অ্যাক্সেল আর্ল্যান্ডসন, তার চমকপ্রদ চারুবৃক্ষ

অ্যাক্সেল আর্ল্যান্ডসন, তার চমকপ্রদ চারুবৃক্ষ

Other

সুইডিশ আমেরিকান অ্যাক্সেল আর্ল্যান্ডসন ছিলেন পেশায় সিমচাষী। গাছের প্রতি ভালোবাসা ও প্রাকৃতিক কলম পর্যবেক্ষণ থেকে নিজের বাড়িতে তিনি ক্ষুদ্র পরিসরে জোড়া দেওয়ার মাধ্যমে গাছকে শৈল্পিক আকৃতি দেওয়ার এক জৈব-অভিযাত্রার সূচনা করেন। পররর্তীতে তার অনন্য আকৃতি দেওয়া গাছগুলো বিশ্বকে চমকে দেয়। গাছকে বাঁকানো এবং তাদের নানা ছলে অস্বাভাবিক দিকে বাড়তে প্ররোচিত করার ম্যাজিক আয়ত্ত করে ফেলেছিলেন তিনি।

আর এর ফলে তার হাতে-গড়া গাছগুলো রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিল।

news24bd.tv

অ্যাক্সেল ১৮৮৪ সালে এক সুইডিশ দম্পতির ঘরে জন্ম নেন। তিনি বেড়ে ওঠেন মিনিসোটায়। কিন্তু তার বয়স যখন ১৭ বছর তখন তার পরিবার ক্যালিফোর্নিয়ার টারলকেরর কাছে হিলমার কলোনিতে চলে আসে।

প্রথম জীবনে তিনি ভূমি-জরিপ পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু পরে তিনি গাছের কাণ্ড ও শাখার গ্রাফটিং করার প্রতি ঝুঁকে পড়েন। ১৯২৮ সালে মেয়ে উইলমার জন্মের অল্প ক’দিন আগে হিলমারে তার গ্রাফটিংয়ের মায়াবী জগতে ডুবে যান তিনি। আলেক্স দৈবনির্দেশেই এ কাজে উদ্বুদ্ধ হন বলে দাবি করেন। এরপর জীবনের টানা ৪০টি বছর এই গ্রাফটিংই ছিল তার একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান।

news24bd.tv

অ্যাক্সেল আর্ল্যান্ডসন ছোট ছোট কচি গাছগুলোকে নিজস্ব পন্থায় দেন অভিনব আকৃতি। তিনি গাছকে ছেঁটে, বাঁকিয়ে, জোড়া দিয়ে আকার-আকৃতি এমন করে ফেলেছিলেন যে, সেগুলো দেখে তাজ্জব বনে যাবে যে কেউ। অ্যাক্সেল ইচ্ছেমতো গাছের বৃদ্ধি মন্থর ও দ্রুত করতে পারতেন। শিশুরা তাকে এ কাজ কীভাবে করেন জিজ্ঞেস করলে তিনি বলতেন, ‘ও, আমি এদের সঙ্গে কথা বলি। ’ গাছেরা সত্যি সত্যি তার কথা মতো আকৃতি গ্রহণ করতো। অল্প দিনের মধ্যেই দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে মানুষ তার অনন্য ‘দারুকলা’র ফসল এসব নান্দনিক চারুতরু বা চারুবৃক্ষ দেখতে ভিড় জমায়।

news24bd.tv

১৯৪৫ সালে আর্ল্যান্ডসনের স্ত্রী-কন্যা ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা ক্রুজে বেড়াতে গিয়ে দেখতে পায় লোকজন মিস্টেরি স্পটে গাঁটের পয়সা খরচ করে সারবেঁধে হেলানো ভবনের মতো অদ্ভুত জিনিস দেখছে। তারা বাড়ি ফিরে এসে অ্যাক্সেলকে পরামর্শ দেন তিনি যদি তার গাছগুলো যথেষ্ট সংখ্যক পর্যটক চলাফেরা করে এমন কোনো রুটে রাখেন, তাহলে সেগুলো মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে এবং তারা টাকার বিনিময়ে সেগুলো দেখবে।

news24bd.tv

কথাটি অ্যাক্সেলের মনে ধরে। তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা ক্লারা ও সাগরের মাঝখানের স্কটস ভ্যালির প্রধান সড়কে একটি ছোট জমি কিনে নেন। গাছগুলো  নিজের খামার থেকে তুলে এনে সেখানে রোপণ করেন। অ্যাক্সেল এখানেই তার সেরা গাছগুলোর কলম প্রক্রিয়া শুরু করেন। মিডিয়া অচিরেই তার এই অভিনব গাছগুলোকে সার্কাস ট্রি নামে ডাকতে শুরু করে।

news24bd.tv

অ্যাক্সেল ছয়টি সাইকামোর প্রজাতির গাছের চারা এক জায়গায় বৃত্তাকারে একটু দূরে দূরে লাগান। চারাগুলো বাড়তে শুরু করলে তিনি পাশাপাশি দুটি চারাকে টেনে কাছাকাছি নিয়ে এলেন। মাটি থেকে একটু ওপরে গাছের বাকল চেঁছে গাছ দুটি একসঙ্গে বেঁধে রাখলেন। এভাবে ছয়টি গাছ তিনটি জোড়ায় বাঁধলেন। গাছগুলোর মাথা কিন্তু আলাদাই থাকল। এবার প্রতি জোড়া লাগানো গাছ থেকে একটি গাছ টেনে পাশেরটির সঙ্গে আগের মতো একইভাবে বেঁধে দিলেন। এভাবে ধাপে ধাপে বিপরীতক্রমে একই কাজ করে তিনি পাঁচ ধাপে সম্পন্ন করলেন।

news24bd.tv

এভাবে বাঁধতে বাঁধতে একসময় দেখলেন সব গাছ মিলে এক অসাধারণ রূপ নিয়েছে। বেঁধে দেয়া অংশটুকু এমনভাবে জোড়া লেগে গেছে যে, ওই অংশটুকু একটি গাছই মনে হচ্ছে। ওভাবেই গাছগুলো বাড়তে থাকল। এর কিছুদিন পর আবার তিনি জোড়া লাগানোর কাজ শুরু করলেন, তবে একটু অন্যভাবে। ছয়টি গাছকেই একটি গাছ মনে হচ্ছে। যতটুকু জোড়া বাঁধা, সে অংশটুকু হীরকাকৃতির খোপবিশিষ্ট একটি ঝুড়ির মতো হয়েছে। তাই তিনি সে গাছগুলোর নাম দিয়ে দিলেন ‘বাস্কেট ট্রি’ বা ঝুড়িগাছ।

news24bd.tv

এভাবে তিনি দুটি গাছকে জুড়ে করলেন দ্বিপদী গাছ বা ‘টু-লেগড ট্রি’ এবং চারটি গাছকে বেঁধে সৃষ্টি করলেন চতুষ্পদী বৃক্ষ বা ‘ফোর-ফুটেড ট্রি’। পাশাপাশি দুটি গাছ লাগিয়ে একটির সঙ্গে অন্যটির ডাল জোড়া দিয়ে তৈরি করলেন মই বৃক্ষ বা ‘ল্যাডার ট্রি’। এভাবে তিনি আরো অনেক অদ্ভুত ও বিস্ময়-জাগানিয়া গাছের বৃক্ষশিল্প সৃষ্টি করেন। বৃক্ষজগতে এটা প্রাকৃতিকভাবে কিছুতেই সম্ভব নয়। ১৯৪৬ সালের ১ এপ্রিল তার সৃষ্টি সবার দেখার জন্য উন্মুক্ত করে দেন অ্যাক্সেল। খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। দলে দলে সবাই গাছের সার্কাস দেখার জন্য ভিড় করতে লাগল।

news24bd.tv

১৯৫৭ সাল নাগাদ অ্যাক্সেল ৭০টির বেশি অভিনব গাছ সৃষ্টি করেছিলেন। গাছগুলো ব এতটাই নান্দনিক আর আকর্ষণীয় হয়েছিল যে ১৯৪০ ও ১৯৫০-এর দশকে ‘রিপ্লি’স বিলিভ ইট অর নটে’ স্থান করে নিয়েছিল বারো বার। লাইফ ম্যাগাজিনে গাছগুলো নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন প্রতাশিত হলে এগুলোর খ্যাতি বেড়ে যায়। যুক্তরাষ্ট ও বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রকাশনায় এই নান্দনিক ও অনন্য বৃক্ষশিল্পের কথা প্রকাশিত হয়, প্রশংসা কুড়ায়। এমনকি ডিজনি গাছগুলো কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলো।

১৯৬৩ সালে অ্যাক্সেল তার সারা জীবনের মেধা-মনন ও পরিশ্রম ও অনন্য দক্ষতার ফসল প্রিয় সার্কাস ট্রিগুলো আর্থিক টানাপোড়েনের কারণে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। এর পর তার স্বাস্থের অবনতি হতে থাকে। অবশেষে ১৯৬৪ সালে অ্যাক্সেল মারা যান। বন্ধ হয়ে যায় জীবিত গাছের অভিনব শিল্পচর্চা। কেননা এ শিল্পের ফর্মুলা তিনি কাউকে জানাননি। সারা জীবন এ ব্যাপারে তিনি একেবারে কুলুপ এঁটে ছিলেন। এ কাজে কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করতেন তিনি। গুপ্তচরদের কাছে কোনো মতে তার কাজের রহস্য ফাঁস না হওয়ার জন্য পর্দার আড়ালেই সম্পন্ন করতেন যাবতীয় কাজ।

অ্যাক্সেলের মৃত্যুর পর বেশ কয়েকবার গাছগুলোর মালিকানা পরিবর্তন হয়। দুঃখজনকভাবে বিভিন্ন সময় অধিকাংশ গাছ মারা যায়। অবশেষে এক ধনাঢ্য ব্যক্তি মাইকেল বোনফেন্টি চড়া দামে গাছগুলো কিনে নেন। তার সৃজনশীল মেধার কারণে বাকি গাছগুলোর মধ্যে অধিকাংশের জীবন বাঁচানো সম্ভব হয়। ১৯৮৫ সালের ১০ নভেম্বর গাছগুলোকে তাদের চূড়ান্ত গন্তব্য গিলরয় গার্ডেন ফ্যামিলি থিম পার্কে নিয়ে আসা হয়। এখন মাত্র ২৫টি গাছ বেঁচে আছে পার্কের প্রধান আকর্ষণ হয়ে। সার্কাস ট্রিগুলো একনজর দেখতে দূরদূরান্ত থেকে প্রতিবছর অনেক পর্যটক ভিড় করেন।

news24bd.tv তৌহিদ

সম্পর্কিত খবর