মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও খালেদা জিয়ার জন্মদিন প্রসঙ্গ

মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও খালেদা জিয়ার জন্মদিন প্রসঙ্গ

অ্যাম্বাসেডর ওয়ালিউর রহমান

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর। সময়টা মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিন। তখন আমি বিখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক এডগার স্নো'র সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সিদ্ধান্ত নেই। যিনি তার জীবনের শেষ সময়গুলো জেনেভার কাছে অবস্থিত ল্যাক লেমনে কাটিয়েছিলেন।

৬০ বছর বয়সী মানুষটাকে দেখে একটু ক্লান্ত লাগছিলো। আমার দেখা করার উদ্দেশ্য ছিল তাকে ধন্যবাদ জানানো। তিনি আমাকে ১৬ ডিসেম্বর ডাকেন এবং আমাকে ও বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানান। তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন।
সাংবাদিক এডগার স্নো প্রথম মার্কিন সাংবাদিক যিনি মাও সেতুং এর লং মার্চও পর্যবেক্ষণ করেছিলেন।

সাক্ষাতের পর তিনি আমাকে এক কাপ কফি দিলেন। তিনি আবারো আমাদের স্বাধীনতার জন্য আমাকে অভিনন্দন জানালেন। তিনি কখনো শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখেননি। তবে তাঁর বিষয়ে স্নো পড়েছেন। শারীরিক অবস্থার কারণে স্নো ওই অবস্থায় বাংলাদেশে যেতে পারবেন না বলে তখন দুঃখ প্রকাশ করেন।

মাও সেতুং নিয়ে স্নো বলেন, তিনি চীনের জাতীয় স্বার্থে বিশ্বাস করতেন। তিনি জনগণের সরকারে বিশ্বাস করতেন। তবে কুয়োমিনতাং সরকারের মতো নয়। যারা চীনের স্বার্থকে খুব ভালো বুঝত।

যখন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিসকাউন্ট পামারস্টন যিনি কিনা পরে দেশটির প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন, তিনি বলেছিলেন, তাদের স্থায়ী কোনো বন্ধু নেই এবং শত্রু নেই। তাদের জাতীয় স্বার্থ হচ্ছে তাদের স্থায়ী বন্ধু।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও এমন নীতিতে জোরালোভাবে বিশ্বাস করতেন। তিনি প্রায়ই আমার সঙ্গে জেনেভায় সাক্ষাৎ হলে চীন কেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না এবং কি করা যায় সে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতেন। এ নিয়ে তিনি বেশ উদ্বিগ্ন ছিলেন বলে মনে হতো। তিনি বলতেন যে, চীনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই'র কাছে জানতে হবে কেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না। পরে যখন চীন বাংলাদেশের জাতিসংঘের সদস্য পদ পাওয়া বিষয়েও দুইবার ভেটো দিল তখন বঙ্গবন্ধু আমাকে ডাকালেন এবং তার একজন বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বললেন, যিনি এ বিষয়ে সাহায্য করতে পারবে। তিনি বিস্মিত হন এ নিয়ে যে, কেন চীন পাকিস্তানের পক্ষ নিচ্ছে যারা বাংলাদেশের ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে এবং গণহত্যা চালিয়েছে।

তিনি মজা করে ইউরোপের কনসার্টের কথা তুলে ধরলেন। কীভাবে সেই দিনের শক্তি ইউরোপকে তাদের জাতীয় স্বার্থ অনুসারে বিভক্ত করেছিল সেটিও বললেন।

বঙ্গবন্ধু এমন একটি বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন যেটি হবে স্বাধীন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকবে বাঙ্গালিদের হাতেই। তাঁর ছয় দফা দাবি বাঙালিদের স্বার্থ সংরক্ষণ, উদ্ধার এবং রক্ষার জন্য করা হয়েছিল। এক সময় ভারতের সবচেয়ে উৎপাদনশীল এলাকা ছিল বাংলা। তবে এই বাংলাতেই শাসকরা লুটপাট চালিয়ে সবকিছু ধংস করে দিয়ে যায়। বাঙ্গালিদের সেই হারিয়ে যাওয়া সোনালী সময়গুলো ফেরাতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।

১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ তিনি আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। নিরস্ত্র বাঙ্গালিদের ওপর নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানীরা। পাকিস্তানের সেনা কর্মকর্তা লেফট্যানেন্ট জেনারেল গুল হাসান খানের ভাষায় বাংলাদেশ ছিল তাদের কলোনি। বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছর দেশ চালানোর সুযোগ পেয়েছিলেন। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী অনেক সমস্যায় থাকার পরেও বাংলাদেশ সাড়ে ৭ শতাংশ জিডিপি অর্জন করতে পেরেছিল।

দুর্ভাগ্যবশত পাকিস্তান এবং তার দোসর দেশগুলোর ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা অনুযায়ী কিছু তরুণ সেনা কর্মকর্তা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর অরক্ষিত বাড়িতে হামলা চালায়। হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। তার সহধর্মিণী বেগম মুজিবসহ পুরো পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে তখন হত্যা করা হয়। ওই হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর ওই খুনিদের বিচারের আওতায় আনা হয়। এদের মধ্যে ছয় জনকে এরিমধ্যে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। আর বাকি খুনিরা পাকিস্তান, কেনিয়া এবং লিবিয়াতে হয়তো পালিয়ে আছে।

তাই ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে শোক দিবস পালন করা হয়। এ দিন পুরো জাতি গভীর শ্রদ্ধায় শেখ মুজিব এবং বাংলাদেশ তৈরির জন্য তাঁর অবদানকে স্মরণ করে। এই দিনে বাংলাদেশিরা বসেন এবং তাঁর জন্য দোয়া করেন। জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করে রাখা হয় এবং খুব ভোরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে তাঁর জন্য দোয়া করতে অনেকে যান। পুরো দিনটাই শোকের। এছাড়াও এদিন আমরা ছোট পরিসরে সকলের সাথে মিলিত হই। বর্তমান সময়ে ওয়েবিনারের আয়োজন করা হয়। যেখানে বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য তার যে স্বপ্ন ছিলো তা নিয়ে আলোচনা হয়। এটা একটা কান্নার দিন। তার মৃত্যুকে স্মরণ এবং তা থেকে শক্তি অর্জন করার দিন।

বেগম জিয়া ১৫ আগস্ট তার জন্মদিন পালন করেন। এটা একটি পতঙ্গের ছোট আচরণের মতো যেমনটা জন লেউইস তাঁর বইতে বলেছেন। বেগম জিয়া ১৫ আগস্ট জন্ম নেননি। তাঁর অসংখ্য জন্মদিনের তারিখ রয়েছে। তিনি যখন রোম সফর করেছিলেন তখন তাঁর পাসপোর্টে ভিন্ন জন্ম তারিখ দেওয়া ছিল। এছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় দেখা গেছে যে, ১৯৪৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন খালেদা জিয়া। ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন করা খালেদা জিয়া চরম অসহিষ্ণুতা দেখান এবং জাতির পিতাকে অসম্মান করেন। এমনটা তিনি ঠাণ্ডা মাথায় করে আসছেন বিগত বছরগুলোতে।

পূর্ণ বয়স্করা জন্মদিনের তারিখ পরিবর্তন করে থাকেন। এর মধ্যে কিছু সত্য এবং কিছু মিথ্যা হয়। কিন্তু বেগম জিয়া সুবিধাবাদী মানুষের মতো মানবতার প্রাথমিক নৈতিক প্রয়োজনীয়তা না বুঝে ১৫ আগস্টকে তার জন্মদিন হিসেবে পালন করছেন।
২০২০ সালের ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার মিথ্যা জন্মদিনে কিছু দূতাবাস তাকে উপহার পাঠিয়েছে। আমি জানতে পেরেছি যে চীনের দূতাবাসও খালেদা জিয়াকে তাঁর এই জন্মদিনে উপহার পাঠিয়েছে। চীন বাংলাদেশের ভালো বন্ধু।

যখন চীন জাতিসংঘে আমাদের ভেটো দিয়েছিলো, সেই সময় থেকে বর্তমানে অনেক সময় পার হয়েছে। অনেকভাবে নতুন সম্পর্কও তৈরি হয়েছে। আমরা চীনকে ধন্যবাদ জানাই। ভারতীয় বন্ধুদের কান্না এবং রক্ত সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আবির্ভূত করেছে। দুই দেশের বীর যোদ্ধাদের রক্ত বাংলাদেশের সবুজ মাঠে মিশেছে এবং তা চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

১৫ আগস্টের সেই রাতে শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা জার্মানিতে ছিলেন। ভাগ্যক্রমে তাঁরা বেঁচে যান। শেখ হাসিনা এখন বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আর এতে অন্ধকার ধীরে ধীরে কাটছে। কিছুদিন আগেই বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের বিশালতা এবং উদারতা উদযাপন করা হয়েছে।

১৯৯৭ সালের ১৬ জানুয়ারি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূত হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলাকে বাংলাদেশের রজতজয়ন্তী উদযাপনে অংশ নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে যাই। তিনি তখন অমায়িকভাবে আমাদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। আমি যখন এসে পড়বো তখন তিনি আমাকে বলেন, 'শেখ মুজিব আমার চেয়েও বড় নেতা ছিলেন। কেন তোমরা তাকে হত্যা করলে?' আমি তখন চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার কাছে এর কোনো উত্তর ছিল না।

অতীত কখনো মুছে যায় না। প্রতি বছর ১৫ আগস্ট আমাদেরকে  বাংলাদেশের ঘৃণ্য একটি অধ্যায় মনে করিয়ে দেয়। মানুষ এই দিনে জাতির পিতা, যিনি বাংলাদেশকে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন তার নির্মম হত্যাকাণ্ডকে স্মরণ করে শোক প্রকাশ করে থাকেন। তাঁরা তাদের পরম শ্রদ্ধা জানান। তাঁরা বিভিন্ন বৈঠকের আয়োজন করে শোক প্রকাশ করেন। তাঁরা মসজিদ, মন্দির এছাড়া বিভিন্ন স্থানে জাতির পিতার জন্য সর্বশক্তিমানের কাছে দোয়া করেন। এটা বাংলাদেশের শোক দিবস। এই শোক দিবসে পুরো জাতি শ্রদ্ধা জানায়। আর এই দিনে খালেদা জিয়াকে উপহার পাঠিয়েছে চীনা দূতাবাস যেটা অন্যায়। আমি প্রার্থনা করি সাধারণ বন্ধুত্বের কথা বলে চীন যাতে আর এমন না করে।

লেখক: গবেষক, সাবেক রাষ্ট্রদূত