এক তিব্বতির মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি

এক তিব্বতির মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি

মনিজা রহমান

নিউইয়র্কে আসার আগে কখনও কোন তিব্বতির সঙ্গে সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা ছিল না। স্কুলজীবনে সাধারণ জ্ঞানের বইয়ের পাতা ওল্টালে দেখতাম লেখা থাকতো- ‘নিষিদ্ধ শহরের দেশ তিব্বত’। ওই পর্যন্ত ছিল জানার দৌড়। আর জানতাম একজন দালাই লামার নাম।

দেশান্তরী জীবনের প্রথম পাঁচ বছর জ্যাকসন হাইটসের প্রাণকেন্দ্রে থাকার সুবাদে প্রচুর তিব্বতির সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ পেলাম। মাঝেমাঝে তো আমার মনে হত, তিব্বতের বাইরে আর কোথাও এত বেশী তিব্বতি থাকে কিনা সন্দেহ! কিন্তু একদিন এক মধ্যবয়সী তিব্বতি উবার ড্রাইভার আমাকে রীতিমতো স্তব্ধ করে দিল। বাংলাদেশ থেকে আমি এসেছি জেনে লোকটা পথের দিকে তাকিয়ে আবেগময় কণ্ঠে বলে উঠল, ‘জান, আমার বাবা ১৯৭১ সালে তোমাদের মুক্তিযুদ্ধে মারা যান। আমি তখন অনেক ছোট।
একজন শহীদের পরিবার হিসেবে কিছুই পাইনি আমরা। ’ 

এই কথোপকথনের স্মৃতি বছরখানেক আগের। তিব্বতি উবার ড্রাইভারের কথায় এতই অবাক হয়েছিলাম যে আরো কিছু জেনে নিব, সেই সুযোগ আর হয়নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তিব্বতিদের ভূমিকা সম্পর্কে রীতিমত অন্ধকারে ছিলাম তখন। গত রোববার জ্যাকসন হাইটসে বাজার করতে গিয়ে কয়েকজন তিব্বতিকে দেখে মনে পড়ল সেই স্মৃতি। তবে ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলার পরেই পড়াশুনা শুরু করেছিলাম। এমনিতে জাতিগত বৈচিত্রের জন্য বিখ্যাত জ্যাকসন হাইটসে, অন্যান্য জাতিগোষ্ঠির মধ্যে তিব্বতিদের আমার খুব ভালো লাগে। ওরা বেশ সমীহ করে কথা বলে বাঙালিদের সঙ্গে। কারণ এখানকার পাবলিক স্কুলগুলোতে বাঙালি ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ায় অত্যন্ত ভালো। আমার বড় ছেলে যখন পিএস সিক্সটি নাইনে পড়তো, ওর অনেক সহপাঠি ছিল তিব্বতি। স্কুল লাগোয়া আমাদের বাসা ছিল বলে ওর অনেক বন্ধুরাও আসতো। যাদের মধ্যে অনেক তিব্বতি ছিল।  

কারমা নামে ছেলের এক বন্ধুর নানা তো রীতিমত আমাদের পরিবারের সদস্য হয়ে গিয়েছিলেন। বিরাট আলখেল্লা ধরনের জমকালো পোষাক পরতেন। হাতে সব সময় তসবিহ’র মতো একটা মালা জপতে দেখতাম। মেয়ে আর মেয়ে জামাই কাজে থাকার কারণে উনি দুই নাতিকে স্কুলে আনা-নেয়া করতেন। ওনাকে দেখে মনে হত স্বয়ং দালাইলামা। সব সময় মুখভর্তি হাসি। যত দূরে থাকুক দেখামাত্র হাত উচুঁ করে সম্ভাষণ জানাতেন। বুদ্ধের অহিংস বাণী যেন বিতরণ করে চলেছেন তিনি। তিব্বতিদের অতি বিনয়ের কারণে মাঝেমধ্যে মজাও লাগতো, ওদের দেখলে বলতাম- ‘ওই যে টিব্ব্যাটেন’। ছুটির দিনে জ্যাকসন হাইটসের ডাইভার্সিটি প্লাজায় দেখতাম-লম্বা কাফতান ধরনের পোষাক পরে নারীরা দলবেধে চলছে উৎসবের আয়োজনে। পিএস সিক্সটি নাইন স্কুলে মাল্টি কালচারাল ডে’তেও তিব্বতিরা ছেলেমেয়েরা ওদের ঐতিহ্যবাহী পোষাক পরে আসতো।
 
ওই তিব্বতি ড্রাইভারের সঙ্গে কথা হবার পরে ওর স্বদেশীদের দেখতে শুরু করলাম অন্য আলোয়। মোস্তফা হোসেইন নামে একজন মুক্তিযুদ্ধ গবেষকের লেখা পড়ে জানলাম- ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বাংলাদেশ-ভারত যৌথবাহিনীর অবদান স্বীকৃত। কিন্তু তৃতীয় দেশ হিসেবে তিব্বত যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছে, তা নিয়ে খুব একটা কথা হয় না। অথচ সেই দেশের ৮০ থেকে ১০০ জন নাগরিক শহীদ হয়েছেন একাত্তরে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে। আইনগত কারণে একাত্তরে তাদের যুদ্ধকথা প্রকাশ হয়নি ওইভাবে। ’ ভারতীয় বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত তিব্বতিদের অংশগ্রহণের বিষয়ে সামান্য লেখা পাওয়া যায়। কিন্তু স্বতন্ত্রভাবে তারা পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যে লড়াই করেছে, তা নিয়ে আমাদের ইতিহাসবিদদের খুব একটা কথা বলতে শোনা যায় না। ভারতীয় বাহিনী যেমন মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, তেমনি তিব্বতের মুক্তির জন্য গঠিত স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করে আমাদের বিজয়কে দ্রুততর করেছে।
 
স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স সম্পর্কে উইকিপিডিয়ার তথ্য হল- এসএফএফ বা বিশেষ সীমান্তরক্ষী বাহিনী ভারতের সেনাবাহিনীর একটি অংশ। তিব্বতের সৈন্যদের নিয়ে এই সেনাদল গঠিত।   ১৯৬২ সালে ভারত ও চীনের মধ্যকার যুদ্ধের পরে এই বাহিনী গঠন করা হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এই দলটি ব্যাপক অবদান রাখে। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের তিন হাজার যুবককে সীমান্তবর্তী দেমাগিরিতে জড়ো করা হয় ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি এএন-১২ বিমানে করে। তাদেরকে সীমান্তের অপর পাশে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পার্বত্য চট্টগ্রাম অংশে গেরিলা অপারেশন চালানোর নির্দেশ দেয়া হয়।

এসএফএফ –এর অবস্থানের বিপরীতে পাকিস্তানের স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপের একটি ব্যাটালিয়ান ছিল যাদেরকে ভারতীয় বাহিনী তাদের ঢাকায় পাঠানো ইউনিটের জন্য হুমকিস্বরূপ মনে করে। তাই তাদের বিরুদ্ধে নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে অপারেশন মাউন্টেইন ঈগল সূচনা করা হয়। ছোট নৌকা নিয়ে এসএফএফ এর দলগুলো বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বুলগেরিয়ার তৈরি রাইফেল হাতে অগ্রসর হয়। ক্রমশ তারা শত্রুপক্ষের সেনাচৌকিগুলো দখল করে নিতে থাকে। ১৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরের ৪০ কিলোমিটার দুরে অবস্থান গ্রহণ করে পাকিস্তানী বিগ্রেডের অগ্রসরতাকে প্রতিরোধ করে। ওই যুদ্ধে এসএফএফের ৪৯ জন তিব্বতি জীবন উৎসর্গ করেন।
 
আমার জানা হয়নি পার্বত্য চট্টগ্রামের সেই যুদ্ধে শহীদ ৪৯ জন শহীদের একজন- ওই তিব্বতি উবার ড্রাইভারের বাবা ছিলেন কিনা! খুব বেশী কথা শোনা হয়নি তাঁর। তবে এতটুকু বুঝতে পারি পিতৃহীন পৃথিবীতে বড় হয়ে ওঠা তাঁর জন্য  সুখের ছিল না। একজন শহীদের পরিবার হিসেবে কোন খেতাব বা টাকাকড়ি কিছুই পাননি তারা। এই বিজয়ের মাসে, বিজয় দিবসের প্রাক্কালে, অন্তরের অন্ত:স্থল থেকে ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতার উষ্ণতা পৌঁছে দিলাম শুধু তাঁর জন্য।  

-মনিজা রহমান, নিউইয়র্ক (ফেসবুক থেকে নেয়া)

news24bd.tv কামরুল