের সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘হিজবুল্লাহর’ উত্থান হয়। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব হওয়ার পর দেশটির রেভ্যুলশনারি গার্ডের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠে হিজবুল্লাহ। তারাই পরে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে। এক দশক পর ১৯৮৯ সালে গৃহযুদ্ধের অবসান এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে সৌদি, মিশর, সিরিয়া, ইরান, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র মিলে সৌদির তায়েফ শহরে ‘তায়েফ চুক্তি’ সই করে। এই চুক্তির পর গৃহযুদ্ধরত সব গোষ্ঠী অস্ত্র ফেরত দিলেও হিজবুল্লাহ তাদের অস্ত্র জমা দেয়নি।

পরবর্তীতে হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা প্রায়ই ইসরায়েলের সেনাদের ওপর হামলা চালাতে শুরু করে। এমন পরিস্থিতিতে ২০০০ সালে দখলকৃত উত্তর লেবানন থেকে পুরোপুরি সরে যেতে বাধ্য হয় ইসরায়েল। এরপর ২০০৬ সালে ‘পয়েন্ট ১০৫’ নামের সীমান্ত থেকে দুই ইসরায়েলি সেনাকে বন্দি করে হিজবুল্লাহ। ফলে হিজবুল্লাহকে উৎখাতে পুনরায় লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে অভিযান চালায় ইসরায়েল। হিজবুল্লাহর প্রতিরোধের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয় তারা। পরে এই যুদ্ধ নিয়ে তদন্ত কমিশন গঠন করে ইসরায়েল। তদন্ত শেষে ইসরায়েল সরকারের গঠিত উইনোগ্রাড কমিশন জানায়, ২০০৬ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল ‘ব্যর্থ’ হয়েছে।

এরপরেও সংঘাত থেমে নেই। বিশেষত হামাস–ইসরায়েল সংঘাত শুরুর পর থেকেই হিজবুল্লাহ সম্পর্কিত আলোচনা সামনে আসতে শুরু করে। গত ৩ ডিসেম্বরও হিজবুল্লাহ-ইসরায়েল পাল্টাপাল্টি হামলা চালিয়েছে। এতে তিনজন লেবানিজ নিহত হয়েছে। এছাড়া লেবাননের দক্ষিণ সীমান্তে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে লেবাননের এক সেনা সদস্য নিহত হয়েছেন।

এছাড়া রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্য সংঘাত চলছে আলজেরিয়া, বুরকিনা ফাসো, চাদ, কঙ্গো, ঘানা, আইভরি কোস্ট, নাইজার, সুদান, তানজানিয়া, টোগো, তিউনেশিয়া, উগান্ডা, ইয়েমেন, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, আফগানিস্তান, মালি, সোমালিয়া, দক্ষিণ সুদান, সিরিয়া, ইথিওপিয়ায়।

news24bd.tv/DHL