যে পরিবারে একজন ছাড়া সবাই নোবেল পেয়েছিল

যে পরিবারে একজন ছাড়া সবাই নোবেল পেয়েছিল

Other

পোলীয় ও ফরাসি বিজ্ঞানি মেরি ক্যুরি, পুরো নাম মেরি স্কলোদসকা ক্যুরি। তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে গবেষণার জন্য পুরো পৃথিবী তাঁকে মনে রাখবে সব সময়। ১৯০৩ সালে তেজস্ক্রিয়তার উপর গবেষণার জন্য তার স্বামী পিয়ের ক্যুরি এবং তেজস্ক্রিয়তার আবিষ্কারক অঁরি বেকেরেলের সাথে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পান। পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই ছিলেন প্রথম নারী বিজ্ঞানী যিনি বিজ্ঞানের দুইটি শাখায় (পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন) দু'বার নোবেল পুরস্কার জিতেছিলেন।

শুধু তিনিই না, জেনে আশ্চর্য হবেন যে, তাঁর পরিবারের প্রায় প্রতিজন সদস্য নোবেল বিজয়ী ছোট মেয়ে ইভ ক্যুরি ছাড়া।

পিয়েরে ক্যুরি - তিনি ছিলেন একজন ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানী। ১৯০৩ সালে তিনি তার স্ত্রী মারি ক্যুরির সাথে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান।

আইরেন জোলিও ক্যুরি - তিনি ছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রের রেডিওলজিস্ট, অ্যাক্টিভিস্ট, রাজনীতিবিদ এবং বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত দুই বিজ্ঞানী: মেরি ক্যুরি এবং পিয়েরে ক্যুরি দম্পতির বড় মেয়ে।

তাঁর স্বামীও ছিলেন একজন বিশিষ্ট পারমানবিক পদার্থবিদ। পুরো নাম ফ্রেদেরিক জোলিও-ক্যুরি। ১৯২৫ সালে রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে আইরেন ক্যুরির মা, মেরি ক্যুরি'র সহকারী হিসেবে কাজ করেন। একপর্যায়ে জোলিও মেরি ক্যুরির মেয়ে আইরেন ক্যুরিকে ভালোবেসে ফেলেন। ৪ অক্টোবর, ১৯২৬ সালে প্যারিসে তারা বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। উভয়েই তাদের গোত্র নাম পরিবর্তন করে জোলিও-ক্যুরি রাখেন।

পরবর্তীতে আইরেন এবং তার স্বামী ফ্রেদেরিক জোলিও-ক্যুরি'র সাথে যৌথভাবে কৃত্রিম তেজস্ক্রিয় পদার্থ আবিস্কারের ফলে রসায়নশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার পান। ক্যুরি দম্পতির এ সাফল্যের প্রেক্ষাপটে অদ্যাবধি সফলতম নোবেল বিজয়ী পরিবার হিসেবে আসীন রয়েছে।

ইভ ক্যুরি - ছিলেন ফরাসি ও আমেরিকান লেখক, সাংবাদিক এবং পিয়ানোবাদক। তিনি ছিলেন মেরি এবং পিয়েরে ক্যুরি দম্পতির ছোট মেয়ে। বড় বোন ছিলেন আইরেন এবং তাঁর বোনের স্বামী ফ্রেদরিক জোলিও-ক্যুরি। একজন সাংবাদিক হিসাবে তিনি তাঁর মায়ের জীবনী মেরি ক্যুরি এবং যুদ্ধের রিপোর্টের উপর একটি বই, ‘জার্নি উইং ওয়ারিয়র্স’ রচনা করেছিলেন।

১৯৬০ এর দশক থেকে তিনি ইউনিসেফের সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ভাবে উন্নয়নশীল দেশের শিশু এবং মায়েদের সহায়তা প্রদান শুরু করেন। তিনি তাঁর পরিবারের একমাত্র সদস্য, যিনি একজন বিজ্ঞানী হিসেবে ক্যারিয়ার বেছে নেননি এবং নোবেল পুরস্কার পাননি, যদিও তার স্বামী হেনরি রিচার্ডসন লাবুইস জুনিয়র ১৯৬৫ সালে ইউনিসেফের পক্ষ থেকে নোবেল শান্তি পুরস্কার সংগ্রহ করেছিলেন।

এখানে উল্লেখ্য যে হেনরি রিচার্ডসন ছিলেন একাধারে আমেরিকান কূটনীতিক, রাজনীতিবিদ এবং আইনজীবী। তিনি ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত জাতিসংঘের ত্রাণ ও ওয়ার্কস এজেন্সি ফর ফিলিস্তিন রিফিউজিসের তৃতীয় পরিচালক তাছাড়াও কয়েক বছর তিনি জাতিসংঘ শিশু তহবিলের পরিচালক ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি মার্শাল প্ল্যান বাস্তবায়নের সাথে সম্পর্কিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রধান কর্মকর্তা হন।

মেরি ক্যুরি আজীবন তেজষ্ক্রিয় পদার্থ নিয়ে কাজ করে এক অজানা রোগে (সম্ভবত লিউকেমিয়া) ১৯৩৪ সালের ৪ জুলাই স্বল্প বয়সে এই মহীয়সী বিজ্ঞান সাধিকার জীবনপ্রদীপ চিরদিনের জন্য নির্বাপিত হয়।

মেরি স্কলোদসকা ক্যুরি রাশিয়ায় অত্যাচারী জার শাসনের নিষ্পেষণের আমলে ১৮৬৭ সালের ৭ নভেম্বর পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশতে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারে তাঁকে মানিয়া নামে ডাকা হত। তাঁর বাবা ব্লাদিস্লাভ শক্লোদোভস্কি ওয়ারশয়ে একটি নামকরা কলেজের পদার্থের অধ্যাপক ছিলেন এবং মা ছিলেন একটি নামকরা স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। তাঁর বাবা প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বিজ্ঞান ও সাহিত্য বিষয়ে আসর বসাতেন। এক সময় মেরির পরিবার মারাত্মক অর্থ সংকটে পড়ায় তাঁর বড় বোনের পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য ১৮৬৬ সালের ১ জানুয়ারি তিনি মাসিক পাঁচশ রুবল-এর বিনিময়ে এক অভিজাত রুশ আইনজীবীর বাড়িতে গভর্নেসের চাকরি নেন। তাঁদের দুবোনের মধ্যে শর্ত ছিল একজনের পড়াশোনা শেষ করে অপরজনের পড়াশোনার খরচ জোগাবে। তাই অনেক মানসিক পীড়নের মধ্যে তাঁকে তিন বছর চাকরি করতে হয় এবং এরই মধ্যে তাঁর বড় বোন ব্রোনিয়া ডাক্তারি পাস করে। পূর্ব শর্তানুযায়ী এবার মেরি তাঁর বোনের আর্থিক সহায়তায় বিজ্ঞানের উচ্চশিক্ষার জন্য প্রথমে অস্ট্রিয়ার শাসনাধীন ‘ক্রাকো বিশ্ববিদ্যালয়ে' পড়তে যান। কিন্তু সেখানে তিনি বিজ্ঞান ক্লাসে যোগ দিতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সচিব তাঁকে অসম্মতি জ্ঞাপন করে বলেন, ‘বিজ্ঞান মেয়েদের জন্য নয়। তিনি রন্ধন শিক্ষা ক্লাসে যোগ দিন। ’

পরবর্তীতে ডাক্তার হওয়ার আশায় মেরি ভর্তি হয়েছিলেন প্যারিসের সর্বোর্ণে বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষকেরা তাঁর কল্পনাশক্তি, উদ্যম ও মেধা দেখে তাঁকে উৎসাহিত করতেন নতুন নতুন গবেষণায়।

এ সময় তাঁর পরিচয় ঘটে ফরাসি বিজ্ঞানী পিয়ারে কুরির সঙ্গে যিনি ইতিমধ্যে চুম্বকত্ব ও পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মৌলিক গবেষণা করে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাঁরাও একে অপরকে ভালোবেসে বিয়ে করেন। এরপর মেরি পিয়ারে ক্যুরির সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণা করেন। ১৮৯৮ সালেই এই দম্পতি প্রথমে পিচব্লেন্ড থেকে তেজস্ক্রিয় পদার্থ পলোনিয়াম এবং পরে রেডিয়াম আবিষ্কার করেন, যা ইউরোনিয়াম হতে দশ লক্ষগুণ বেশি শক্তিশালী। এই রেডিয়ামের ব্যবহার অপরিসীম। ক্যুরি দম্পতি প্রমাণ করলেন কোনো কোনো মৌলের পরমাণু ক্রমাগত ভেঙে গিয়ে রশ্মি বিকিরণ করে। এই বিকিরণ অন্য পদার্থ ভেদ করেও যেতে পারে। এই ধরনের পদার্থকে বলে তেজস্ক্রিয় পদার্থ আর এই গুণকে বলে তেজস্ক্রিয়তা। বিরল ধাতু ইউরেনিয়ামের লবণ থেকে তাঁরা রেডিয়াম, পলোনিয়াম মৌল দু'টি আবিষ্কার করেন। এ আবিষ্কারের জন্য ১৯০৩ সালে মেরি কুরি এবং পিয়ের কুরি যৌথ ভাবে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯১০ সালে মেরি কুরি রেডিয়াম ক্লোরাইডকে তড়িৎ বিশ্লেষণ করে সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ রেডিয়াম নিষ্কাষণ করেন। এই অসাধারণ উদ্ভাবনের জন্য ১৯১১ সালে মেরিকে রসায়নে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই একমাত্র নারী যিনি দু’বার নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন। এ ছাড়াও তিনি ১৫টি স্বর্ণপদক, ১৯টি ডিগ্রি এবং অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।

গবেষণা ছাড়াও মেরি ক্যুরি দ্বিতীয় যুদ্ধে আহত সৈনিকদের দিয়েছেন একাগ্র সেবা, ভবিষ্যত বিজ্ঞানীদের দিয়েছেন উপদেশ ও পরামর্শ। সর্বোপরি নিজের স্বাস্থ্যের দিকে না তাকিয়ে যিনি ঢেলে দিয়েছেন তাঁর সবটুকু সময়। মেরি ক্যুরি তাঁর বাকি জীবন রেডিয়াম গবেষণাগারে কাটিয়ে দিয়েছেন। রেডিয়ামের বিষ তাঁকে সমস্ত জীবন ধরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। ১৯৩৪ সালের ৪ জুলাই লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে এই মহিয়ষী বিজ্ঞানীর মৃত্যু হয়।
 
তিনিই ছিলেন প্রথম নারী যার অসামান্য মেধার কারণে ১৯৯৫ সালে প্যান্থিয়নে সমাহিত করা হয়।

এখানে উল্লেখ যে, ক্যুরি পরিবারের বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিক ঐতিহ্য এখনও টিকে আছে। আইরেন এবং ফ্রেদরিক জোলিও-ক্যুরির মেয়ে হ্যালেন ল্যাঞ্জভিন-জোলিও ফ্রান্সের একজন সম্মানিত পারমাণবিক পদার্থবিদ। হ্যালেনের স্বামী মাইকেল ল্যাঞ্জভিনও একজন পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানী এবং তাদের ছেলে একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী।

ছবিটি ১৯০২ অথবা ১৯০৩ সালের। মেরি ক্যুরি মেয়ে আইরেনকে সাথে নিয়ে তাঁর স্বামী পিয়েরের সঙ্গে, সেভ্রেস অফিস অফ ওয়েটস অ্যান্ড মেজারসের বাগানে।

(সোশ্যাল মিডিয়া বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )

আরও পড়ুন: 


নতুন সেপটিক ট্যাঙ্কে গেল দুই প্রাণ

জিয়ার ময়নাতদন্ত করেন তোফায়েল, বের করেন ২২ বুলেট: জাগপা


news24bd.tv তৌহিদ

সম্পর্কিত খবর