বৈশ্বিক মন্দা কী এবং সেটা কেন হয়?

প্রতীকী ছবি

বৈশ্বিক মন্দা কী এবং সেটা কেন হয়?

অনলাইন ডেস্ক

সারা বিশ্বে বর্তমানে আলোচিত শব্দ  'বিশ্বমন্দা'। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানরা বৈশ্বিক মন্দা নিয়ে সতর্ক অবস্থানে যাওয়ার কথা বলছেন। সম্প্রতি বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের এক জরিপে দেখা গেছে, শীর্ষস্থানীয় প্রতি ১০ জন অর্থনীতিবিদের সাতজনই মনে করছেন ২০২৩ সালে দেখা দেবে বিশ্বমন্দা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান নেড ডেভিস রিসার্চ বলছে, আগামী বছর বিশ্বমন্দা হওয়ার আশঙ্কা ৯৮ শতাংশ।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বিশ্বমন্দার সুনির্দিষ্ট একটি সংজ্ঞা দিয়েছে। এটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা। আইএমএফ বলছে, কোনো একটি নির্দিষ্ট বছরে সারা বিশ্বের গড় মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্বক হওয়া মানেই বিশ্বমন্দা। এক্ষেত্রে মাথাপিছু জিডিপির হিসাবটি দেখা হয় ক্রয় ক্ষমতার সমতা বা পিপিপির ভিত্তিতে।

এর সঙ্গে অর্থনীতির আরও কিছু সূচকের অবস্থাও দেখা হয়। যেমন- শিল্প উৎপাদন, বাণিজ্য, মূলধনপ্রবাহ, জ্বালানি তেলের ব্যবহার, বেকারত্বের হার, মাথাপিছু বিনিয়োগ এবং মাথাপিছু ভোগ।  

এ সংজ্ঞা অনুসারে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এ পর্যন্ত বিশ্বমন্দা হয়েছে পাঁচ বার। ১৯৭৫, ১৯৮২, ১৯৯১, ২০০৯ এবং ২০২০ সালে। ২০০৯ সালের আগে মন্দা নিয়ে আইএমএফের ব্যাখ্যা ছিল কিছুটা ভিন্ন। সে অনুসারে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হয়েছে আরও কয়েকটি বিশ্বমন্দা।

আবার একক কোনো দেশের মন্দা আর বিশ্বমন্দা এক নয়। একক দেশের ক্ষেত্রে 'টু-কোয়ার্টার্স মেট্রিক' বা দুই প্রান্তিকের হিসাব বিবেচনায় নেন অর্থনীতিবিদরা। তাঁদের মতে, পর পর দুই প্রান্তিকে জিডিপির আকার কমে গেলে সে দেশের অর্থনীতি মন্দায় পড়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ (এনবিইআর) সংজ্ঞাটি কিছুটা অনুসরণ করে। তবে সংস্থাটির মতে, এর সঙ্গে বেকারত্বসহ আরও কিছু সূচকেও মন্দার প্রতিফলন থাকতে হবে। যে কারণে অনেক সময় দেখা যায় যে, পর পর দুই প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্বক হলেও সংশ্নিষ্ট অন্য কিছু সূচক ইতিবাচক ধারায় থাকায় মন্দার ঘোষণা দিচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্র।

আধুনিক অর্থব্যবস্থায় অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে প্রথম মন্দা দেখা দেয়। আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী মন্দা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে। এর ব্যাপ্তি ছিল ১৯২৯ থেকে ১৯৩৯ সাল। ১৯২৯ সালে অক্টোবরে মাত্র দুই দিনে ধ্বংস হয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজার। কয়েক দিনের মধ্যে শিল্প কলকারখানায় উৎপাদনে ধস নামে। মাত্র এক বছরের মাথায় বেকার হয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের এক কোটি মানুষ। এ মহামন্দার প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ ও জনজীবনেও মারাত্মকভাবে পড়ে।

একসময় ইউরোপের ঋণ সংকটের কারণে ইতিহাসের প্রথম মন্দা দেখা দেয়। এটি অবশ্য অর্থনৈতিক বিপর্যয় হিসেবেও অভিহিত। ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়। মূলত উচ্চ মূল্যস্ফীতি আর অর্থনৈতিক সংকটের কারণে অর্থনৈতিক স্থবিরতা তৈরি হয়। ১৯৯৭ সালে বিদেশি মুদ্রার অভাবে এশিয়ার বাজারে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। এ সময় থাইল্যান্ড থেকে কোটি কোটি ডলারের বিনিয়োগ সরিয়ে নিতে থাকেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। থাইল্যান্ড থেকে শুরু হওয়া এ অর্থ সংকট দ্রুত পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ পূর্ব-এশিয়ার দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। এর জেরে এ দেশগুলোতে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়। ১৮৫৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মার্কিন অর্থনীতিতে ৩৪ বার মন্দা দেখা দেয়।

উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অনেক উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাধারণত বেশি হয়ে থাকে। উন্নত দেশে অর্থনীতির আকার ইতোমধ্যে অনেক বড় হওয়ার কারণেও স্বাভাবিকভাবে প্রবৃদ্ধির হার তুলনামূলক কম হয়। কাজেই বিভিন্ন দিক বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বমন্দার বিষয়টি দেখতে হয়। এর আগে প্রতিটি মন্দার যেমন আলাদা আলাদা কারণ ছিল, তেমনি মিলও ছিল কিছু ক্ষেত্রে। ১৯৭৫ সালের মন্দার প্রধান কারণ জ্বালানি তেলের দাম। আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে যেসব দেশ ইসরায়েলকে সমর্থন জানিয়েছিল, সেসব দেশে জ্বালানি তেল রপ্তানি বন্ধ করে দেয় আরব দেশগুলো। ফলে জ্বালানি তেলের উৎপাদন ও সরবরাহ ভয়াবহভাবে বিঘ্নিত হয়। তেলের দাম ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় ধস নামে অনেক দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে।

১৯৮২ সালের মন্দারও প্রধান কারণ ছিল তেলের দাম। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামিক বিপ্লবের সময় থেকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে থাকে। মূল্যস্ম্ফীতির হার বেড়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, জাপানসহ উন্নত দেশগুলো ব্যাপক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করে। বিভিন্ন দেশে সুদের হার বেড়ে গিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে দেখা দেয় বিপর্যয়। বেড়ে যায় বেকারত্ব। ১৯৯১ সালের মন্দার পেছনে কারণ ছিল পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধের ফলে ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং তেলের দাম বেড়ে যাওয়া। ২০০৯ সালের বিশ্বমন্দার বড় কারণ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক খাতে ধস।

কভিড-১৯-এর কারণে ২০২০ সালে একের পর এক লকডাউনে স্তব্ধ হয়ে যায় স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড। বিশ্ব অর্থনীতির ওপর ধ্বংসাত্বক প্রভাব ফেলে এই অতিমারি। ফলে বিশ্বমন্দা ছিল অবধারিত।

আগামী বছর যে বিশ্বমন্দার আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে, তার মূল কারণ কভিড-১৯ এর প্রভাবে দেশে দেশে অর্থনৈতিক যে বিপর্যয় নেমে এসেছিল তা থেকে পুনরুদ্ধার হতে না হতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানি তেল ও বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার বাড়াতে গিয়ে সংকট আরও বেড়েছে। শিল্প উৎপাদন ও ভোগ্যপণ্য ব্যবসায় পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। অন্যদিকে প্রায় সব দেশের মুদ্রার বিপরীতে বেড়েছে ডলারের দাম। আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়ে টান পড়েছে অনেক দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। আগে থেকে অর্থনৈতিক সমস্যায় থাকা দেশগুলোর অবস্থা আরও নাজুক হয়ে পড়েছে। সব মিলিয়ে আরেকটি বিশ্বমন্দা এড়ানো যেন কঠিন হয়ে পড়েছে।

বিশ্বমন্দার প্রভাব একেক দেশের ক্ষেত্রে একেক রকম হয়। আয়, সঞ্চয়, বিনিয়োগ, উৎপাদন, আর্থিক খাত, বাজার, কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্যে সরাসরি এর প্রভাব পড়ে। অতীতে কোনো কোনো দেশে দুর্ভিক্ষের উৎসও ছিল বিশ্বমন্দা। কাজেই সামান্য সংকেত পেলেই বিশ্বমন্দা মোকাবিলায় আগেভাগে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন বিশেষজ্ঞরা।

news24bd.tv/আলী