পেশা এক, ঝুঁকিও সমান, তাহলে কেন বৈষম্য

পেশা এক, ঝুঁকিও সমান, তাহলে কেন বৈষম্য

বাণী ইয়াসমিন হাসি

আতিক রায়হান। একটা সরকারি হাসপাতালের ইন্টার্ন। গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ। বাবা নেই।

বাড়িতে মা আর ছোটবোন। আতিক প্রতি সপ্তাহে ২দিন গাজীপুরের একটা বেসরকারি ক্লিনিকে সময় দেয়। ওই ক্লিনিক থেকে যে টাকা পায় সেটা দিয়েই নিজের খরচ এবং বোনের কলেজে পড়ার খরচ চালায়।

করোনা সংক্রমন শুরু হওয়ার পর ক্লিনিকটা বন্ধ।

আতিকের আয়ের পথও বন্ধ। জমানো টাকায় ডাল, ভাত, আলু ভর্তা আর ডিম ভাজি খেয়ে দিন কাটছে। বাড়ি থেকে মা ফোন করলে কান্না লুকিয়ে বলে- চিন্তা করো না মা,সামনের সপ্তাহে আমি বিকাশে কিছু টাকা পাঠাবো। ওটা দিয়ে রোজার সদাই কইরো। সাধারণ ছুটির মেয়াদ আবারও বাড়লো। এই সঙ্কট কবে কাটবে কেউ জানে না। আতিকের মায়ের হাতের কাজের কোন অর্ডার নেই এখন। কীভাবে চলবে সামনের দিন? আতিকের কপালে চিন্তার ভাজ বাড়ে। কিন্তু উপায় তো মেলে না !

মেহেদী জামিল। বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের HMO(Honorary Medical Officer)। আজিজ সুপার মার্কেটে চার বন্ধু মিলে এক ফ্ল্যাটে থাকে। একটা ঠিকে বুয়া সকাল আর সন্ধ্যায় রান্না করে দিয়ে যায়। করোনা সংক্রমনের পর বুয়া আসা বন্ধ। আশেপাশের সব হোটেলও বন্ধ। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে।
আজিজ মার্কেটে শত শত ডাক্তার থাকেন। তারা হয় হোটেলে খায়, না হয় বুয়ারা রান্না করে দেয়, এখনতো কেউ নেই। হোটেলও বন্ধ। আর হাসপাতাল থেকেও খাবার দেয় না। এরা কি খাচ্ছে? কিভাবে কষ্ট করে চলছে? সেটা কেউ দেখার নেই! ৩৯ তম বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের অধিকাংশেরই এখনও বেতন হয়নি। কারণটা কি হলো-মন্ত্রনালয়ের জটিলতা। এ পর্যন্ত কত জন ডাক্তার নার্স বা স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত তার কোন পূর্ণাঙ্গ ডাটা স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের কাছে নেই।

কোভিড হাসপাতালে যারা কাজ করছেন সরকার শুধু তাদের প্রনোদনার আওতায় এনেছে কিন্তু দেখা যাচ্ছে যারা ননকোভিড হাসপাতালে কাজ করছে তারা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের কি হবে? এই সরকারি বেসরকারি চিকিৎসক যারা ননকোভিড হাসপাতালে কাজ করে তাদেরওতো পরিবার আছে। তারা আক্রান্ত হলে তাদের ভবিষ্যত কি?

ডাক্তারদের জন্য মন্ত্রণালয়ের প্রণোদনার যে খসড়া তার সারসংক্ষেপ হলো- 

১) আপনি সরকারি ডাক্তার না হলে কিছুই পাবেন না। আবার শুধু সরকারি ডাক্তার হলেই হবে না। আপনি সরকারি চাকরিজীবী কিন্তু আপনি কোভিড হাসপাতালে দায়িত্বরত না, নন কোভিড হাসপাতালে দায়িত্বরত অবস্থায় কোভিডে আক্রান্ত তাতেও পাবেন না।

২) আপনি করোনা আক্রান্ত না হলে, সরকারি ডাক্তার হলেও কিছু পাবেন না।  

৩) আপনি করোনা আক্রান্ত হলেই হবে না, আপনি যদি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা না নেন তা হলে প্রণোদনা পাবেন না।

৪) করোনা আক্রান্ত হয়ে হোম কোয়ারেন্টাইন বা বাড়িতে আইসোলেশনে থাকলে কিচ্ছু পাবেন না।

৫) আপনাকে প্রমাণ করতে হবে যে আক্রান্ত হওয়ার সময় আপনি ডিউটিতে ছিলেন।  

৬) মরে গেলে অবশ্যই কোভিড-১৯ এই মরতে হবে।

২৩ এপ্রিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ এক পরিপত্রের মাধ্যমে কোভিড ১৯ আক্রান্ত রোগীদের সরাসরি সেবা প্রদানে কর্মরত স্বাস্থ্য সেবা কর্মীসহ সরকারি  নির্দেশনা বাস্তবায়নের সময় কোভিড আক্রান্ত হলে সরকার ক্ষতিপূরণ প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। অনেক স্বাস্থ্যসেবা কর্মী ননকোভিড হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা প্রদানের সময় কোভিড আক্রান্ত হচ্ছেন তাদেরকেও এই কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হোক।

দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। আজ ২৫ এপ্রিল। দুঃখজনক হলেও সত্যি এখন পর্যন্ত একটা হাসপাতালও কোভিড রোগীর জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত নয়।
কুর্মিটোলা বা কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেনের ব্যবস্থা নেই।

কোভিড নিয়ে যারা কাজ করছে তাদের কারোই প্রফেশনাল নলেজ নেই। যাদের নলেজ আছে তাদেরকে নিয়ে আজ পর্যন্ত কোন মিটিং হয়নি। যারা এই ব্যাপারে জ্ঞান রাখেন বা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারবেন এমন কাউকেই ইনভলব করা হয়নি।

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ৩২ জন স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত। এর মধ্যে ১৫ জনই ডাক্তার। এখানে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণ হলো এখান থেকে স্যাম্পল নিয়ে শিশু হাসপাতালে পাঠানো হয়।

সবচেয়ে বড় সর্বনাশ যেটা হতে চলেছে সেটা হলো কোভিড নন কোভিড রোগীকে একসাথে ট্রিটমেন্ট। ঢাকা মেডিকেলের অর্ধেক কোভিড রোগীর জন্য বাকি অর্ধেক নন কোভিড রোগীর জন্য। একজন কোভিড রোগী যখন নন কোভিড এরিয়ার করিডোর দিয়ে যাবে তখন সে কোভিড  ছড়াতে ছড়াতে যাবে। এটা আগুন নিয়ে খেলার মতনই।

ঢাকার ভেতরে এবং প্রতিটি জেলায় যেসব হাসপাতাল করোনার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে তারা কনফার্মড (টেস্ট পজিটিভ) রোগীগুলো রাখছে। এটার কারণে করোনা সন্দেহে কোন রোগী ওখানে গেলে অন্য হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। এটার কারণে রোগীর একদিক দিয়ে ভোগান্তি বাড়ছে আরেকদিকে দ্বারে দ্বারে ঘুরার কারণে কমিউনিটিতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি বাড়ছে।  

করোনার জন্য নির্ধারিত প্রতিটি হাসপাতালে প্রবেশমুখে একটি ট্রায়াজ এরিয়া, ভেতরে কনফার্ম রোগীদের জন্য নির্ধারিত ওয়ার্ড এবং সম্ভাব্য সন্দেহজনক রোগীদের জন্য একটি আলাদা ওয়ার্ডে (আইসোলেশন ওয়ার্ড- সন্দেহজনক রোগী) রাখতে হবে। টেস্ট পজিটিভ আসলে কনফার্মড ওয়ার্ডে চলে যাবে এবং নেগেটিভ নন করোনা হাসপাতাল গুলোতে চলে যাবে। এতে করে সবার ভোগান্তি কমবে।

উন্নত স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া দেশগুলো করোনা সংকট মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছে৷ সেখানে নাজুক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বাংলাদেশে ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’-এর মত চিকিৎসদের উপর সব দোষ চাপানো হচ্ছে বলে মত সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসকদের৷

কোভিড-১৯ মহামারী বিশ্ব জুড়ে যে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে তাতে দেবদূত এখন স্বাস্থ্যকর্মীরাই। সারা বিশ্বেই স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রাণপণ করে এই মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছেন। করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে প্রাণ দিয়ে দেওয়া ডাক্তার-নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থকর্মীর সংখ্যাও নেহাত কম নয়৷

কিন্তু বাংলাদেশে এই চিকিৎসকদের উপরই উঠেছে অভিযোগের আঙুল। সারাদেশ থেকে বিনা চিকিৎসার মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষ ডাক্তারদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন। অন্যদিকে, চিকিৎসকেরা বলছেন, এখন তাদের ‘বলির পাঁঠা’ বানানো হচ্ছে। শুরু থেকেই কোভিড-১৯ প্রতিরোধে চরম অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতার কারণেই আজ পরিস্থিতি এত সঙ্কটজনক অবস্থায় উপনীত হয়েছে।

অবহেলার ঘটনা একেবারে নেই সেটা বলছি না। কিন্তু বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘটনা দিয়ে গণহারে ডাক্তাদের দোষ দেওয়াটাও ঠিক না। ডাক্তারদের এখন প্রচণ্ড মানসিক চাপ নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। শারীরিক পরিশ্রমও বেড়েছে।  

বাংলাদেশে ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত করা হয়। এরপর থেকে ধীরে ধীরে চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য করোনা একটি ভীতিকর বিষয়ে পরিণত হয়। তারা তখন পার্সোনাল প্রকেটশন ইকুইপমেন্ট বা পিপিই দাবি করেন এবং জানান পিপিই ছাড়া চিকিৎসা আসলেই অসম্ভব।

অনেক রোগীই উপসর্গ গোপন করে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন। কেউ কেউ করোনা পজেটিভ হলেও সেটা গোপন করছেন, পেশেন্ট পার্টি ভুল তথ্য দিচ্ছে ডাক্তারদেরকে। এতে করে করোনা আক্রান্ত রোগীকে সেবা দেওয়া একাধিক হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীদের আইসোলেশন বা হোম কোয়ারান্টিনে পাঠানো হয়েছে৷
এভাবে যদি সব চিকিৎসাকর্মীরা আক্রান্ত হন বা আইসোলেশনে যান বা হোম কোয়ারান্টিনে চলে যান তবে কে চিকিৎসা সেবা দেবেন ?

পৃথিবীর যেকোন দেশের তুলনায় বাংলাদেশে স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্তের হার বেশি। এর পেছনে মূলত দুইটা কারণ-

১.রোগীর তথ্য গোপন
২. নিম্নমানের পিপিই এবং মাস্ক।

করোনা একটি শত্রু। ওই শত্রুকে মোকাবিলা করতে হবে একইসঙ্গে অন্য শত্রু যেন আক্রমণ করতে না পারে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। এক শত্রুর মোকাবিলা করতে গিয়ে যেন ঘরের আরেকটি দরজা আমরা খুলে না রাখি। তাহলে সেই দরজা দিয়ে দ্বিতীয় শত্রু প্রবেশ করবেই। দু'টি দরজাতেই পাহারা বসাতে হবে। অন্যথায় বিপদ মারাত্মক রূপ ধারণ করতে পারে।

অদেখা ভাইরাসের বিরূদ্ধে এক অসম যুদ্ধে নেমেছে গোটা পৃথিবী। একদম অন্যরকম এক যুদ্ধ। না, এ যুদ্ধে অস্ত্রের কোন ঝনঝনানি নেই, বারুদের গন্ধ নেই। কিন্তু মৃত্যু আছে। আমাদের এই ছোট্ট দেশটাও কঠিন এক সময় পার করছে। প্রতি মুহূর্তে অমানবিকতা আর অনাচারের আস্ফালন। হ্যাঁ, এর ভিড়ে মানবিকতার গল্পও আছে।

যে মানুষটা একটা সরকারি চাকুরি করছেন তারও ঝুঁকি আছে। কিন্তু মাস শেষে বেতনের নিশ্চয়তা আছে। বাচ্চার দুধ, বাসা ভাড়া, মায়ের ওষুধ নিয়ে চিন্তা নেই। কিন্তু একবার ঐ বেসরকারী হাসপাতালের ডাক্তার, ইন্টার্ণ অথবা অনারারি মেডিকেল অফিসারের কথা ভাবেন তো। তাদের ঝুঁকি আছে। তারচেয়ে বেশি আছে অনিশ্চয়তা। মাস শেষে ঘরভাড়া, সংসারের আনুসঙ্গিক খরচ কোথা থেকে আসবে? 

আক্রান্ত হলে বা আক্রান্ত হয়ে মরে গেলে পরিবার পথে বসবে। মিলবে না কোনো অনুদান! পেশা এক ঝুঁকিও সমান সমান তাহলে কেন এই বৈষম্য। করোনা যুদ্ধে সকল স্বাস্থ্যকর্মীই প্রথম সারির যোদ্ধা। এই মুহূর্তে যেকোনো কিছুর চেয়ে বেশি জরুরি তাদের মনোবল ধরে রাখাটা। কোনো বৈষম্য নয়, সবার সমান স্বীকৃতি ও মর্যাদা নিশ্চিত করুন।

লেখক: সম্পাদক, বিবার্তা২৪ডটনেট।

(নিউজ টোয়েন্টিফোর/তৌহিদ)

সম্পর্কিত খবর