ঝুলন্ত মানুষ আর কতদিন

ঝুলন্ত মানুষ আর কতদিন

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

এখন মানুষকে ঝুলন্ত বাদুড়ের মতো দেখি। না আছে মাটিতে পা, না আছে আকাশকে ধরার স্বপ্ন। না আছে নিজের শেকড়ের প্রতি টান, না আছে প্রকৃতিকে বোঝার মতো মন। সব জায়গায় মানুষ কেমন যেন ঝুলে থাকতে চায়।

অনেক সময় মানুষকে মাকড়সার মতো মনে হয়। মাকড়সার তো ঝুলে থাকার  মতো একটা ঝাপসা জাল থাকে, মানুষের তাও থাকে না।  

প্রতিদিন এই ঝুলন্ত মানুষ চড়া দামে বিক্রি হয়। দাস প্রথাটা হয়তো এখন আর নেই কিন্তু দাসত্ব এখনও টিকে আছে মানুষের শরীরে, অস্থিমজ্জায়।

মানুষ কখনো ক্রীতদাস হয়ে ঝুলে থাকে, কখনো মানুষ টাকার লোভে কংকাল হয়ে ঝুলে থাকে, কখনো নিজের স্বার্থের জন্য কাপুরুষের মতো ঝুলে থাকে, কখনো মানুষ ক্ষমতার রশি ধরে দানবের মতো ঝুলে থাকে, কখনো মানুষ হিংসার আগুনে পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে ঝুলে থাকে, কখনো মানুষ সত্যের গলায় ফাঁস ঝুলিয়ে মিথ্যের ফানুস হয়ে ঝুলে থাকে, কখনো মানুষ জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে জোকারের মতো ঝুলে থাকে।

এভাবে প্রতিদিন মানুষ নেতিবাচকতার সাথে আপোষ করে ঝুলন্ত মাংসপিন্ড হয়। সেখানে না থাকে সুতোর বন্ধন, না থাকে মানবিক মূল্যবোধের দুর্ভেদ্য প্রাচীর। থাকে মরীচিকা। পরাজয় আর নিস্তব্ধতা, স্বপ্নভঙ্গ। ঠিক উল্টো দিকে থাকে জীবন যুদ্ধে প্রতিদিনের হার না মানা ঝুলন্ত লড়াই।  

একটা নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ বাঁচার তাগিদে ঝুলন্ত বাস ধরে সারা জীবন ঝুলতে ঝুলতে ক্লান্ত হয়। ঘাম ঝরে। রক্তক্ষরণ ঘটে শিরায়-উপশিরায়। তারপরও হারতে হারতে একদিন সে মানুষটা জিতে যায়। এটা তিলে তিলে ক্ষয়ে পড়া একটা অসহায় মানুষের ঝুলন্ত জীবনের স্বপ্নের জয়। যেখানে কষ্টের মধ্যে আনন্দ দোল খেয়ে যায়, মন ঘুড়ি হয়ে বাতাসে ভেসে বেড়ায়। একটা ঝুলন্ত নারীর লাশ। যে একটুকরো খুড়কুটো ধরে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেছিলো।

জামদানি শাড়ি, নাকে নোলক, হাতে রং-বেরঙের চুড়ি আর আলতামাখা পায়ে নুপুরের সুর তুলেছিল। কিন্তু নরখাদকের দল তা হতে দেয়নি। টুকরো টুকরো করে শুকুনির মতো তারা তাকে ছিঁড়ে খেয়েছে। বোবা মুখ আর চোখ সব আঁধারে হারিয়ে গেছে। সেখানে এখন আর কিছু নেই। সেখানে পড়ে আছে বিবর্ণ সময়, যেখানে ঝুলন্ত ইতিহাস  কালো অক্ষরের যাঁতাকলে প্রতিদিন মাথা কুটে মরে।  

সার্কাসের রং মাখা সং সাজা জোকারটা একটা সরু রড হাতে নিয়ে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টায় আরেকটা সুরু রডের উপর দিয়ে ঝুলন্ত অনিশ্চয়তায় হেঁটে চলে। মানুষকে হাসায় মানুষটা। কিন্তু তার ভিতরের দুঃখ, তীব্র দহন জ্বালা নিয়ে মানুষ কি কখনো ভাবে। জোকারটার মুখের হাসি দিয়ে তার দুঃসহ দুঃখকে লুকিয়ে রাখে। জীবনের বাস্তবতা আর কল্পনা সব কিছু এই ঝুলন্ত মানুষটার কাছে মূল্যহীন।

আর পিছনে ফেরা নয়। ঝুলন্ত মানুষগুলো মানুষ হয়ে উঠুক। বদলে যাক পৃথিবী। বদলে যাক মানুষ। মানুষ হয়ে উঠুক আরও মানবিক, আরো উদার। যেখানে ঝুলন্ত চিন্তা ঝুলন্ত স্বপ্নের সাথে প্রতিদিন জীবন গড়ার লড়াইয়ে নামবে অভূতপূর্ব আনন্দে। মেঘ থেকে ঝুলন্ত তারারা বৃষ্টি হয়ে আলো ছড়াবে মানুষের ভিতর ও বাহিরে। অন্তরে-অন্তরে।

লেখক: অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

news24bd.tv আহমেদ

সম্পর্কিত খবর