রাইসুসমগ্র যেন এক প্রবচনগুচ্ছ

ফাহমিদুল হক

রাইসুসমগ্র যেন এক প্রবচনগুচ্ছ

ফাহমিদুল হক

অনেক দিন রাইসু ভাইয়ের পোস্ট দেখি না, কিন্তু মাঝে মাঝে অন্যের শেয়ার আসে। আর উনার জন্মদিনে সহলেখক ও ভক্তকুলের পোস্ট দেখতে পাই।

একদিন খানিক ঘেঁটে বুঝলাম, উনি একাউন্ট চেঞ্জ করেছেন। নতুন একাউন্টে রিকোয়েস্ট পাঠানোর জন্য অনুরোধ রেখেছেন তিনি, আগের একাউন্টে।

মাঝে কেটে গেছে প্রায় এক দশক। কিন্তু তার আগে আধা দশক আমরা অনলাইনে অনেক আলাপ-তর্ক করেছি। অফলাইনেও যথেষ্ট দেখা-শোনা হয়েছে।

উনার সঙ্গে তাহলে আমার তিন পর্ব – আধা দশকের অনলাইন-অফলাইন পর্ব, এক দশকের শেয়ার পর্ব আর এক মাসের হালপর্ব।

হালপর্বে আমি তাকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে বন্ধু হয়েছি। কারণ দ্বিতীয়পর্বে বন্ধু না থাকলেও টের পেতাম উনাকে ঘিরে একটা অনলাইন-ডিসকোর্স আছে। আমি অনলাইন-সামাজিক মাধ্যম পড়াই, রাইসু-ডিসকোর্সকে না বুঝলে চলে না। রিকোয়েস্ট তো আমিই পাঠাবো!

আগের পর্বে, দেড় দশক আগে, কেউ আমাকে উঠতি বুদ্ধিজীবী বললে বিব্রত হতাম, কিন্তু রাইসু ভাই নিজেই নিজেকে বুদ্ধিজীবি বলতেন। মানে উনার কারবার বুদ্ধিজীবীর কারবার, এমনই দাবি করতেন। দ্বিতীয় পর্বের শেষার্ধে এক শেয়ারড পোস্টে দেখলাম তিনি তার তৈরি-করা বুদ্ধিজীবীশ্রেষ্ঠদের অতি-হ্রস্ব তালিকায় নিজেকে রেখেছেন তিন নম্বরে (ক্রমে ভুলও হতে পারে, স্মৃতি থেকে বলছি)। প্রিয়জন সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দিনও একদিন এক পোস্টে তাকে তিন গুরুত্বপূর্ণ চিন্তকদের একজন হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

এক দশকের শেয়ারনির্ভর জানাশোনার সঙ্গে দেড় দশক আগেকার মোটামুটি ঘনিষ্ঠ জানাশোনা মিলিয়ে নিজেকে আপডেট করলেও একটা গ্যাপ থেকে যায়। তাই এক মাসের হালপর্বে বুঝলাম, রিকোয়েস্ট পাঠানো ভুল হয়েছে। শেয়ারনির্ভর জানাশোনাই ভালো ছিল।

কারণ তিনি আজকাল প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবী-লেখকদের খাটো করায় অনেক সময় ব্যয় করছেন। রুমী কেন গৌন, রাইসুর চাইতে উমরের কন্ট্রিবিউশন কোথায় বেশি, ওয়ালীউল্লাহ কেন মাঝারি ইত্যাদি মাপামাপি করে সময় কাটছে তার। যেন নিজের তৈরি করা ওই ছোট তালিকায় তার আসনটি অক্ষুণ্ণ রাখা আর নিরন্তর আলোচনায় থাকার জন্য মরীয়া তিনি! ব্যাপারটা বিকারের দিকে গেছে বা যাচ্ছে। নানান পোস্টে তিনি লিখছেন তিনি লেখকদের লেখক, গুরুদের গুরু। আবার এই বলেও পোস্ট দিচ্ছেন, কেন ‘আমি আমি করাটা’ই সবচেয়ে কম ‘আমি আমি করা’! কেন যুদ্ধ মানেই শান্তি, ঘৃণা মানেই ভালবাসা (আমার অনুবাদ)?

রাইসু ভাই দিনে দুই বা ততোধিক পোস্ট লেখেন, যার উদ্দেশ্য আমার অনুমান, প্রতিক্রিয়া তৈরি করা, আলোচনায় থাকা, রাইসু-ডিসকোর্সকে বাঁচিয়ে রাখা। হয়তো তিনি ভাবেন, এভাবেই আধমরাদের ঘা-মেরে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে এ বিরক্তির বিষয়। উনি হয়তো বলবেন, আপনাকে বিরক্তির মধ্যে রাখাই আমার কাজ। কিন্তু আমার কাছে অপরকে যথেষ্ট না পড়ে, কাজকে যথেষ্ট বিশ্লেষণ না করে বা বলা যায়, ফতোয়ার মতো করে ছোট-মাঝারি রায় দেয়া, আর নিজেকে টেনে ওপরের দিকে রাখার কাজটা গ্রহণীয় নয়। প্রথমটা অপ্রয়োজনীয়, দ্বিতীয়টা নির্লজ্জতা! ফ্রেন্ডলিস্টে থাকার কারণে প্রতিদিন এমন জ্বালাতন সইতে হবে কেন? তার অনুজ কবি ইমতিয়াজ মাহমুদ কেন রুমীর ভগ্নাংশ বা তার সম্ভাবনার পরিমাপ কয় ইঞ্চি, এধরনের কথা উনি বলে দেন, ইমতিয়াজ মাহমুদের কবিতা না পড়েই। রুমীকেও তিনি জাজ করেছেন, রুমীকে ঠিকঠাক না পড়েই।

তবে রাইসু ভাইকে আমি নানান কারণেই পছন্দ করতাম, এখনও করি। তিনি ভালো সম্পাদক, মজাদার কবি। ধানমণ্ডির বড়লোক মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করতে চান, কবিতায় এত সহজভাবে আর কেইবা বলতে পারে? আকাশে কার লগে তিনি কী দেখতে চান, এই ইশতেহার কবেই তিনি ঘোষণা করেছেন! উনি বুদ্ধিমান, স্মার্ট। দেখতে সুন্দর, হাসিটা খুবই কিউট। তবে উনার যে কাতরতার জায়গা, বুদ্ধিজীবী হিসেবে সংক্ষিপ্ত তালিকায় থাকা, সেটা নিয়ে পরের অনুচ্ছেদ লিখছি। (নোট: মাস্টার-সাংবাদিকরা একসময় স্বয়ংক্রিয়ভাবে বুদ্ধিজীবী হতেন, আমি সেখান থেকে নিজেকে বিযুক্ত রাখতে চেয়েছি সবসময়। আমাকে কেউ একটু শিক্ষক, একটু লেখক, আর একটু গবেষক বললেই আমি খুশি। তাই এক স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবীর প্রতি স্বয়ংক্রিয় বুদ্ধিজীবী হিসেবে হিংসাবশত লিখছি, ধারণাটি এখানে প্রযোজ্য হবে না)।

রাইসু ভাই বুদ্ধিমান। তার ফেসবুক পোস্টগুলোয় (যেগুলো ’আমি আমি করা সবচেয়ে না-আমি’র বাইরের) অনেক ইনসাইটস থাকে। চিন্তার ছাপ থাকে, অন্যের চিন্তাকে উসকাতেও সাহায্য করে। তাছাড়া সবাই যাতে বিলং করে, সেই জলস্রোতের বাইরে গিয়ে তিনি ভিন্ন কিছু বলার চেষ্টা করেন। সমাজে বা চিন্তার জগতে সেটারও দরকার আছে। কিন্তু সেগুলো একেকটা ’থিসিস স্টেটমেন্ট’। আমরা যখন শিক্ষার্থীদের গাইড করি এসাইনমেন্ট/প্রবন্ধ লেখার জন্য, তখন বলি, ভূমিকায় একটা থিসিস স্টেটমেন্ট থাকতে হবে। বডিতে তার সম্প্রসারণ থাকতে হবে। যুক্তি ও বিশ্লেষণের লজিকাল প্রগ্রেসন থাকতে হবে, ট্রানজিশন ঠিকঠাক থাকতে হবে। উপসংহারে আবার থিসিস স্টেটমেন্টকে সাক্ষী রেখে সারাংশ হাজির করতে হবে।

রাইসু ভাই থিসিস স্টেটমেন্ট লেখেন, তার সম্প্রসারণ ঘটান না। ধরা যাক, বদরুদ্দিন উমরের সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে একটা থিসিস স্টেটমেন্ট আছে। সেই যুগে ফেসবুক থাকলে একটা পোস্ট লিখে তিনি তা ব্যক্ত করতেন অথবা করতেন না। কিন্তু তিনি আস্ত বই লিখে স্টেটমেন্টকে এসটাবলিশ করেছেন। তাতে অন্যের দ্বিমত থাকতে পারে, কিন্তু স্টেটমেন্টকে প্রমাণ করার সব চেষ্টা তিনি করেছেন। একারণেই উমর রাইসুর চাইতে অনেক বড় বুদ্ধিজীবী।

ধরা যাক, হুমায়ুন আজাদের কথা, নারী-পুরুষের সম্পর্ক বিষয়ে তার যে থিসিস স্টেটমেন্ট, তা তার উপন্যাস ‘সব কিছু ভেঙ্গে পড়ে’তে বিস্তার করেছেন। কিংবা ভাষা নিয়ে তার যে ভাবনা তা  প্রবন্ধের বইতে ব্যক্ত করেছেন। আবার যে ভাবনাগুলোকে বিস্তার করতে পারেন নি, ছোট ছোট সেসব থিসিস স্টেটমেন্ট নিয়ে লিখেছেন ‘প্রবচনগুচ্ছ’। প্রিয়জন ভাষাবিজ্ঞানী শিশির ভট্টাচার্য়্য ভাষার বইয়ের বাইরে লিখেছেন ‘কথাকলি’।

ফেসবুকযুগে চমক-জাগানো স্টেটমেন্ট লিখে বুদ্ধিজীবী দাবি করা যেতেই পারে, অনেকে তা মানতেও পারে। কিন্তু আমার বিবেচনায়, রাইসুসমগ্র, এক (অগ্রন্থিত) প্রবচনগুচ্ছমাত্র।

(সোশ্যাল মিডিয়া বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )

আরও পড়ুন


নিষেধ করেছেন পীর, তাই ভোট দেন না ১২ হাজার নারী!

news24bd.tv এসএম