করোনা ভাইরাস: কখন সব কিছু খুলে দেয়া যাবে!

করোনা ভাইরাস: কখন সব কিছু খুলে দেয়া যাবে!

অনলাইন ডেস্ক

বিবিসি'র একটা রিপোর্ট দেখে আমি রীতিমত আঁতকে উঠেছি! সেই সকাল বেলা রিপোর্ট'টি দেখেছি। এখন দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হবার পথে। এই পুরো সময়টায় চুপচাপ বসে ছিলাম। এখন লিখতে বসেছি।

রিপোর্ট'টি করা হয়েছে ইতালি'র নেপলস শহরের উপর ভিত্তি করে। প্রায় তিন মাস লকডাউন থাকার ফলে শহর'টির অনেক মানুষের কাছেই খাবার নেই।

সামর্থ্যবান কেউ কেউ হয়তো একটা জায়গায় কিছু খাবার রেখে যাচ্ছে; যাদের দরকার তারা এসে নিয়ে যাচ্ছে। ওই খাবার নেবার সময় অনেকের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।

কেউ হয়তো পুরো ব্যাপারটার আকস্মিকতা'ই এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

এক পিজা দোকানের মালিক বলছিল

-এতো দিন বন্ধ থাকায় আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। আবার কবে স্বাভাবিক হবে সেটাও জানি না। এর চাইতে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে'ই ভালো হতো।

ইতালি অতি অবশ্য'ই ইউরোপের ধনী দেশগুলোর মাঝে পড়ে না। তবে পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে ইতালি একটি অতি ধনী রাষ্ট্র।

ওই রিপোর্ট দেখার পর- আমার সঙ্গে সঙ্গে নিজ দেশ বাংলাদেশের কথা মনে হয়েছে। সেই তখন থেকে আমি ভয়ে আঁতকে আছি।

লম্বা একটা সময় চুপাচাপ বসে থেকে- এখন লিখতে বসেছি।

আমাকে বলতেই হচ্ছে আমি নিয়মিত লেখকদের মাঝে একদম প্রথম থেকেই লিখে আসছি করোনা নিয়ে। যখন কেউ'ই হয়তো তেমন কিছু বলছিল না।

সব কিছু বন্ধ করে দেয়া, স্কুল-কলেজ বন্ধ দেয়া, কারফিউ দেয়া ইত্যাদি আরও অনেক কিছু নিয়েই লিখেছি।

কিন্ত ওই রিপোর্ট দেখার পর মনে হলো- ইতালির মতো ধনী দেশের মানুষজনদের'ই যদি এই অবস্থা হয়; তাহলে বাংলাদেশের মতো একটা দেশে আরও কিছু দিন এই অবস্থা চললে তো অনেকেই না খেয়ে মারা যাবে!

এটা চিন্তা করে'ই আমি ভয়ে আঁতকে আছি।

শুনেছি উত্তর বঙ্গে নাকি অনেক খেঁটে খাওয়া মানুষ এক হয়ে সব কিছু খুলে দেয়ার কথা বলেছে।

এভাবে চলতে থাকলে হয়তো- একটা সময় দেশে চুরি-ডাকাতিসহ অন্যান্য ক্রাইম অনেক বেড়ে যাবে। ইতালির নেপলস শহরেও এমনটা হচ্ছে।

কোটি কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশে এমন অবস্থা হলে তখন সব কিছু নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে না।

এরপর মনে হলো- ভাইরাসে যা হবার হোক, অন্তত এমন সামাজিক বিশৃঙ্খলার হাত থেকে নিজদের দেশ রক্ষা পাক।

আমি সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্র। সমাজ বিজ্ঞান'ই আমি পড়াই।

মেডিকেল কিংবা পাবলিক হেলথ আমার বিষয় না।

কিন্তু আমি এটাও জানি- এতো দ্রুত যদি সব খুলে দেয়া হয়; তখন হয়তো ভাইরাসের বিস্তার আরও বেড়ে যাবে। হাসপাতালগুলোতে জায়গা দেয়া যাবে না। অনেক মানুষ মারা যাবে।

তাহলে কখন সব কিছু খুলতে হবে?

সহজ উত্তর হচ্ছে- আক্রান্তের সংখ্যা যখন পর পর ১৪ দিন কমতে থাকবে। যখন আমরা অনেক'কে টেস্ট করাতে পারবো। সংখ্যা কমে গেলে যখন আমরা আক্রান্ত ব্যক্তিদের টেস্ট করে, তাদের কাছাকাছি আসা লোকজনদের ট্রেস করতে পারবো; তখন'ই কেবল সব কিছু খুলে দেয়া যেতে পারে।

আমার এখানে গত এক সপ্তাহ ধরে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা সিঙ্গেল ডিজিটে নেমে এসছে। গত পরশু ছিল দুইজন। গতকাল ৮ জন। আজও বোধকরি ২ জন'ই শনাক্ত হয়েছে। অথচ আমাদের এখানে এখনও জরুরি অবস্থা চলছে।

আগামী ১৮ তারিখ পর্যন্ত চলবে। তাহলে আমাদের বাংলাদেশে এখন কি করা উচিত?

আক্রান্তের সংখ্যা কমা পর্যন্ত সব কিছু বন্ধ করে রাখা উচিত? কমতে শুরু করলে এরপর আস্তে আস্তে একেকটা সেক্টর খোলা উচিত?

কিন্তু সেই অপেক্ষা করতে গিয়ে যদি ভয়াবহ অর্থনৈতিক দুর্যোগ নেমে আসে; তখন সেই সামাজিক বিশৃঙ্খলা কি আমরা সামাল দিতে পারব?

সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে- ইতালির ওই রিপোর্ট আমাকে এতোটাই ভাবিয়ে তুলেছে যে আমি এক নাগাড়ে সকাল থেকে বিকাল অবদি চুপাচাপ বসে ছিলাম। এতোক্ষণ কেবল ভেবেছি- তাহলে আমাদের কি করা উচিত? এই প্রশ্ন আমি আমার নিজেকে'ই করেছি।

এরপর এই লেখা লিখতে বসেছি।

আমার ধারণা - আর কিছু দিন এভাবে বন্ধ থাকলে মানুষজন'কে জোর করেও ঘরে রাখা যাবে না। পেটের দায় বড্ড বেশি'ই কঠিন! উল্টো নানান জায়গায় আন্দোলন হবে। নানান সব বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে। সেটা সামাল দেয়া বরং আরও কঠিন হবে। তখন না পারা যাবে ভাইরাস কন্ট্রোলে, না পারা যাবে সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা করা।

এর চাইতে বরং সব কিছু খুলে দেয়া হোক।

আমি গত প্রায় আড়াই মাস ধরে যা যা লিখে এসেছি করোনাভাইরাস নিয়ে- আমি জানি আমার এই লেখা সেটার সঙ্গে যাচ্ছে না। আমি এও জানি- সব কিছু খুলে দিলে এর ফলাফল কি হতে যাচ্ছে।

হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যা হু হু করে বেড়ে যাবে। আমাদের পরিচত কিংবা প্রিয়জন অনেকেই আক্রান্ত হবে, এমনকি হারিয়েও যাবে এই পৃথিবী থেকে। কারন এই রোগের চিকিৎসা এখনও আবিষ্কৃত হয়নি।

তাহলে কি করা?

আচ্ছা একটা কাজ করলে হয় না- যাদের বয়েস ৫০ এর অধিক কিংবা যাদের আগে থেকে'ই কোন না কোন স্বাস্থ্য সমস্যা (ডায়াবেটিস কিংবা হার্টের সমস্যা) আছে; তাদের না হয় আমরা কাজের বাইরে রাখলাম। সেই সঙ্গে তাদের পরিবারের সদস্যদের বলে দেয়া হবে- তারা যেন বাইরে গেলে কঠিনভাবে স্বাস্থ্যবিধি চলে। বাসায় ফিরলে যেন কোন ভাবেই বয়স্কদের কাছে না ভিড়ে বা এই টাইপ কিছু।

কিন্তু গরীব মানুষগুলো?

আমি জানি, এরপরও অনেকেই আক্রান্ত হবে। কিন্তু কোনভাবেই সামাজিক বিশৃঙ্খলা'কে মেনে নেয়া যাবে না। কারণ এর ফল হবে করোনার চাইতেও ভয়াবহ। অন্তত বাংলাদেশের মতো দেশের পক্ষে সেটা কাটিয়ে উঠতে বছরের পর বছর লেগে যেতে পারে।

সুইডেন নামক দেশটি লকডাউনে যায়নি। তারা সব কিছু খোলা রেখেছে। সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি এবং মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি। সুইডেনে অবশ্য জনসংখ্যা এমনিতেই কম। এবং সে দেশে মানুষ এমনিতেও কেউ কারো গায়ে গায়ে লেগে থাকে না। এরা থাকে'ই একা একা। এরপরও এদের মৃতের সংখ্যা অনেক বেশি।

আমরা না হয় সুইডিস মডেল ফলো করে দেখি। সব কিছু ওপেন করে দেই।

আমি যে এই লেখা লিখছি, আমার নিজের'ই খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি সত্যি'ই বুঝতে পারছি না সমাজ এবং স্বাস্থ্য; এই দুটোর মাঝে কোনটাকে প্রাধান্য দেয়া উচিত!

আমি এটাও জানি মানুষ নিয়েই না সমাজ। মানুষ না থাকলে সমাজ কিসের।

আবার এটাও আমি জানি- ৮৫ ভাগ মানুষ এরপরও বেঁচে থাকবে। না হয় তাদের নিয়েই নতুন পৃথিবী কিংবা সমাজ গড়ে উঠবে।

কিন্তু বাদ বাকি ১৫ ভাগ মানুষ? এদের আমরা এভাবে নিজ হাতে হত্যা করবো?

এরাও তো কারো বাবা-মা, ভাই-বোন কিংবা ভালোবাসার মানুষ! আমার আসলে সত্যি'ই জানা নেই, এর উত্তর কি হওয়া উচিত।

আমি এই লেখা লিখছি আমার সমূদয় সকল আবেগ মিশ্রিত করে। গত কয়েকদিন ধরে সরকারের কর্তা ব্যক্তি, আমলা, নানান বাহিনীর সদস্য আমার নানা লেখায় মন্তব্য করেছে

-বাংলাদেশ নিয়ে আপনার লেখার দরকার নাই। আপনি এস্তনিয়া নিয়ে লিখেন। ইউরোপ নিয়ে লিখেন। ওদের জন্য কাজ করেন। বাংলাদেশের জন্য আপনাকে ভাবতে হবে না।

সাধারণত এই সব মন্তব্য আমি এড়িয়ে যাই। কারণ আমি মতামত লিখি। নানান মতের মানুষ নানান মন্তব্য করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এরা যদি খুব সাধারণ মানুষ হতো, আমি আসলে'ই কিছু মনে করতাম না। কিন্তু বড় বড় পোস্টে চাকরি করা মানুষগুলো কিভাবে এমন মন্তব্য করে আমার ঠিক জানা নেই।

আমি বিদেশে থাকি, ঠিক আছে। কিন্তু আমার বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, প্রিয়জন সবাই তো দেশেই থাকে। সেই দেশেই তো আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা।

এখন বিদেশে থাকি বলে- দেশ নিয়ে ভাবা যাবে না? চিন্তা করা যাবে না?

এই যে ইতালির একটা রিপোর্ট দেখলাম- কেন তাহলে প্রথমে'ই আমার মনে নিজ দেশ বাংলাদেশের চিত্র ভেসে উঠেছে?

আপনারা'ই তো নানান বিপদে পড়লে বিদেশে থাকা এই আমাদের সাহায্য চেয়ে বসেন। আপনাদের অর্থনীতির চাকা ঘুরে আমাদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার কারণে।

এই কঠিন পরিস্থিতে কিনা আমরা হয়ে গেলাম- বিদেশি! আমাদের বাংলাদেশ নিয়ে চিন্তা করার কোন অধিকার নেই, স্রেফ বিদেশে থাকি বলে!

আমাদের কি দেশের জন্য কোন অবদান নেই?

যা হোক, যা বলছিলাম- আমার মনে হয় দেশের অর্থনীতি খুলে দেয়া'ই ভালো।

এই দেশে যাদের বেঁচে থাকার তারা এমনি'ই বেঁচে থাকবে। যাদের মোরে যাবার কথা, তারা এমনিতেই মারা যাবে।

মাঝখান থেকে পুরো দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করে আরও কিছু মানুষকে হত্যা করার কোন মানে হয় না।

আবার আমি এও জানি, আজকেই তো পড়লাম পত্রিকায়- নওগাঁর ২০ বছর বয়েসি এক তরুণ শ্রমিক রাস্তার মাঝখানে যখন জানতে পেরেছে করোনা ভাইরাস ধরা পড়েছে তার শরীরে; সে ওই জায়গা থেকে এক চুলও নড়েনি। সেখানকার ইউএনওকে ফোন করে বলেছে- স্যার, আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেন।

এতটুকু বয়েস। শ্রমিক মানুষ। অথচ সে বুঝতে পেরেছি- এক চুল হাঁটলেও ভাইরাস ছড়াতে পারে। এক জায়গাতেই সে দাঁড়িয়ে ছিল। এই মানুষগুলোকে আমরা মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেব?

এ এক কঠিন সমীকরণ।

অঙ্ক পরীক্ষার অনেক কঠিন সমীকরণ হয়ত আমরা মিলিয়েছি। করোনা যুদ্ধ নামক এই অংকের সমীকরণ যে আর মিলতে চাইছে না!

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

 

নিউজ টোয়েন্টিফোর/কামরুল