রাজনৈতিক কর্মী যখন ছিঁচকে চোর

রাজনৈতিক কর্মী যখন ছিঁচকে চোর

মহিউদ্দিন খান মোহন

ছিঁচকে চোর সম্পর্কে একটি মজার ঘটনা উল্লেখ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম জেফারসন ক্লিনটন, মানে  বিল ক্লিনটন তাঁর আত্মজীবনী ‘মাই লাইফ’-এ। ক্লিনটন তখন আরকানসাসের ফায়েটেভিলেতে আইনের প্রফেসর হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছেন। সেখানে তিনি নিরিবিলি পরিবেশে ছোট্ট একটি বাড়িতে বসবাস করেন।

এলাকাটিতে ছিঁচকে চোরের ব্যাপক উপদ্রব ছিল।

এক সন্ধ্যায় ক্লিনটন বাড়ি ফেরে অনুমান করলেন কেউ তার বাড়িতে হানা দিয়েছিল। সে আবার আসতে পারে-এ ভেবে ক্লিনটন একটি চিরকুট লিখে ঘরের ফায়ার প্লেসে টেপ দিয়ে আটকে রাখলেন; যেন চোরের নজরে পড়ে। চিরকুটে তিনি লিখেছিলেন, ‘প্রিয় চোর, ঘরের সবকিছু ঠিকঠাক মতো আছে। আমি জানি না তুমি গতকাল সত্যি এসেছিলে কি না।
যদি না এসে থাকো, তাহলে তুমি এলে যা যা পাবে সেগুলো হলো- ৮০ ডলার দামে দেড় বছর আগে কেনা একটা টিভি, ৪০ ডলার দামের তিন বছররের পুরনো একটি রেডিও, একটি ছোট্ট রেকর্ড প্লেয়ার যার দাম, ৪০ ডলার, তিন বছরের পুরানো, এবং অনেক আজেবাজে মাল, যার দু’য়েকটির দাম ১০ ডলারের বেশি হবে না। প্রায় সবগুলো কাপড়-চোপর তিন বছরের পুরনো। যা জেলে যাওয়ার ঝুঁকি নেওয়ার মতো নয়। - উইলিয়াম জে ক্লিনটন’।


আরো পড়ুন :

এখনো কেউ গ্রেপ্তার নয়, প্রশ্ন ওঠছে জনমনে


কিন্তু সে চিঠিতে কাজ হয়নি। পরদিন সন্ধ্যায় কাজ থেকে ফিরে এসে ক্লিনটন দেখেন চোর তার কথা শোনেনি। সে রেডিও, টিভি, রেকর্ডার সব নিয়ে গেছে।

ছিঁচকে চুরি একটি ঐতিহ্যবাহী অপরাধমূলক পেশা। আমাদের দেশে এ ধরনের চোরের উপদ্রব অতীতে বেশ ভালোই ছিল। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ছিঁচকে চোরের উপদ্রব এতটাই তীব্র ছিল যে, প্রায় প্রতি রাতেই ওই ধরনের চুরির ঘটনার কথা শোনা যেত। মাটির ভিটেতে সিঁধ কেটে কিংবা জানালার শিক কেটে চোরেরা নিরবে প্রবেশ করে গৃহস্তের সর্বনাশ করে কেটে পড়ত।

ইদানীং অবশ্য গ্রামাঞ্চলে সিঁধেল চুরির প্রকোপ কমে এসেছে। আগের মতো অতটা উপদ্রব নেই। ছিনতাইকারী, ডাকাত-দস্যূদের বাড়বাড়ন্তের কারণে সিঁধেল চোরেরা হাত গুটিয়ে নিয়েছে মনে হয়। তারপরও রাজধানী ঢাকাসহ শহরাঞ্চলে গৃহবাসীর অনুপস্থিতিতে জানালার গ্রীল কেটে বা দরজার তালা ভেঙে চুরি-ডাকাতির কথা প্রায়ই শোনা যায়। কখনো কখনো এসব ছিঁচকে চোরের উপদ্রব বৃদ্ধির খবর সংবাদপত্রের পাতায়ও জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়।


আরো পড়ুন :

শুরু হোক পদক্ষেপ নেওয়ার উদ্যোগ


তবে, এবার যে ছিঁচকে চুরির চেষ্টার খবরটি গণমাধ্যমে এসেছে তা যেমন রোমহর্ষক, তেমনি অবিশ্বাস্যও বটে। দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহিদা খানমকে হত্যা প্রচেষ্টার দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করা ঘটনাকে এখন ছিঁচকে চুরির প্রচেষ্টা বলে প্রচারের চেষ্টা চলছে। গত ২ সেপ্টেম্বর বুধবার গভীর রাতে নিজ বাসভবনে দুর্বত্তদের হাতে আহত হন ইউএনও ওয়াহিদা খানম। দুর্বৃত্তরা তার মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে তাকে মারাত্মকভাবে আহত করে; যাকে ‘অ্যাটেম্প টু মার্ডার’ বলা অত্যুক্তি হবে না। একই ঘটনায় বাসায় উপস্থিত ইউএনও ওয়াহিদারা পিতাও দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হন। দুর্বৃত্তরা বাসভবনের দ্বিতীয় তলার বাথরুমের ভেন্টিলেশন ভেঙে বাসায় প্রবেশ করে এ জঘন্য ঘটনা ঘটায়। ইউএনও ওয়াহিদা বর্তমানে রাজধানীর নিউরো সায়েন্স ইষ্টিটিউটে চিকিৎসাধীন। তার অবস্থা উন্নতির দিকে হলেও তিনি এখনও শঙ্কামুক্ত নন- এ তথ্য দিয়েছেন চিকিৎসকগণ।

news24bd.tv

ঘটনার পর বাসভবনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পরীক্ষা করে সন্দেহভাজন ছয়জনকে আটক করেছিল র‌্যাব। এদের মধ্যে তিনজনই স্থানীয় যুবলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। এরা হলেন ঘোড়াঘাট উপজেলা আওয়ামী যুবলীগ আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর আলম, একই উপজেলার সিংড়া ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি মাসুদ রানা, কর্মী আসাদুল ইসলাম, ইউএনও’র বাসার প্রহরী নাহিদ হোসেন পলাশ, রঙমিস্ত্রি নবীরুল ইসলাম, ও সান্টু কুমার দাস। এদের মধ্যে ঘটনার সাথে সম্পৃক্তি না থাকায় জাহাঙ্গীর আলমসহ তিনজনকে ছেড়ে দিয়েছে র‌্যাব। আসাদুল ইসলাম, নবীরুল ইসলাম ও সান্টু কুমারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যুবলীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা থাকলেও এই ঘটনায় তার সম্পৃক্তি না থাকায় তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা।

এদিকে র‌্যাবের হাতে আটক হওয়ার পরপরই জাহাঙ্গীর আলমসহ তিন যুবলীগ নেতাকে সংগঠন থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। অন্যদিকে গ্রেফতারকৃত যুবলীগ নেতা আসাদুল ইসলাম ঘটনার সাথে তার জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে জানিয়েছে, চুরির উদ্দেশ্যেই তারা ইউএনওর বাসায় হানা দিয়েছিল।

প্রশ্ন উঠেছে দুর্বৃত্তরা কি নিছক ছিঁচকে চুরির উদ্দেশ্যেই ইউএনও ওয়াহিদার বাসায় হানা দিয়েছিল? ছিঁচকে চোরার বাধা পেলে গৃহস্থকে কোনো কোনো সময় আক্রমণ হয়তো করে। তবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব চোর নিজেদের প্রাণ নিয়ে দ্রুত সটকে পড়ে। কিন্তু ঘোড়াঘাট ইউএনও’র বাসার ঘটনায় ঠিক তার উল্টোটা দেখা যায়। ছিঁচকে চোর হয়ে ঢুকে ওরা ডাকাতে পরিণত হয়ে প্রাণসংহারি মূর্তি ধারণ করেছিল। ফলে নিছক চুরির উদ্দেশ্যে ওরা হানা দিয়েছিল, এটা বিশ্বাস করা কষ্টকর নয় কি? তাহলে কী উদ্দেশ্য ছিল ওদের?

এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে ৫ সেপ্টেম্বরের দৈনিক পত্রিকাগুলোর পাতায় গভীর অভিনিবেশ সহকারে চোখ বুলাতে হবে। প্রায় সবগুলো দৈনিকের প্রতিবেদনে প্রশ্ন তোলা হয়েছে- ইউএনও ওয়াহিদার ওপর এ হামলা পরিকল্পিত কী না। তিনি কি স্থানীয় কোনো শক্তিধর মহলের বিরাগভাজন হয়েছিলেন? ঘটনার গুরুত্ব হালকা করার জন্যই কি এখন ছিঁচকে চুরির উদ্দশ্যের কথা প্রচার করা হচ্ছে? পত্রিকাগুলোর প্রতিবেদনে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে  অনেক বিষেয়ই ইউএনওর মতান্তর থাকার কথা বলা হয়েছে।

সন্ত্রাস, মাদক ব্যবসা, খাসজমি দখলসহ নানা অপকর্মের বিরুদ্ধে ইউএনও ওয়াহিদার অনড় অবস্থান তাকে ওই মহলটির চক্ষুশূলে পরিণত করেছিল। এলাকাবসীর ধারণা  এসব কারণেই  ইউএনও ওয়াহিদার  বাসায় এ পরিকল্পিত হামলা। সচেতন মহলের মনে যে প্রশ্নটি দেখা দিয়েছে তাহলো, ঘটনার তদন্ত গভীরভাবে না করেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে কেন বলা হচ্ছে দুর্বৃত্তরা চুরির উদ্দেশ্যেই সেখানে ঢুকেছিল? এটা কি আসল বা নেপথ্যের কারণ সম্পর্কে জনগণের দৃষ্টিবিভ্রম তৈরি করার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত? এ সম্পর্কে ওইদিনের দেশ রূপান্তর লিখেছে, অবৈধ বালু মহাল, খাসজমি দখল, মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন ইউএনও ওয়াহিদা খানম। তার এ কঠোর অবস্থানের কারণে ঘোড়াঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার আবদুর রাফে শাহেন শাহ'র সঙ্গে বৈরিতা সৃষ্টি হয়ে। যুবলীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলমকে দিয়ে তিনি এসব কাজকর্ম করিয়ে থাকেন।

এলাকাবাসী মনে করেন, এ কারণেই ইউএনওর বাসায় হামলার ঘটনাটি ঘটেছে। তবে তা হত্যার উদ্দেশ্যে, না ভয়ভীতি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে সে সম্পর্কে কেউ নিশ্চিত নন। অপরাপর পত্রিকাগুলোও একই প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। সচেতন মহল মনে করেন, কেবল মাত্র  ছিঁচকে  চুরির উদ্দেশ্যে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সুরক্ষিত বাসভনে দুষ্কৃতকারীরা হানা দিয়েছে তা বিশ্বাসযোগ নয়। এ ঘটনার পেছনে অবশ্যই অন্য কোনো কারণ রয়েছে, যা সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে বেরিয়ে আসতে পারে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘটনাকে ছিঁচকে চুরি বলে সার্টিফিকেট দিয়ে দেয়ার পরে এ নিয়ে আর বিশেষ কোনো তদন্ত হবে কিনা বলা যায় না। যদি তা না হয়, তাহলে এই ‘হত্যা প্রচেষ্টার’ ঘটনাকে সামান্য ‘চুরির উদ্দেশ্যে হানা’ বলে মেনে নিয়েই দেশবাসীকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে।


আর যদি ঘটনা সত্যিই চুরির উদ্দেশ্যজনিত হয়ে থাকে, তাহলে তা আমাদের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য নিদারুন লজ্জার তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ থেকে এটা পরিস্কার হয়ে গেছে যে, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোতে এখন রংবাজ, মাস্তান, দুর্বৃত্তের পাশাপাশি ছিঁচকে বা সিঁধেল চোরেরাও জায়গা করে নিতে পেরেছে। এখন এসব চোর-ছেচ্চরদের পাশে সত্যিকারের রাজনৈতিক কর্মীরা তাদের নাম আর রাখতে চাইবেন কি না সেটা একটি প্রশ্ন। কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, এসব চোর-বাটপার কীভাবে রাজনৈতিক দলের সদস্য পদ পায়। এর উত্তরের জন্য বেশি মাথা ঘামানোর প্রয়োজন পড়ে না। রাজনৈতিক দলগুলোর স্থানীয় নেতারা নিজেদের গোপন কারবারে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার জন্যই এইসব দৃষ্কৃতকারীকে দলে ঠাঁই দিয়ে থাকেন।

রাজনীতিতে এখন নীতি-আদর্শের স্থান যে একেবারেই গৌণ হয়ে পড়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দলগুলোর নেতাকর্মীরা অবশ্য মুখে আদর্শবাদিতার খৈ ফুটিয়ে থাকেন। তবে কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা। তারা প্রয়াত নেতাদের নীতি-আদর্শ বাস্তবায়নে প্রাণপাত করার জিকির অষ্ট প্রহর করে থাকেন। কিন্তু কাজকর্মে তাদের মূল নীতি ‘মুখে শেখ ফরিদ, বগলে ইট’। দল বা নেতার আদর্শ তাদের মৌখিক স্লোগান, মৌলিক নয়। দলের ঘোষণাপত্রে যেসব আদর্শের কথা বলা আছে, তা এরা কস্মিনকালেও পাঠ করে বলে মনে হয় না। পাঠ করলেও তা অন্তরে ধারণ করেনা। তাই এ বি”্যুতি। হিন্দুধর্মের পবিত্র গ্রন্থ শ্রীমদ্ভবগত গীতায় একটি স্লোক আছে-‘চৈতন্য রহিত স্লোকা: প্রোক্তবর্ণস্তু কেবলা;  ফলং নৈব পযচ্ছতি লক্ষ কোটি শৈতরুপি’। অর্থাৎ ‘চেতনাহীন স্লোকসমূহ কেবল বর্ণমাত্র। অতএব শত লক্ষ কোটিবার পাঠ করলেও ফল প্রদানে সমর্থ হয় না’।

আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা দলের আদর্শ পাঠ করে কিনা সন্দেহ আছে। করলেও তা হৃদয়ে ধারণ করেনা একেবারেই। আর তাই সমাজের চিহ্নিত দুর্বৃত্ত-দুস্কৃতকারিরা ‘কর্মী’র ছদ্মবেশে অনায়াসে ঠাঁই পেয়ে যায়। তাদেরই প্রতিচ্ছবি দিনাজপুরের ওই যুবলীগ কর্মীরা। আফসোস এরাই নাকি আমাদের যুব সমাজের নেতা!

লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

মত ভিন্নমত বিভাগের লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। এই বিভাগের সব লেখা লেখকের নিজস্ব চিন্তার প্রতিফলন।

সম্পর্কিত খবর