একজন শেখ হাসিনা, পদ্মা সেতু এবং আমার বরিশাল যাওয়ার গল্প..

একজন শেখ হাসিনা, পদ্মা সেতু এবং আমার বরিশাল যাওয়ার গল্প..

জসিম মল্লিক

বাংলাদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতি ঘটেছে। হাসিনা সরকার পুরো দেশকে এক সুতোয় বাঁধতে চাইছেন। একটা সমন্বিত নেটওয়ার্ক তৈরী করায় মনোনিবেশ করেছেন। কে না জানে যে একটা দেশের উন্নতি বা অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি অনেকটাই নির্ভর করে সে দেশের সুষ্ঠ যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর।

তাইতো উন্নত দেশগুলোর প্রথম নজর থাকে যোগাযোগের উপর। আমেরিকা, কানাডার মতো দেশগুলো রাস্তাঘাট তৈরী করে পরবর্তী দুইশত বছরের চিন্তা মাথায় রেখে।

কানাডা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ কিন্তু মানুষ মাত্র তিন কোটি স্ত্তুর লাখ। কিন্তু পুরো দেশ জুড়ে সুতোর মতো নেটওয়ার্ক।

কানাডায় যত রাস্তা আছে তা একত্র করলে চাঁদে যাওয়া যায়। আওয়ামী লীগ সরকার কয়েক দফায় ক্ষমতায় থাকার সুফল জনগন পেতে শুরু করেছে। তার উৎকৃষ্ট উদাহরন পদ্মা সেতু। স্বপ্নের পদ্মা সেতু। অনেক চ্যালেঞ্জের পদ্মা সেতু। শেখ হাসিনাকে স্যালুট জানাই। তার দৃঢ়চেতা মনোবলের কারণেই পদ্মা সেতু আজ বাস্তব রুপ পেতে চলেছে। পদ্মা সেতু যখনই চালু হোক না কেনো ঢাকা থেকে বরিশাল যাওয়া যাবে মাত্র তিন ঘন্টায়। ভাবা যায়!

বরিশাল যেতে কত ঝক্কি না পোহাতে হতো। একটা ঘটনা বলি। সেটা ১৯৯৪ সাল। একবার ঈদে আমার ছোট ছোট দুই বাচ্চা নিয়ে বরিশাল রওয়ানা হয়েছি। সদরঘাট পর্যন্ত আসতেই অবস্থা কেরোসিন। টু স্ট্রোক অটো রিক্সা ছিল তখন। তার ভট ভট আওয়াজ আর বিকট ধোঁয়ায় অর্ক বমি টমি করে অস্থির। অর্কর বয়স তখন তিন বছর। মহাখালি থেকে লঞ্চঘাট পৌঁছতেই সেদিন লেগেছিল তিন ঘন্টা। সদরঘাট পৌঁছে দেখি ভয়াবহ অবস্থা। মানুষের মাথা ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। এদিকে লঞ্চগুলো মানুষের চাপ এড়াতে নদীর মাঝখানে নোঙ্গর করে রেখেছে। সেখানে পৌঁছানোও বিরাট ঝুঁকি।  
আমি বললাম, জেসমিন চলো ফিরে যাই।  

জেসমিন দুঃখিত কন্ঠে বলল, এতো কষ্ট করে এসেছি ফিরে যাব! বরিশালে ঈদ করা হবে না! দেখো না কিছু করা যায় কিনা।  
আমরা অবশেষে একটা ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকায় উঠলাম। হুর হুর আরো কয়েকজন উঠে পড়লো। নদীল মাঝখানে গিয়ে নৌকা দুলছে মানুষের চাপে। যে কোনো সময় ডুবে যাবে! মনে হচ্ছিল আজই সলিল সমাধি ঘটবে। জেসমিন ভয়ে চিৎকার করছে। এদিকে ঘাটেই কুলিদের টানাটানিতে একটা বাক্স খুলে কাপড় চোপড় ছয়লাব হয়ে গেছে। এমন সময় আমাদের বিপদ দেখে কোষ্ট গার্ডের একজন তরুণ অফিসার ছুটে আসলো ইঞ্জিন বোট নিয়ে। আমাদের রক্ষা করল এবং লঞ্চে উঠিয়ে দিল। সেই অফিসারের কথা আজও মনে পড়ে।

এরপর থেকে সবসময় রকেট স্টিমারে বরিশাল যাওয়া শুরু করলাম। এক সময় দিনে স্টিমার সার্ভিস ছিল। অপূর্ব ছিল সেই জার্নি। সকাল ১১টায় সদরঘাট থেকে ছাড়ত সন্ধ্যা ছয়টায় বরিশাল পৌঁছত। তারপর দিনের সার্ভিস হয়ে গেলো রাতে। কেনো হলো কে জানে। সন্ধ্যা ছয়টায় ঢাকা থেকে ছেড়ে সকাল ছয়টায় বরিশাল পৌঁছে যায়। বারো ঘন্টার জর্নি। সদরঘাট পর্যন্ত পৌঁছানোর ঝক্কিতো আছেই। আবার বরিশাল থেকে সন্ধ্যা ছয়টায় ছেড়ে সকাল ছয়টায় ঢাকা পৌঁছায়। ঢাকা বরিশাল যাওয়া যেনো এক যুদ্ধ এবং ব্যয়বহুল। শুধু তাই না, যারা প্রথম শ্রেনিতে জার্নি করতে চান তাদের জন্য টিকিট পাওয়া আকাশের চাঁদ পাওয়ার সমান। মতিঝিলে বিআইডব্লিউটিসির অফিস। সেখান থেকে ফার্ষ্টক্লাসের কিকিট কিনতে হয়।

একবারের একটা ঘটনা বলি. সেটা ১৯৯৬ সাল।
আলাউদ্দিন নামে একজন টিকিট ক্লার্ক ছিলেন তখন। তাকে গিয়ে বললাম ভাই, টিকিট লাগবে। একটা ডাবল কেবিন রিটার্ন সহ দেন।  
টিকেটতো নাই ভাই।
কেনো নাই!
বোঝেনইতো ঈদের সময় ক্রাইসিস থাকে।
কিন্তু আমার টিকিট চাই।
দিতে পারব না।
আমি একটু জেদি এটা সবাই জানে। লিগ্যাল ব্যাপারে জেদি।
রোজার শুরুতে আসলাম তাও বলছেন টিকিট নাই!
জানেনই তো নানা কোটা। আর্মির কোটা, মন্ত্রী, এমপি, ডিসি সাহেবদের কোটা!
আমি রেগে বললাম, হ্যাং ইয়োর মন্ত্রী!
কি বললেন!
টিকিট দেন।

আপনি বরং চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে যান। তাকে বলেন। আমি টিকিট দিলে আমার চাকরি চলে যাবে।  
আমি চারতলায় চেয়ারম্যান সাহেবের রুমে গেলাম। প্রথমে আমাকে তার পিএ পাত্তাই দিল না। আমার দিকে তাকাচ্ছেনা পর্যন্ত। টাইপ রাইটারে টাইপ করছে আর কথা বলছে, 
স্যার বিজি আছেন, দেখা হবে না।  
আমার যে তার সাথে দেখা করতে হবে।
কি ব্যাপারে বলেন।
আপনাকে বলা যাবে না।
তাহলেতো দেখা হবে না।

আমি লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম আপনি ভিতরে গিয়ে বলেন, যে একজন দেখা করতে চায়। দেখা করা তার দ্বায়িত্ব। সাথে আমার ভিসিটিং কার্ডটা দেবেন।

এতে কাজ হলো। একটু পরই চেয়ারম্যান সাহেব তার রুমে ডাকলেন আমাকে। বসতে বললেন। চা অফার করলেন, কিচু খাজুরে গল্পও হলো এবং ইন্টারকমে আলাউদ্দিনকে ফোন করে বললেন, টিকিট দিতে। সেই থেকে আর কখনো টিকেটের সমস্যা হয়নি। আমি মাঝে মাঝে আলাউদ্দিনকে টাকা সাহায্য করতাম। তার স্ত্রী ছিল চির অসুস্থ্য। তার চিকিৎসার জন্য দিতাম। লঞ্চের টিকিট পাওয়াও ছিল এক কঠিন কাজ। আজও। সব বড় সাবদের জন্য রিজার্ভ থাকে ভিআইপি কেবিনগুলো। এখানেও কোটা। লঞ্চ মালিকদের আমি কাউকে চিনি না। একবার ঢাকা থেকে বরিশাল যাচ্ছি প্লেনে। আমার পাশের সীটে বসেছে সুরভি লঞ্চ মালিকের ছেলে। তিনি  বললেন, যখনই কেবিনের দরকার হবে ফোন দেবেন। আমার দরকার হয়নি অবশ্য। লঞ্চের সেই অভিজ্ঞার পর আমি লঞ্চে খুব একটা জার্নি করি না। কখনো করলেও বরিশালে আমার বন্ধু রুপক বা পান্না টিকিটের ব্যবস্থা করে দেয়। কানাডা আসার পরও আমি বরিশাল যাই প্রতিবছর এক দুই বার। বেশিরভাগই প্লেনে যাই।

সামনে নতুন দিন। নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন, নতুন উচ্ছাস, নতুন আবেগ। আর হয়ত স্টিমার বা লঞ্চে যেতে হবে না। লঞ্চ মালিকদের খামখেয়ালির দিন শেষ। আর কারো কাছে ধর্না ধরতে হবে টিকিটের জন্য। বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যানের পিএর উপেক্ষা সহ্য করতে হবে না বা আলাউদ্দিনদের মতো কেরানিকে তোয়াজ করতে হবে না। মন্ত্রী এমপি সাহেবরা যত খুশী কোটা উপভোগ করুক আমার কিছু যায় আসে না। আমি বরিশাল চলে যাব পদ্মা সেতু দিয়ে। এমনকি আমি নিজ ড্রাইভ করেও চলে যেতে পারি। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার পার হলে হয়ে পোস্তগোলা থেকে এক্সপ্রেসওয়ে ধরব আমি।
 
চার লেনের চমৎকার এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে কনভার্টেবল গাড়ি চালিয়ে তিন ঘন্টায় পৌঁছে যাব বরিশাল। পাশে বসে থাকবে আমার প্রেমিক। বাতাসে চুল উড়বে তার। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখব। আহা এই দৃশ্য এখন আর কল্পনা না, বাস্তবেই এমনটা ঘটবে। এদিকে মাওয়া প্রান্ত থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত চার লেনের রাস্তা হবে। বরিশালে একদিন ট্রেনও যাবে! ট্রেনের লাক্সারি কোচে যেতে যেতে আমি আর জেসমিন স্মৃতিচারন করব। একবার বুড়িগঙ্গায় ডুবে যেতে নিয়েছিলাম সেই গল্প করব।

news24bd.tv কামরুল