একদিন হঠাৎ থমকে যাবে সব আয়োজন!

একদিন হঠাৎ থমকে যাবে সব আয়োজন!

Other

আমার বিদেশে আসার প্রধান কারন আমার সন্তানদের নিরাপদ ভবিষ্যতের কথা ভেবে। আমাকে কেউ বাধ্য করেনি। আমি আপাতঃ নিরীহ টাইপ একজন মানুষ, কারো সাথে কোনো বিবাদে জাড়াই না। বিবাদ জিইয়ে রাখার মতো স্টামিনা আমার নাই।

আমি সবসময় আপস মিমাংসা করে নেই। কারো সাথে কখনো কিছু ঘটলে আমি নিজেই এগিয়ে আসি মিটিয়ে ফেলতে। নমনীয় হই। তবে কোনো অন্যায়ের কাছে আমি মাথা নত করব না।

সেখানে আমি অবিচল। এটাও ভাবি ছোট্ট এই জীবনে ঝগড়া ফ্যাসাদ করে কোনো লাভ নাই। আমার বিদেশ চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল আকস্মিক। হুট হাট অনেক সিদ্ধান্ত নেই আমি। পূৰ্বাপৱ পরিণতি না ভেবেই করি। আবার সিদ্ধান্ত পাল্টানোর অনেক ঘটনা আছে আমার।

আমি অনেক সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি। এমনও হয় কোথাও যাব বলে বের হয়েছি কিন্তু আবার ফেরত আসি। কোনো রেষ্টুরেন্ট খাব, সিদ্ধান্ত নিতে পারি না কি খাব, তাই বের হয়ে আসি রেষ্টুরেন্ট থেকে। অনেক সময় কাপড় চোপড় কিনে ফেরত দেই, নাহ্ এটা পছন্দ না! একবার আমি ইউরোপ যাব ট্যুরে, সব ঠিক ঠাক। টাকা এডভান্স দেওয়া হয়ে গেছে। ট্যুর শুরু হবে লন্ডন থেকে। টরন্টো লন্ডন টরন্টো রিটাৰ্ন টিকেটও কাটা শেষ, ট্রাভেল ইন্সুরেন্স কিনেছি। হঠাৎ আগের দিন সিদ্ধান্ত নিলাম ট্যুরে যাব না। ইউরোপ ট্যুর বাদ দিয়ে চলে গেলাম অটোয়া।

বিদেশ চলে যাওয়াটাও তেমনি। একদিন হঠাৎ মনে হলো দেশে থাকব না। চলে যাব কোথাও। এইসব চিন্তা ঢুকেছে ২০০০ সালের দিকে। সে বছর আমি আমেরিকা ঘুরতে যেয়ে হঠাৎ মনে হলো আরে এই দেশটাতো চমৎকার! কয়েকজন বন্ধু বলল থেকে যেতে। তখনও ৯/১১ হয়নি। আমেরিকা স্বর্গ। কিন্তু আমি ফিরে আসলাম। ফিরে এসে ঠিক করলাম, কানাডা যাব। সবাইকে নিয়ে যাব। সব ঠিক হওয়ার পর জেসমিন এবং আমার ছোট্ট অরিত্রি বেঁকে বসল বিদেশ যাবে না।

আমিও দ্বিধায় পড়ে গেলাম যাব কি যাব না। ততদিনে আমি দু'বার চাকরি বদল করেছি। নতুন চাকরিতেও সন্তষ্ট না। তাই বিদেশ চলে যাব। বিদেশে না জানি কত সুখ! জেসমিন তার চাকরি ছেড়ে যেতে ইচ্ছুক না। ছোট্ট অরিত্রি জানিয়ে দিল সে তার স্কুলের বন্ধুদের রেখে কোথাও যেতে চায় না। তখন সে স্কলাস্টিকায় সেকেন্ড গ্রেডে পড়ে। অৰ্ক চলে যাওয়ার জন্য এক পায়ে খাড়া। সে সব পরিবিশে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারে। ইন্টারনেট ঘেটে কানাডার সবকিছু জেনে নিয়েছে। একদিন আমরা বিদেশ পারি জমালাম। একটা সংসার উপড়ে আর একবার নতুন করে সংসার পাতা এতো সহজ কাজ না। ভিন্ন পরিবেশ, ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন কালচার, ভিন্ন মানুষ।

আমি অতি সিম্পল একজন মানুষ। এলেবেলে মানুষ। কোনো কিছু গুছিয়ে করতে পারি না। যখন যেটা করা দৱকাৱ সেটা করতে পারি না। প্রায়ই ভুল করি। প্রতিভারও অভাব আছে। নিজেকে তুলে ধরতে পারি না। কারো নজরে পরার মতো না। যখন একা হই তখন ভাবি কত সাধারন এই আমার জীবন, কত সাধারন আমার চাওয়া পাওয়া! আমার শৈশব কৈশোর ছিল সহজ আর সরলতায় ভরা। সবার ছোট ছিলাম বলে আমার প্রতি ভাই বোনদের অসীম ভালবাসা ছিল, পক্ষপাত ছিল। আমাকে কখনো কোনো কাজ করতে হতোনা। আমি একটু আহ্লাদি আর অভিমানী ছিলাম। আমার অভিমান এখনও বাচ্চাদের পৰ্যায়ে রয়ে গেছে।

শৈশবে মাকে ঘিরেই সব স্বপ্ন গড়ে উঠেছিল। কোনো কিছু দরকার হলেই মায়ের স্মরণাপন্ন হতাম। সব চাহিদা যে মা পূরন করতে পারতেন তা না। আমাদের সময় কম বেশি সব সংসারেই এক ধরণের সংকট থাকে, টানাপোড়েন থাকে। আমাদেরও ছিল। মা যে সবসময় আমাকে বুঝতে পারতেন তা না। ওভাবেই আমি বেড়ে উঠেছি। এখন অনেক কিছুই করতে পারি। না চাইতেও ছেলে মেয়েরা সদা প্রস্তুত বাবাকে খুশী করার জন্য। জীবন কত বদলে যায় ভাবতে অবাক লাগে।

আর দশটা কিশোরের মতো আমি হাসি, খেলি, বেড়াই। কোনো বৈশিষ্ট নাই তেমন। তখন থেকেই আমি খুব স্পৰ্শকাতৱ ছিলাম। অন্যধারার ছিলাম। কারো সাথে আমার খাপ খেতোনা। মানুষের জীবনে বেঁচে থাকাও যে একটা সংকট সেটা আমি বুঝতাম। অনুভূতিপ্রবন মানুষের এমনই হয়। বই পড়ার অভ্যাস হয়েছিল ছোটবেলা থেকেই। নিজের কষ্টগুলো টের পেতাম আমি। বিষন্নতায় আক্রান্ত হতাম। কেনো যে আমার এমন হতো আজও জানিনা। পারাপারের ললিতের মতো মাঝে মাঝে আমার মাথায় আকাশ ঢুকে পরে। তখন আমার পাগল পাগল লাগে। কোনো কিছু আমাকে আকড়ে ধরে রাখতে পারে না। আমি সবসময় বন্ধনমুক্ত থাকতে চেয়েছি। স্বাধীনতায় বাঁচতে চেয়েছি। আবার স্বাধীনতাও আমাকে সুখ দিতে পারে না। সুখ আর দুঃখের অনুভূতিটাই বড্ড গোলমেলে। সেইসব কারণে আমাকে কেউ বুঝে উঠতে পারেনি। আমিও নিজেকে বোঝাতে পারিনি। অন্যকে বুঝতে পারিনি। কথা শেয়ার করার মতো কেউ ছিলনা আমার।

বরিশালের জীবনে আমি খুব একাকী হয়ে গেছিলাম। এক অজানা আকৰ্ষনে, অচেনা নেশায় বরিশাল ছাড়লাম একদিন। কোনো কিছু পাওয়ার জন্য না, কিছু হওয়ার জন্য না। একদিন শূন্য হাতে একাকী বেড়িয়ে পরলাম। শুধু নিজের কথাগুলো নিজেকে বলার জন্য, বেঁচে থাকতে হলে একটা অবলম্বন দরকার আমার তাই আমি ঠিক করলাম আমি লিখব। সেই লেখা কেউ দেখবে না, কেউ পড়বে না, কেউ জানবে না, তাও আমি লিখব।

আরও পড়ুন:


নির্বাচনে কারচুপি: ৬ সিটিতে সমাবেশ করবে বিএনপি

প্রেমিকার বাসা থেকে যুবকের লাশ উদ্ধার, প্রেমিকা বলছে ‘আত্মহত্যা’

ইরানি কূটনীতিককে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেয়ার তীব্র নিন্দা

অনিয়ম আর দুর্নীতিতে ডুবছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিআরটিসি


পৃথিবী নামক জায়গাটা কঠিন এক জাৰ্নি। এর প্রতি পদে পদে রয়েছে ভয়, শঙ্কা আর অনিশ্চয়তা। কোনো কিছুই সহজে ঘটে না জীবনে। আবার পথ চলতে চলতে এও জানলাম পথের বাঁকে বাঁকে ভয় আর শঙ্কার পাশাপাশি ভালবাসা আর নিৰ্ভৱতাও রয়েছে। আমি যখন আউলা ঝাউলা হয়ে যাই ভোম্বলদাশ লাগে নিজেকে, অৰ্থহীন মনে হয় এই বেঁচে থাকা তখন এইসব ভাবনা মাথার মধ্যে জট পাকায়। তখন এলোমেলো করে দেয় সবকিছু। অন্য আর সবার মতো আমার কোনো দৌঁড়ঝাপ নাই, আমি তেমন কষ্টসহিঞ্চু না। জীবনটা সহজ রেখায় বয়ে চলুক এটাই আমি চাই। কিন্তু জীবনের চলার পথ এতো সহজ না। এর প্রতি পদে পদে রয়েছে লোভ লালসা ভয় আর ভুল করার আশঙ্কা। আমি প্রতি পদে পদে ভুল করি। সেই ভুল থেকে শিক্ষা নেই, আবার ভুল করি। অনেক অভিযোগ আমার সম্পৰ্কে। মানুষ হয়ে বেঁচে আছি বলেই জীবন যন্ত্রনা ভোগ করতে হয়। অভিযোগ শুনতে হয়। শরীর আর মন মিলিয়ে এক যন্ত্রনাময় জীবন যাপন করি আমরা।

আমার মধ্যে অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, অনেক অসম্পূর্তা রয়েছে। নিজেকে কখনোই যোগ্য করে তুলতে পারিনি। সবাই সব পারে না। সবাই সব পায় না। আমার চারপাশের মানুষদের প্রতিনিয়ত যে এক লড়াই দেখি, সফলতার জন্য, ক্ষমতার জন্য সেইসব থেকে আমি দুরে পড়ে আছি। আমি কখনোই তাদের মতো হতে পারব না। আমি সেসব জেনে গেছি। সেজন্য আমার কোনো অনুতাপ নাই, জীবন ফেনানো নাই। আমি আমার মতোই বেঁচে থাকতে চাই। এই তুচ্ছ জীবন নিয়েই পথ চলছি। ঘাটে ঘাটে নোঙর ভিরাই আমি। আজ এখানে কাল সেখানে। আমি কোথাও স্থির হতে পারিনি। আমার মা বলতেন, তুমি একটা পাখি, এই দেখি, আবার দেখি নাই। এই বলে মা কাঁদতেন। কেউ কারো জন্য কাঁদে না আজকাল। একমাত্র মা বাবারাই সন্তানের জন্য কাঁদেন। একমাত্র মা বাবাই সন্তানের জন্য অপেক্ষা করেন।

আমার জন্য কেউ যে অপেক্ষা করে না সেজন্য আমার অনেক নিৰ্ভাৱ লাগে। যখন আমি বরিশাল ছিলাম তখন সবসময় ভাবতাম এই গন্ডিবদ্ধ জীবনেই আমার সমাপ্তি ঘটবে! কিন্তু আমি মুক্তি চাইতাম। কিভাবে মুক্তি পাব তা জানতাম না। সেই থেকে ছুটে চলা শুরু হলো। নিজের অজান্তে জীবন থেকে জীবনের বাইরে চলে গেলাম। কিন্তু কোথাও নিজেকে প্রতিস্থাপন করতে পারিনি। বরিশাল থেকে ঢাকা চলে গেলাম। ঢাকা থেকে কানাডা। তারপর কত কত জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি।   প্রতিবছর ঢাকা আসি। নতুন বইয়ের ঘ্রান নিতে আসি। বই আমাকে বাঁচিয়ে রাখে। কখনো বরিশাল ছুটে যাই। মা বাবার কবরের কাছে বসে থাকি। শান্তি পাই। তারপর আবার ফিরে যাই। এই যে আসা যাওয়া এর মধ্যেই একদিন হঠাৎ জীবন থমকে যাবে।

news24bd.tv আহমেদ

সম্পর্কিত খবর