বাজেটটি একটু বড় হলে ক্ষতি নেই

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

বাজেটটি একটু বড় হলে ক্ষতি নেই

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

একটি দেশের সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক বাজেট। এখানে সরকারের আগামী বছরের অর্থাৎ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, উন্নয়ন কৌশল এবং অন্যান্য প্রকল্প সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেওয়া হবে। এর সঙ্গে সরকারের রাজস্ব আদায়, রাজস্ব ব্যয় এবং অন্যান্য ব্যয় সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হবে। একটি সরকারের বাজেটের সঙ্গে বেসরকারি সংস্থা বা যেকোনো সংস্থার বাজেটের ভিন্নতা আছে।

কারণ সরকারি বাজেটটি সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসাব হলেও সেটি কিন্তু তিনটি পক্ষকে প্রভাবিত করে। একটি হলো সরকারের আয়-ব্যয়, দ্বিতীয়টি হলো বেসরকারি খাত—বেসরকারি খাতের সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং তৃতীয়টি হলো জনগণের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। বাজেট হয়তো জুন মাসে দেবে। মার্চ মাস চলে যাচ্ছে।

এখন থেকে যদি বাজেট নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা যায়, সুবিধা হয়। সরকার তো চিন্তা-ভাবনা করছে, কথাবার্তা বলছে। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে যেটি সবচেয়ে বড় দরকার তা হলো, জনসমক্ষে কিছু ধারণা দেওয়া—যেটি আমাদের দেশে হয়ে ওঠে না। সরকার যখন সংসদে খসড়া পেশ করে, তখনই লোক জানতে পারে।

এর আগে কিন্তু বাজেটের সার্বিক বিষয়টি কেউ জানতে পারে না। ফলে জনগণ ও অন্যান্য বেসরকারি লোক মতামত দিতে যথেষ্ট সময় পায় না বা দিতে পারে না। বাজেট কল্যাণমুখী হতে হবেআমি কয়েকটি জিনিসের ওপর দৃষ্টিপাত করব। প্রথমত বাজেটের যে আকার, সেটি নিয়ে অনেক কথা বলা হয়ে থাকে। কেউ বলে যে বড় হয়েছে, আরেকটু ছোট করা উচিত ছিল।

আমার মতে, বাজেটটি একটু বড় হলে ক্ষতি নেই। কারণ বাংলাদেশের উন্নয়নে সরকারের যে ভূমিকা সেটি অনেক বড়। সে হিসেবে বাজেট কিছুটা বড় হতে পারে। বড় হওয়া মানে এই নয় যে অর্থের অপচয় হবে বা অর্থ ঠিকমতো ব্যবহার করা হবে না। মোদ্দাকথা হচ্ছে, বাজেটের আকার যা-ই থাকুক, সেটি সঠিকভাবে ব্যয় হবে। এর সুফল ব্যবসা-বাণিজ্যে এবং জনগণের কাছে পৌঁছাবে।

বাজেটের ব্যাপারে দুটি জিনিস মনে রাখা দরকার। সরকার যে টাকা খরচ করবে, এটি আহরণ কিভাবে করবে। সম্পদ কিভাবে আহরণ করবে। ট্যাক্সের মাধ্যমে, অন্যান্য ফির মাধ্যমে বা ঋণের মাধ্যমে করবে কি না, সেটি দেখার বিষয়। আরেকটি বিষয় হলো বণ্টন। কোন খাতে কী রকম বণ্টন করবে। কত টাকা কোন খাতে দেবে। প্রশাসনে কত ব্যয় করবে। চিকিত্সা খাতে কত টাকা ব্যয় করবে। শিক্ষায় কত টাকা ব্যয় করবে।

এখন আসা যাক সম্পদ আহরণ বিষয়ে। বাংলাদেশে কর হলো সরকারের সবচেয়ে বড় একটি অর্থের উৎস। সেই করটি আমাদের দেশে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আদায় করে। সেই করের মূল উৎসটিই হলো মূল্য সংযোজন কর অর্থাৎ পরোক্ষ কর। পৃথিবীর সব দেশেই কিন্তু মূল্য সংযোজন করের চেয়ে বেশি হচ্ছে প্রত্যক্ষ কর। কিন্তু আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার হলো প্রত্যক্ষ কর; যেমন—আয়কর। পরোক্ষ করে অসুবিধা হচ্ছে ভ্যাটটি ধনী-গরিব সবাইকে সমহারে দিতে হয়। যেমন—রুটির ওপরে একটি ভ্যাট দেওয়া হয়েছে। এটি বড়লোকদের যে পরিমাণ ট্যাক্স দিতে হয়, দরিদ্রও সে রকম ট্যাক্স দেয়। এটি ঠিক ইকিউটি বা সমতার মানদণ্ডে যুক্তিসংগত নয়।

ট্যাক্স জিডিপি কিন্তু বাংলাদেশে অত্যন্ত কম। এটি ৮ বা ৯ শতাংশের মতো, যেটি পৃথিবীর সবচেয়ে কম রেশিও। নেপালের মতো একটি দেশে ১৪ শতাংশ। ভারতে প্রায় ১৫-১৬ শতাংশ। আর উত্তর ইউরোপে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ট্যাক্স জিডিপি রেশিও। সেখানে কিন্তু সরকারের ব্যয়গুলো কল্যাণমুখী ও জনগণের সুবিধার্থে হয়ে থাকে।

আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়। আমাদের এনবিআরের এখনো তেমন সংস্কার হয়নি। ডিজিটাইজেশন হয়নি। এনবিআর যেটি করে তার কর্মকর্তার মাধ্যমে ট্যাক্স আদায় করে। এখানে কিন্তু এই কর্মকর্তা ও ট্যাক্সের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ হয়। এটি কিন্তু কোনোক্রমেই কাম্য নয়। উন্নত দেশে জনগণ ট্যাক্স পে করে ই-মেইলের মাধ্যমে, কাগজপত্রের মাধ্যমে। সামনাসামনি যোগাযোগ হলেই কিন্তু নানা রকম নেগোসিয়েশন, নানা রকম আদান-প্রদান হয়ে থাকে।

যে ট্যাক্স দেবে তার ব্যক্তিগত পরিচয়, তার সম্পর্কে একটু জানাশোনা। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ট্যাক্স আদায়ে আধুনিক হতে হবে।

তৃতীয় নম্বর একটি হলো যে আমাদের দেশে এখনো ট্যাক্সের নেট বা জালটি ছোট। বিশেষ করে প্রত্যক্ষ ট্যাক্স প্রদানকারীর সংখ্যা অনেক কম। এমনকি টিআইএন আছে বহু লোকের, তারা অনেকে ট্যাক্স দেয় না। বারবার বলা হচ্ছে ট্যাক্সের হার না বাড়িয়ে ট্যাক্সের নেটটি বাড়ান। ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে ট্যাক্স দেয় অতি নগণ্যসংখ্যক কিছু লোক। এখানে বহু ব্যবসায়ী আছেন, বহু চাকরিজীবী আছেন, বহু সম্পদশালী লোক আছেন, ট্যাক্স দেন না বা তাঁদের অনেকের টিআইএন নেই। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, বেশির ভাগ ট্যাক্স প্রদানকারী ঢাকা এবং বিভিন্ন বড় শহরের। বিভিন্ন জায়গায় এখন অনেক দোকান মালিক আছেন, গ্রামে-গঞ্জে এখন অনেক ভালো দোকান আছে, তারা ট্যাক্সের আওতায় নেই। ট্যাক্স দেয়ই না। পৃথিবীর কোনো দেশে কিন্তু এতসংখ্যক মানুষ ট্যাক্সের বাইরে নেই। অনেক দিন ধরে বলা হচ্ছে, বাড়াব। বলছে, সার্ভে করবে, মানে জরিপ করে বের করবে। জানি না, এত দিন সময় কেন নিচ্ছে।

আরেকটি জিনিস হলো আমাদের লোকাল গভর্নমেন্ট অর্থাৎ স্থানীয় সরকার। এখানে ইউনিয়ন পরিষদ আছে, উপজেলা পরিষদ আছে। সেখানে যে ট্যাক্স সংগ্রহ করা হয়, তা অত্যন্ত সীমিত। সেখানে সীমাবদ্ধতা আছে। তবু তাদের ট্যাক্স আদায় আরো বৃদ্ধি করা উচিত। ওখানে ট্যাক্স বাড়লে, তারা স্থানীয়ভাবে খরচ করতে পারবে। স্থানীয় উন্নয়ন কাজ করতে পারবে। তবে যদি শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের ট্যাক্সের ওপর নির্ভর করে, তাহলে সরকার যে যত্সামান্য বরাদ্দ দেয় স্থানীয় সরকারকে, তা দিয়ে স্থানীয় সরকারের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করা সম্ভব হয় না। আমাদের স্থানীয় সম্পদ আহরণ আরো বৃদ্ধি করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে সম্পদ আহরণ ইউনিয়ন পরিষদ করবে, জেলা পরিষদ করবে, উপজেলা পরিষদ করবে।

আমরা দেখি, এডিবি—বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা একটি বিরাট হয়ে থাকে। এটিতে অনেক প্রজেক্ট থাকে। আমার পরামর্শ হলো এডিবি একদম কাটছাঁট করে ফেলা। গুটিকয়েক অত্যন্ত জরুরি ভৌত অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য—এই কয়েকটি বিশেষ সেক্টরে এডিবি উন্নয়ন প্রকল্প থাকবে। অন্য কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জন্য নেওয়া যাবে না। কারণ এখন আমাদের অর্থের সংস্থান করার অনেক চ্যালেঞ্জ আছে।

আরেকটি পরামর্শ হচ্ছে যেসব প্রকল্প শেষ হয়নি, সেই প্রকল্পগুলো শেষ করা। আমরা দেখেছি, নতুন করে বড় বড় প্রজেক্ট নিলে দুই বছরের প্রকল্প পাঁচ বছর, পাঁচ বছরের প্রকল্প ১০ বছর লাগে। অর্থের অপচয় হয়। অতএব প্রাধিকারভুক্ত এবং নির্দিষ্ট করে ভালো করে লক্ষ্য নির্ধারণ করে যেগুলো করা প্রয়োজন, সেগুলো করা। এতে কিন্তু আমাদের বাজেটের যে অর্থ বা এডিবি বরাদ্দ করা হয়, সেটি কমে যাবে এবং সেটি বরং আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যতে কাজে লাগানো যাবে। আমাদের এখানে শিক্ষায় এবং স্বাস্থ্যে বাজেটের অত্যন্ত কম বরাদ্দ দিয়ে থাকি। কোরিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ পৃথিবীর যেসব দেশের আমরা উদাহরণ দিয়ে থাকি. সেসব দেশ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে প্রচুর ব্যয় করে। আমাদের এখানে স্বাস্থ্য প্রাইভেটাইজেশন হয়ে যাচ্ছে। দিন দিন বেসরকারি খাতে চলে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতে সরকারের ভূমিকা কমে যাচ্ছে। এটি তো মোটেই ঠিক নয়। কারণ দরিদ্র লোক কিন্তু ভুক্তভোগী। স্বাস্থ্য খাতে সরকারের অব্যবস্থাপনার জন্য তাদের সেবা অপ্রতুল হয়ে যাচ্ছে।  

সরকারের অর্থায়নের একটি দিক হচ্ছে বিভিন্ন সূত্র থেকে ঋণ নেওয়া। সরকার ঋণ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে এবং সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে। সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ঋণ কিন্তু এখন কমে গেছে। সরকার যখন ব্যাংকের মাধ্যমে প্রাইভেট সেক্টর থেকে ঋণ নেয়, তখন ব্যাংক আবার প্রাইভেট সেক্টরে ঋণ কম দিতে পারে। প্রাইভেট সেক্টর হলো মূল চালিকাশক্তি। যথাসম্ভব প্রাইভেট সেক্টরের ঋণ দিতে হবে। সরকারের ঋণের আরেকটি উৎস হচ্ছে বৈদেশিক ঋণ। গত দেড় শতকে এটি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে ঋণের বোঝা বেড়ে যাচ্ছে এবং আমাদের পরিশোধের ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করছে। এদিকে দৃষ্টি দিতে হবে।

আমাদের দেশে মূল্যস্ফীতি একটি চ্যালেঞ্জ। আমি মনে করি, এটি সরবরাহজনিত কারণে হচ্ছে। মানে খাদ্যদ্রব্য, পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে হবে। এটির জন্য যত দূর সম্ভব কৃষি, কৃষিশিল্প, ছোট ও মাঝারি শিল্পে দৃষ্টি দিতে হবে। বাজেটে, বিশেষ করে এই দিকটায় এবার নজর দিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি জিনিস, এই যে ছোট শিল্প এবং অন্যান্য কৃষি দ্রব্যে এখানে কিন্তু বিশাল জনগোষ্ঠী তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। অতএব এই দিক থেকে কিন্তু এবার বাজেটে যথেষ্ট প্রাধান্য দিতে হবে।

বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের অভাব। দেখা গেছে, শিক্ষিত বেকার অনেক। এতে সামাজিক অসুবিধা হয়। পরিবারের দুঃখ-দুর্দশা হয়। সুতরাং আমাদের এই দিকে খুব বেশি নজর দিতে হবে—সেটি হলো কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। দেখা গেছে, বড় বড় শিল্প, সিমেন্ট, স্টিল ইত্যাদি বিরাট বিনিয়োগ হচ্ছে, কিন্তু কর্মসংস্থান কম। অতএব কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে।

শেষ কথা হচ্ছে এবারের বাজেটের মূল লক্ষ্য কী হওয়া উচিত? শুধু প্রবৃদ্ধি নয়, আমাদের বণ্টনের দিকে নজর দিতে হবে। দিন দিন আয় ও সম্পদের যে বৈষম্য বাড়ছে, সেটি কমিয়ে আনতে হবে। অতএব সামাজিক নিরাপত্তা খাত, দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। কর্মসংস্থানের দিকে বেশি নজর দিতে হবে। সরকারের অর্থের অপচয় রোধ করতে হবে। সরকার অনেক প্রজেক্ট নেয়, অনেক ব্যয়বহুল কাজ হাতে নেয়, যেটির সুফল জনগণ পায় না। সেগুলো পরিহার করতে হবে। আমাদের সরকারি ঋণ—দেশীয় ঋণ, বিদেশি ঋণ—দুটিই কিন্তু দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে, যদিও আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ডে বিদেশি ঋণ এখনো কম। তবু আমাদের ঋণের বোঝা দিন দিন বাড়ছে। অতএব যতটুকু সম্ভব কমিয়ে বাজেটে ব্যালান্স করা যায়, ঘাটতিটা যত দূর সম্ভব কম রাখা যায় এবং অর্থটা যেন সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। দুর্নীতি দূর করতে হবে, যেকোনো কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করতে হবে।

আর সর্বশেষ হলো সার্বিক কল্যাণমুখী একটি রাষ্ট্র গঠন করার পথে এগিয়ে যেতে হবে। বাজেটকে মানুষের সার্বিক কল্যাণমুখী করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, বাজেটে এক বছরেই কিন্তু সব করা যাবে না। সরকারের অনেক ইচ্ছা থাকতে পারে, কিন্তু মানুষের কল্যাণমুখী মূল জিনিসগুলো বাজেটে নিশ্চিত করতে হবে। এ বছরের বাজেটে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ সম্পন্ন হবে এবং আগামী বছরের জন্য ভিত্তি স্থাপন করা হবে, পর পর কয়েকটি বছর এমন বাজেট নিলে কিন্তু আমাদের উন্নয়নের যে অভীষ্ট লক্ষ্য আছে, সেটি অর্জন করতে পারব।

 লেখক : অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক

news24bd.tv/aa