কারিশমা দেখে নেতা নির্বাচন করার পদ্ধতি ভুল

কারিশমা দেখে নেতা নির্বাচন করার পদ্ধতি ভুল

Other

গত বছর জানুয়ারী মাসে টেড টকে মনোবিজ্ঞানী টমাস চামোরো-প্রেমুজিক এর একটা মজাদার শো হয়েছিলো। টেড টকের সেই শোতে তিনি বলেছিলেন, আমরা যখন নেতা নির্বাচন করি তখন তার কারিশমা দেখি। কারিশমা দেখে নেতা নির্বাচন করার পদ্ধতি ভুল এবং এর ফলে আমরা অদক্ষ নেতাদের নির্বাচন করছি। তিনি বলেছিলেন,  আমরা যদি নেতৃত্বের পদে মানুষের যোগ্যতার স্তর উন্নত করতে চাই, তাদের বিচার এবং নির্বাচন করার জন্য আমাদের নিজেদের দক্ষতাকেও উন্নত করতে হবে, বিশেষ করে যখন আমরা পুরুষদের নেতা হিসেবে নির্বাচিত করি।

 

কারণ পুরুষেরা মহিলাদের তুলনার দক্ষতা ও যোগ্যতা সম্পর্কে অন্যদের ধোকা দিতে বেশী পারঙ্গম। তাদের এই দক্ষতার কারণে তারা তাদের পেশাগত জীবনেও উন্নতি করে থাকে। তারা অন্যদের এটা বুঝাতে সমর্থ হয় যে সে তার আসল দক্ষতা ও যোগ্যতার চাইতে বেশী দক্ষ বা যোগ্য।  
টমাস চামোরো-প্রেমুজিক বলেছিলেন, আজকের দিনে একটি বড় সমস্যা হল যে আমাদের অধিকাংশ নেতা অযোগ্য।

সেটা ব্যবসা হোক বা রাজনীতি হোক। আর অযোগ্য নেতারা তাদের অনুগামীদের এবং অধস্তনদের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যার ফলে তরুন কর্মীদের ব্যস্ততা, বিশ্বাস এবং উৎপাদনশীলতা ক্ষতিগ্রস্থ হয় আর সিনিয়র লেভেলের কর্মী বা ম্যানেজারদের মধ্যে বার্নআউট এবং স্ট্রেস তৈরি হয়।  

বেশিরভাগ মানুষ তাদের ম্যানেজারদের সম্পর্কে কী ভাবছেন তা দেখতে গুগল “My Boss” কী ওয়ার্ডটা সার্চ করে দেখতে পারেন। আপনি "পাগল," "অপমানজনক," "অসহনীয়," "বিষাক্ত” এই ধরণের শব্দগুলি দেখতে পাবেন।

টমাস চামোরো-প্রেমুজিক টেড টকে যে প্রধান প্রশ্নটি উত্থাপন করেছিলেন, তা হ'ল কেন মহিলারা বেশী বেশী নেতা হন না, আর কেনই বা অনেক অযোগ্য পুরুষ নেতা হন?

প্রেমুজিকের গবেষণায় এই প্রশ্নের তিনটি প্রধান কারণ পাওয়া গেছে।   প্রথমটি হল, আমরা আত্মবিশ্বাস এবং যোগ্যতার মধ্যে পার্থক্য করতে পারিনা। আমরা অনুমান করি যে আত্মবিশ্বাসী লোকদের নেতৃত্বের যোগ্যতা বেশি। কিন্তু আসল কথা হলো, নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে, আত্মবিশ্বাসের চাইতে দক্ষতার প্রয়োজন বেশী।

দ্বিতীয় কারণটি হল ক্যারিশম্যাটিক ব্যক্তিদের প্রতি আমরা অহেতুক আকৃষ্ট হই, বিশেষ করে ১৯৬০  -এর দশকে গণমাধ্যমের বিস্ফোরণের পর থেকে। আর সাম্প্রতিক ডিজিটাল যুগে এই ফেনোমেননটা মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা এমন নেতাদের চাই যারা আকর্ষণীয় এবং আমাদের আনন্দ দিতে পারেন। কিন্তু আমরা এটাও জানি, একজন কার্যকর নেতা হওয়া এবং স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান হওয়ার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, সেরা নেতারা ক্যারিশম্যাটিক না হয়ে বিনয়ী হন। , কিছু ক্ষেত্রে একজন ভালো নেতাকে বিরক্তিকর বলেও মনে হতে পারে।

সে কারণেই ব্লকবাস্টার সিনেমায় সেই সব ইফেক্টিভ বা কার্যকর নেতাদের খুব কমই দেখা যায়, কারণ তারা সেই অর্থে এনটারটেইনিং না।  
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় এই সময়ের সবচেয়ে কার্যকর ও দক্ষ রাজনৈতিক নেতা হচ্ছেন আঙ্গেলা ডোরোটেয়া মের্কেল। মার্কেলকে নিয়ে একটি হলিউডি সিনেমার কথা কল্পনা করুন-তিনি সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠে, তার স্বামীর সাথে সকালের নাস্তা করছেন, মিটিংয়ের জন্য ভালভাবে তৈরি হচ্ছেন, অন্য লোকদের তাদের বাধা না দিয়ে কথা বলতে দিচ্ছেন, যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন এবং তার সম্পর্কে কোন কেলেঙ্কারি নেই। এইরকম একটা চরিত্র কী বোরিং নয়? কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনা ক্ষেত্রে কী আসলেই তিনি তা? মোটেই তা নয়।  

এখানে বলে রাখা ভালো, আঙ্গেলা ডোরোটেয়া মের্কেল -একজন পদার্থবিদ। তিনি Union of Christian Democratic party থেকে নির্বাচিত জার্মানির বর্তমান চ্যান্সেলর।

যার আরেক নাম ‘ইউরোপের ক্রাইসিস ম্যানেজার’। শুধু ইউরোপ নয়, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ছাড়িয়ে এশিয়াতেও তার সমান প্রভাব। এ বছরের বছরের শেষ নাগাদ তিনি রাজনীতি ছাড়বেন, সেজন্য প্রস্তুতিও নিচ্ছেন। সি এন এন লিখেছিলো, বর্তমান শতক সম্ভবত সবচেয়ে সফল খেলোয়াড়টির অবসর প্রত্যক্ষ করতে চলেছে।

নিজের দায়িত্ব পালনকালে পাঁচ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে দেখেছেন মার্কেল। দেখেছেন চার ফরাসি প্রেসিডেন্ট, সাত ইতালিয়ান প্রধানমন্ত্রীকে। এবং ২০ জানুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণ করার পর যুক্ত হলেন বাইডেন,যিনি ৪র্থ মার্কিন প্রেসিডেন্ট যার সঙ্গে মের্কেলের কাজ করার অভিজ্ঞতা চলমান।   এ সময় জাপানেও পালাবদল হয়েছে আট প্রধানমন্ত্রীর।

এই অনন্য অভিজ্ঞতার পরেও মার্কেলকে তার দায়িত্ব পালনের অধিকাংশ সময় তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা প্রায়শই তাকে অপমানের চেষ্টা করেছেন। কুকুর ভয় করেন জেনেও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন একবার মার্কেলের সঙ্গে বৈঠকের সময় একটি ল্যাব্রাডর কুকুর নিয়ে এসেছিলেন।  
ছাড় দেননি ট্রাম্পও। সরাসরি গর্দভ বলে গালিও দিয়েছিলেন মার্কেলকে। ইতালির প্রধানমন্ত্রী বার্লুসকোনি তাকে ১৫ মিনিট বসিয়ে রেখে ফোনে কথা বলছিলেন। সব কিছুর পেছনে কারণ ছিল একটাই-তিনি নারী। ২০০৫ সালে তিনি যখন প্রথম নারী হিসাবে জার্মান চ্যান্সেলরের দায়িত্ব নেন, অনেকেই ভেবেছিল তিনি বেশিদিন টিকবেন না। জার্মানির প্রভাবশালী দৈনিক বিল্ড সেদিন বড় করে তার ছবি ছাপিয়ে শিরোনাম দেয়, মিস জার্মানি।  

কিন্তু ঘটেছে তার উল্টো। এই দীর্ঘ সময় বিশ্বের অনেক নেতা এসেছেন আবার চলেও গেছেন। কিন্তু মার্কেল ছিলেন। কেউ তাকে নড়াতে পারেনি। তিনি তখনই যাচ্ছেন, যখন তিনি যেতে চেয়েছেন।

এই করোনাকালেও দেখা গেছে যেই সমস্ত দেশে নারী নেতৃত্ব আছে তারাই তুলনামুলক সফলভাবে করোনার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পেরেছেন।  
তাহলে, এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা কিভাবে অযোগ্য পুরুষদের নেতা হতে বাধা দেব?

প্রথম সমাধান হল, সেই লক্ষণগুলি বুঝতে পারা এবং সেই গুণগুলির সন্ধান করা যা আসলে মানুষকে আরও ভাল নেতা করে তোলে। আমরা যদি যোগ্য নেতা চাই, আমাদের উচিত নেতৃত্বের সঠিক বৈশিষ্ট্যের দিকে মনোনিবেশ করা। আত্মবিশ্বাসী, নার্সিস্টিক এবং ক্যারিশম্যাটিক লোকদের নেতা হিসেবে পছন্দ করার গাড্ডায় পড়ার পরিবর্তে আমাদের যোগ্যতা, নম্রতা এবং সততার কারণে মানুষকে নেতা বানানো উচিত।
ঘটনাক্রমে, এই কাজ করলে আমরা পুরুষ নেতাদের তুলনায় মহিলা নেতা বেশী পাবো। বড় বড় বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে যে যোগ্যতা, নম্রতা এবং সততার বিচারে মহিলারা পুরুষদের চেয়ে বেশি এগিয়ে।  

আর দ্বিতীয় সমাধান হল আমাদের প্রবৃত্তিকে অবিশ্বাস করা। যা আমাদের আকৃষ্ট করে, প্রলুব্ধ করে তাই প্রবৃত্তি; যেমন কারিশমা আর আত্মবিশ্বাস আমাদের প্রলুব্ধ করে আকৃষ্ট করে। এই প্রবৃত্তির পছন্দকে পাত্তা না দিয়ে আমাদের যুক্তি আর বিবেচনাবোদকে প্রাধান্য দিলে আমরা ভালো নেতা নির্বাচন করতে পারবো। যারা আমাদের ভবিষ্যতকে আরো ভালোভাবে নির্মান করতে পারবে।

লেখাটি শান্তা আনোয়ার- এর ফেসবুক থেকে নেওয়া (সোশ্যাল মিডিয়া বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )

news24bd.tv/আলী