যাদের দোয়া দ্রুত কবুল হয়

যাদের দোয়া দ্রুত কবুল হয়

শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

প্রতিটি বৈধ কাজের জন্য সুন্নত দোয়া রয়েছে। সেগুলো পড়ে ওই কাজগুলো করলে কাজে যেমন বরকত ও সফলতা আসে, তেমনি সওয়াবও লাভ হয়। আল্লাহ তাআলার কাছে কোনো কিছু একাগ্রতার সঙ্গে চাইলে তা কবুল হয়ে থাকে। নিজের জন্য দোয়া নিজেই করা উত্তম।

নফল নামাজ পড়ে, কোরআন শরিফ তিলাওয়াত করে, দান-সদকা-খয়রাত অথবা কোনো নেক আমল করে ইখলাসের সঙ্গে আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করলে তা ব্যর্থ হয় না।

কোরআন মজিদে পূর্ববর্তী অনেক নবী-রাসুলের জীবনকথা বর্ণিত হয়েছে, প্রসঙ্গক্রমে জীবনের নানা ঘটনায় নানা সংকটে তাঁদের দোয়া ও মোনাজাতের বিশেষ বর্ণনা উল্লিখিত হয়েছে। মানুষের বিপদ-আপদ ও বিভিন্ন সমস্যায় আল্লাহ পাকের সাহায্য কামনা করতে আল্লাহ পাক নিজেই নির্দেশ দিয়েছেন। ‘আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করি এবং তোমারই সাহায্য চাই’ কথাটি কোরআন কারিমে সূরা ফাতিহার চতুর্থ আয়াতের মাধ্যমে তিনিই আমাদের শিখিয়েছেন।

রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, দোয়া ইবাদতের মগজ। তিনি আরও বলেছেন, দোয়াই ইবাদত। (বুখারি ও মুসলিম)।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট কিছু চায় না, আল্লাহ তাআলা তার প্রতি অসন্তুষ্ট হন। ’ (তিরমিজি, খণ্ড: ৫, পৃষ্ঠা: ৪৫৬, হাদিস নম্বর: ৩৩৭৩)।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যার জন্য দোয়ার দ্বার খোলা হয়েছে (অর্থাৎ যার দোয়া করার তাওফিক হয়েছে), তার জন্য রহমতের দ্বার খোলা হয়েছে। আল্লাহর কাছে যেসব দোয়া চাওয়া হয়, তন্মধ্যে তাঁর কাছে সর্বাধিক পছন্দীয় হলো আফিয়াত; অর্থাৎ নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যের জন্য দোয়া করা। ’ (জামে তিরমিজি, খণ্ড: ৫, পৃষ্ঠা: ৫৫২, হাদিস নম্বর: ৩৫৪৮)।

হজরত সালমান ফারসি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দোয়া ব্যতীত অন্য কোনো বস্তু তাকদিরের লিখনকে ফেরাতে পারে না এবং নেক আমল ছাড়া অন্য কোনো বস্তু হায়াত বৃদ্ধি করতে পারে না। ’ (তিরমিজি, খণ্ড: ৪, পৃষ্ঠা: ৪৪৮, হাদিস নম্বর: ২১৩৯)। তিনি আরও বলেন, ‘তাকদিরের ফয়সালাকে কেবল দোয়াই পরিবর্তন করতে পারে। ’

যাদের দোয়া দ্রুত কবুল হয় 

পিতা-মাতার দোয়া সন্তানের জন্য। সন্তানের দোয়া পিতা-মাতার জন্য। মুসাফিরের দোয়া। বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির দোয়া। মজলুম (অত্যাচারিত-নির্যাতিত-নিপীড়িত) ব্যক্তির দোয়া। (আবু দাউদ, ১: ১৫৩৬)। হাজির দোয়া (হজের সময় ও হজ সম্পাদনের পর ৪০ দিন পর্যন্ত)। মুজাহিদের দোয়া। রোগীর দোয়া। মুসলমান ভাইয়ের জন্য তার অনুপস্থিতিতে অন্য মুসলমানের দোয়া। (মিশকাত, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ২২৬০; মুসলিম, ৪: ২৭৩৩)। রোজাদারের দোয়া ইফতারের সময়। (তিরমিজি, ৪: ২৫২৬)। অসহায় ও দুর্দশাগ্রস্ত ব্যক্তির দোয়া। (সূরা নামল, আয়াত: ৬২)। ইমামে আদিলের (সুশাসক ও ন্যায়বিচারক) দোয়া। (তিরমিজি, ৪: ২৫২৬)। বন্ধুর জন্য বন্ধুর দোয়া। নেককার ব্যক্তির দোয়া।

দোয়ার আদব 

বিভিন্ন হাদিসে বর্ণিত দোয়ার আদবসমূহ: দোয়ার শুরু ও শেষে আল্লাহর প্রশংসা (হামদ-সানা) এবং রাসুল (সা.)-এর প্রতি দরুদ শরিফ পাঠ করা। (তিরমিজি, ৫: ৩৪৭৬)। দোয়ার আগে কোনো নেক আমল (নামাজ, সদকা ইত্যাদি) করে নেওয়া অথবা সালাতুল হাজত পড়ে নেওয়া। নিজ নেক আমলের অছিলা দিয়ে দোয়া করা। (বুখারি, ৮: ৫৯৭৪)। শুধু দুনিয়ার জন্য দোয়া না করা। (সূরা বাকারা, আয়াত: ২০১)। কাকুতি-মিনতিসহ গোপনে দোয়া করা। (আরাফ, আয়াত: ৫০)। অন্তরে ভয় ও আশা নিয়ে দোয়া করা। (সূরা আরাফ, আয়াত: ৫৬)। শুধু মুসিবতের সময়কেই দোয়ার জন্য নির্দিষ্ট না করা। (সূরা ইউনুস, আয়াত: ১২, তিরমিজি, ৫: ৩৩৮২)।

স্বাভাবিক ভাব ও সাধারণ দোয়া করা, অর্থাৎ ভাষায় ইচ্ছাকৃত ছন্দ ও মাধুর্যতা না আনা। (বুখারি, ৮: ৬৩৩৭)। দোয়ায় হঠকারিতা না করা, কারণ দোয়া হলো আবেদন, দাবি নয়। নিজের অকল্যাণ আর অপরের অমঙ্গলের দোয়া না করা। (বুখারি, ৮: ৬০১০)। পাপের শাস্তি দুনিয়াতে না চাওয়া; বরং ÿক্ষমা চাওয়া। (মুসলিম)। জান-মাল ও সন্তানসন্ততির জন্য বদদোয়া (অভিশাপ) না করা। (মুসলিম)। নিজের মৃত্যুর জন্য দোয়া না করা। (বুখারি, ৭: ৫৬৭২)। একই দোয়া বারবার (অন্তত তিনবার) করা। ক্রন্দন করা কিংবা ক্রন্দনের অবস্থা আনয়ন করা। গুনাহসমূহ থেকে তওবা করে দোয়া করা।

নিজের দীনতা-হীনতা ও অসহায়ত্ব প্রকাশ করা। দোয়ার মধ্যে ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ ব্যবহার করা। দোয়ায় সব মুসলমানকে শামিল করা। প্রথমে নিজের জন্য, অতঃপর পিতা-মাতা, অতঃপর স্ত্রী-সন্তান, অতঃপর সব মুমিন নর-নারীর জন্য দোয়া করা। সম্মিলিত দোয়ার ক্ষেত্রে শুধু নিজের জন্য দোয়া না করে সব মুসল্লিকে দোয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা। অর্থাৎ ‘আমি’-এর পরিবর্তে ‘আমরা’ এবং ‘আমার’ এর পরিবর্তে ‘আমাদের’ শব্দ ব্যবহার করা। (তিরমিজি, ২: ৩৫৭)। দোয়াকারী ও দোয়া শ্রবণকারী উভয়ের জন্য ‘আমিন’ বলা।  

দোয়ার মধ্যে মাসনূন দোয়াসমূহের শব্দাবলি অবলম্বন করা। নিজের ছোট-বড় সব প্রয়োজন একমাত্র আল্লাহর কাছে চাওয়া। আসমাউল হুসনারঅছিলা দিয়ে দোয়া করা মুস্তাহাব। (আরাফ: ১৮০)। ইসমে আজমের মাধ্যমে দোয়া করা। (তিরমিজি, ৫: ৩৪৭৫)।   ‘আমিন’ বলে দোয়া শেষ করা। (আবু দাউদ, ১: ৯৩৮)।

সুখে-দুঃখে দোয়া 

দোয়া দ্বারা যেমন মুসিবত দূর হয়, তেমনি মুসিবত আসাও বন্ধ হয়। তাই দোয়া কেবল বিপদ-আপদের সময় নয়, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সময়ও করা উচিত। অর্থাৎ শোকর গোজারি করা উচিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তির কাছে এটা পছন্দ হয় যে আল্লাহ তাআলা বিপদ-আপদের সময় তার দোয়া কবুল করবেন, তবে সে যেন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সময়ও দোয়া করে। তিনি আরও বলেন, দোয়া মুমিনের হাতিয়ার বা অস্ত্র, দীনের খুঁটি এবং আসমান ও জমিনের নূর। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি পছন্দ করে যে দুঃখের সময় যেন আল্লাহ তাআলা তার দোয়া কবুল করেন, তবে সে যেন সুখের সময় অধিক পরিমাণে দোয়া করে। ’ (জামে তিরমিজি, খণ্ড: ৫, পৃষ্ঠা: ৪৬২, হাদিস নম্বর: ৩৩৮২)।

মুমিনের কোনো দোয়া বিফলে যায় না 

আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করলে তা কখনো বিফলে যায় না। কখনো দোয়ায় প্রার্থিত জিনিসটি পাওয়া যায়, আবার কখনো তা জমা করে রাখা হয় পরকালের জন্য; কখনো দোয়ার বরকতে বিপদ কেটে যায় বা অন্য কিছু লাভ হয়। দোয়া কবুল হওয়ার ব্যাপারে খুবই আশাবাদী হয়ে দোয়া করতে হবে, নিরাশ বা হতাশ হওয়া যাবে না। হাদিস শরিফে আছে, ‘যখন কোনো মুসলমান দোয়া করে, যদি তার দোয়ায় গুনাহের কাজ কিংবা সম্পর্কচ্ছেদের আবেদন না থাকে, তাহলে আল্লাহ তাআলা তিনটি প্রতিদানের যেকোনো একটি অবশ্যই দান করেন। সঙ্গে সঙ্গে দোয়া কবুল করেন এবং তার কাঙ্ক্ষিত জিনিস দিয়ে দেন। দোয়ার কারণে কোনো অকল্যাণ বা বিপদ থেকে হেফাজত করেন। তার আখিরাতের কল্যাণের জন্য তা জমা করে রাখেন। ’ (আহমাদ, ৩: ১৮, হাদিস: ১১১৪৯)

হাদিস শরিফে আছে, কিয়ামতের দিনে হাশরের ময়দানে কোনো সাধারণ মুসলমান দেখতে পাবে তার অঢেল নেকি জমা আছে; কিন্তু সে বুঝতে পারছে না এসব নেকি কোথা থেকে এসেছে। তখন সে ফেরেশতাদের জিজ্ঞেস করবে: আমার এসব নেকি কোথা থেকে এসেছে? ফেরেশতাগণ উত্তর দেবেন, আপনি বিভিন্ন সময়ে যেসব দোয়া করেছেন, তার কিছু কিছু আল্লাহ নগদে দিয়েছেন আর কিছু জমা রেখেছেন, সেগুলো নেকিরূপে আপনার আমলনামায় যোগ করা হয়েছে। তখন সেই ব্যক্তি বলবে, কতই না উত্তম হতো যদি আমার কোনো দোয়াই দুনিয়ার জন্য কবুল না হয়ে আখিরাতের জন্য জমা থাকত। (মুসলিম, তিরমিজি)।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক: আহ্‌ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।

 

আরও পড়ুন:


যে সময় দোয়া পড়লে দ্রুত কবুল হয়

যে দোয়া পড়লে কখনো বিফলে যায় না!

কঠিন বিপদ থেকে রক্ষা পেতে যে দোয়া পড়বেন!


news24bd.tv কামরুল