জনাব, কিছু ফেলে গেলেন কি?

জনাব, কিছু ফেলে গেলেন কি?

Other

ঢাকায় আগে বাসের ভিতরে অনেক কিছু লেখা দেখতে পেতাম- ‘বাকী চাহিয়া লজ্জ্বা দেবেন না’, ‘ব্যবহারে বংশের পরিচয়’ … ‘জনাব কিছু ফেলে গেলেন কি’… । তখন কথাগুলো অতটা মনোযোগ আকর্ষণ করত না। আজ এত কাল পরে মনে হয়- এই বাক্যগুলোতে মানুষের নিগুঢ় বিশ্বাস কিংবা চিরায়ত মূল্যবোধের প্রকাশ থাকতো। যেমন মেয়েরা সূচিকর্মে নানাকিছু লিখে টাঙ্গিয়ে রাখত বাড়ির বৈঠকখানায়! কথাগুলো আমাদের সামান্য সময়ের জন্য হলেও থমকে দিত, গভীর ভাবনায় ফেলে দিত! 

 ‘জনাব, কিছু ফেলে গেলেন কি!’ এই কথাটা তো আমার প্রায়ই মনে হয়।

খুব সকালে যখন বাসা থেকে কাজের জায়গার উদ্দেশ্যে বের হই, দরজার কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি! চারপাশে তাকাই। কখনও ব্যাগ হাতড়াই। ঠান্ডা মাথায় ভাবার চেষ্টা করি। আইডি কার্ড, মোবাইল, কফির বোতল, মেট্রোকার্ড… আরও কত কি… সবকিছু ঠিকঠাকভাবে নিয়েছি তো! কিছু ফেলে গেলাম নাতো! 

দিনশেষেও এভাবে থমকে যেতে হয়।

ক্লাসরুমে ছাত্ররা চলে গেলে চেয়ারগুলি টেবিলের ওপর রাখা থাকে। জানালার পর্দা নামানো। দিনের তুমুল কোলাহল শেষে শান্ত চারদিক। ক্লাসরুম ছাড়ার আগে আবারও চারদিকে তাকাই, থমকে যাই, মনে মনে ভাবি- ‘কিছু ফেলে গেলাম কি!’ 
প্রতি বারই যখন বাইরে যাই, আবার ফিরে আসার সময় এই কথাটাই বার বার কেন মনে হয়! আমি একটু বেশীরকম ভুলোমনা বলেই হয়ত বেশী সতর্ক থাকার চেষ্টা করি! গত বছর আগস্টে নিউইয়র্ক থেকে এক রোড ট্রিপে বের হয়েছিলাম আমরা। সাতদিনের মধ্যে বেশ কয়েকটি স্টেটের অনেকগুলো শহর ভ্রমন করেছিলাম। বাফেলো হয়ে ওহাইও’র রাজধানী কলম্বাস, শিকাগো, ডেট্রয়েট, হ্যারিসবার্গ, ফিলাডেলফিয়া হয়ে আবার নিউইয়র্কে ফিরে আসি।  

প্রতিটি শহরে গিয়ে এক রাতের জন্য হোটেলে উঠতাম। লাগেজ থেকে সব কিছু বের করে সংসার সাজাতাম। আবার সকালে সব গুটিয়ে রওনা হতাম নতুন শহরের উদ্দেশ্যে। যাবর আগে হোটেল রুমের সবকিছু তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখতাম। দরজা থেকে বের হবার সময় বার বার পিছনে ফিরে তাকাতাম, শুধু মনে হত- ‘কিছু ফেলে গেলাম কি!’ 

আজকাল রৌদ্রোজ্জ্বল দিন থাকলে বাড়ি ফেরার পথে ইস্ট রিভারের  তীরে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকি। রোজার দিন বলে অত তাড়া থাকেনা ঘরে ফেরার। বসে বসে কি করি জানেন? নদীর ধারে বেড়াতে আসা বৃদ্ধ মানুষদের দেখি। একেকজন মহামারী জয় করতে চলেছেন দুর্জয় সাহসে। মমতা মাখানো ভালোবাসায়  দুই চোখ ভিজে আসে।  

বাংলাদেশ থেকে এখন প্রতিদিন মৃত্যুর খবর আসে। ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, মিতা হক, শামসুজ্জামান খান, কবরী, তারেক শামসুর রহমান, ওয়াসিম, এসএম মহসিন… যাদের শুন্যস্থান কোনদিন পূর্ণ হবার নয়। এক শোকের হাহাকার না নিভতেই, আরেকটি দু:সংবাদ। নিউইয়র্কে বাস করতেন আহমেদ মুসা ভাই, তিনিও না ফেরার দেশে নাম লেখালেন। ওনার সাংবাদিকতার সময় আমার দেখা হয়নি। তবে ওনার বই পড়েছি, খুব ভালো লিখতেন। যদিও এই শহরে সেভাবে কেউ লেখক হিসেবে মূল্যায়ন করত না তাঁকে।  
মৃত্যু সংবাদ শুনি আর মনে হয়, আমি যে শোকে কাতর হচ্ছি, আমাকেও তো চলে যেতে হতে পারে যে কোন সময়। যতই মনে হবে, কিছু ফেলে গেলাম কি, কিন্তু ফেলে তো যেতেই হবে সব।  

মনিজা রহমান নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

news24bd.tv/আলী

এই রকম আরও টপিক