কালরাত 

সংগৃহীত ছবি

কালরাত 

(একটি সেলুলয়েডবিহীন তথ্যচিত্র)

কমলকলি চৌধুরী 

২৫ মার্চ ১৯৭১, বৃহস্পতিবার।  

রাত এগারোটার দিকে আচমকা সালেহুজ্জামানের হাতে ধরা অয়ারলেস সেটটি বেজে ওঠে। অজানা কোনো এক স্টেশন থেকে একজন বাঙালি সৈনিকের কণ্ঠস্বর শুনতে পান তিনি।
সৈনিক বলছিলেন,“ঢাকা সেনানিবাস থেকে মেশিনগান সজ্জিত ট্যাংক ও কামানবাহী সাজোয়াযানসহ পাকসৈন্যরা রাজধানীতে প্রবেশ করছে, বাঙালি সিপাহী তোমরা সাবধান হও!” 
এই ঘোষণার পরপরই পুলিশ কন্ট্রোলরুম থেকে মেসেজ আসে, “পুলিশ ডিউটি উইথড্রন!” 
এর কিছুক্ষণ পরই ঢাকা শহর জুড়ে আগুনের ফুলকি, সেই সাথে গোলাগুলির শব্দ, চারদিক থেকে মানুষের চিৎকার আর্তনাদ ভেসে আসতে থাকে।

প্রজ্জ্বলিত আগুনের লেলিহান শিখা, মেশিনগান আর কামানের আকাশ-ফাটা শব্দে সমস্ত শহর প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।
এ সময় সালেহুজ্জামান তার অয়ারলেস সেটে আবার শুনতে পান­ একজন পাকসৈন্য বলছে -- বাঙালি সালা লোক, আভি আকর দেখ্ তুমহারা কিৎনা মা-বহিন...!
কথাগুলো শোনার পর সঙ্গে সঙ্গে তিনি অয়ারলেস সেটটি অফ করে থানা ছেড়ে পার্শ্ববর্তী এলাকায় আত্মগোপন করেন।
কিন্তু সৈনিকের মন আত্মগোপন করে কি আর স্থির থাকে? ভীষণ অস্থির অস্থির লাগছিলো তার। অস্থিরতা কাটাতে সাহস করে রাস্তায় নেমে আসেন তিনি।

কী মনে করে যেন বন্ধু ফরিদ আলির সাথে দেখা করতে তার বাড়িতে চলে যান। সেখানে গিয়ে তিনি বন্ধুকে জানালার পাশে অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন।


২.
পুলিশের সুবেদার খলিলুর রহমানকে ২৫ মার্চ রাতে অন্যান্য কয়েকজন সিপাহিসহ কতোয়ালি থানার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। থানায় প্রবেশ করেই তিনি দেখেন মেঝে ভেসে যাচ্ছে চাপ চাপ রক্তে! গুলির আঘাতে দেয়াল ক্ষতবিক্ষত! সেই চাপ চাপ রক্তের উপর হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন সুবেদার খলিলুর রহমান। এভাবে কেটে যায় অনেকক্ষণ। হঠাৎ তার কাঁধের উপর সহকর্মী কামরুজ্জামানের হাত পড়তেই তিনি ভয়ে কেঁপে ওঠেন। ঝটিতে চোখ ফিরিয়ে কামরুজ্জামানকে দেখেই তাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন।

কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “এখানে এসেই দেখি এই অবস্থা! আমার পরিচিত অনেক বাঙালি পুলিশ ছিল এই থানাতে, তাদের কাউকেই খুঁজে পাচ্ছি না। কোনো যোগাযোগ করতে পারছি না, এগুলো মনে হয় তাদেরই রক্ত! হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন খলিলুর।

তাকে সান্ত্বনা দিয়ে কামরুজ্জামান বর্তমান পরিস্থিতি বোঝাতে চেষ্টা করেন, “আমাদের এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা মোটেও ঠিক নয়। তাড়াতাড়ি পালাতে হবে। অন্য বাঙালি পুলিশ ভাইদের সাথে যোগাযোগ করে কিছু একটা ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদেরকে অবশ্যই রুখে দাঁড়াতে হবে। এ পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে। প্রয়োজনে সবাইকে সংগঠিত হয়ে যুদ্ধে নামতে হবে...”
কথা শেষ করে কামরুজ্জামান খলিলুর রহমানের হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে আসেন। খলিলুর তখনও ঠিক ধাতস্থ হতে পারেননি। ব্যাপারটি ঠিক তার বোধগম্য হচ্ছে না।
একটি দেশের সেনাবাহিনী তার নিজের দেশের পুলিশবাহিনী আর জনগণের উপর এমন নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালাতে পারে­! এটি তার ঠিক বিশ্বাস হতে চাইছে না।
কামরুজ্জামান তাকে সঙ্গে করে খুব সন্তর্পণে হাঁটতে হাঁটতে বুড়িগঙ্গার তীরে চলে আসেন। সেখানে এসে তিনি তার সহকর্মী কয়েকজন পাঞ্জাবি সিপাহিকে দেখতে পান। সেইসাথে অনেক মৃতদেহ নদীর সারা পাড় জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে থাকতে দেখেন তিনি। লাশগুলো দেখে খলিলুর রহমানের মানসিক অবস্থার আরোও অবনতি ঘটতে থাকে। তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে অসহায়ের মতো এদিক সেদিক তাকাতে থাকেন। হঠাৎ তার চোখে পড়ে সহকর্মী সিপাহি আবু তাহেরের লাশ দুমড়ে-মুচড়ে বীভৎস ভঙ্গিতে পড়ে আছে। সেই সাথে আরোও অনেক পরিচিত অপরিচিত সিপাহির লাশ রক্তাক্ত অবস্থায় নদীর জলে ভাসতে দেখেন তিনি। কোনোকিছু চিন্তা না করেই প্রায় অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় সহকর্মী আবু তাহেরর লাশ নদী থেকে তুলতে যান। সাথে সাথে একজন পাকসৈন্য গর্জন করে উঠে,“শুয়োর কা বাচ্চা তুমকোভি পাকড়াতা হ্যায়, কুত্তাকা বাচ্চা তুমকোভি সাথ মে গুলি করেগা!” 
পাকসৈন্যটির গর্জনে  সংবিৎ ফিরে আসে তার। লাশ তোলা থেকে নিজেকে নিরস্ত করেন। থানা বরাবর লঞ্চঘাটের পাশে দাঁড়িয়ে দেখতে পান শত শত মানুষের ছিন্নভিন্ন লাশ নদীতে ভাসছে! শ্বাসরুদ্ধকর এই বীভৎস দৃশ্য দেখে ক্ষণে ক্ষণে তার শরীর শিউরে উঠছিলো। বিস্তৃত জলরাশি জুড়ে যত দূর চোখ যায় শুধু মৃতদেহ আর মৃতদেহ! রাস্তা-ঘাটে যত্রতত্র পড়ে আছে শিশু-কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ নানা বয়সের নারী-পুরুষের সারি সারি বিকৃত লাশ। নদী-মাঠ-ঘাট-প্রান্তর যেদিকে তাকান শুধু লাশ আর লাশ!

লঞ্চঘাট থেকে রাস্তা ধরে একটু এগিয়ে আসেন তারা। দেখতে পান কয়েকজন তরুণীর লাশ উলঙ্গ অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছে। এদের স্তন, যৌনাঙ্গ, উরু প্রভৃতি স্থান ছিন্নভিন্ন হয়ে আছে। খলিলুর রহমান বুঝতে পারেন বর্বর পশুরা হত্যা করার আগে তাদের দেহ কুরেকুরে খেয়েছে। যথেচ্ছভাবে ধর্ষণ শেষে গুলিতে ঝাঁঝরা করে চলে গেছে। তিনি নিজেকে আর স্থির রাখতে পারেন না, মৃতদেহগুলোর পাশে রাস্তায় বসে পড়েন। কামরুজ্জামান তাকে হাত ধরে টেনে তোলেন। দুজনে মিলে এগিয়ে চলেন সামনে। মনে মনে প্রস্তুতি নেন এর চেয়েও ভয়ঙ্কর কিছু দেখার! কিছু দূর গিয়েই তারা বেশ কয়েকজন শিশুর লাশ দেখতে পান। তাদের মাথার দিকটা থেতলে আছে। দেখলেই বোঝা যায় তাদেরকে পা ধরে আছড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। কিছু যুবকের লাশও তারা দেখতে পান, যাদেরকে বেয়োনেটের আঘাতে হত্যা করা হয়েছে। বেয়োনেটের আঘাতে তাদের বুক-পেট চিরে ফেলা হয়েছে। এক জায়গায় তারা দুজন যুবককে পড়ে থাকতে দেখেন যাদের পোশাক-পরিচ্ছদ সবকিছু ঠিকঠাক আছে কেবল মাথার দিকটা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে আছে। যুবকদ্বয়ের অবস্থা দেখে তারা সহজেই অনুমান করতে পারেন যে তাদেরকে রাস্তায় চেপে ধরে রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করতে করতে হত্যা করা হয়েছে।

এসব হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখতে দেখতে তারা সদরঘাট টার্মিনালে চলে আসেন। টার্মিনালের পাটাতনে পড়ে আছে সারি সারি অসংখ্য মৃতদেহ। তখনো রক্তে ভিজে চপচপ করছে।
তারা দুজন দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। এই মানুষগুলো আজ টার্মিনালে এসে জমা হয়েছিলেন প্রিয়জনদের কাছে যাবার উদ্দেশ্যে। কেউ ফিরে যেতে চেয়েছিলেন তার বাবা-মায়ের কাছে, কেউ ফিরে যেতে চেয়েছিলেন তার স্ত্রী-সন্তানের কাছে, কেউ ফিরে যেতে চেয়েছিলেন তার প্রেমিকার কাছে! তাদের জন্য গ্রামের বাড়িতে প্রতীক্ষায় রয়েছেন তাদের স্বজন। অথচ তাদের আর কখনো সেই অপেক্ষমাণ স্বজনের কাছে ফেরা হবে না! 
খলিলুর রহমান এবং কামরুজ্জামান দুজন দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে নীরবে এসব কথাই বলছিলেন।
এইভাবে দুজন দুজনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর তারা সদরঘাট টার্মিনাল থেকে ধীরে ধীরে পূর্বদিকে এগোতে থাকেন। তখন ভোর হয় হয়। এক জায়গায় এসে দেখতে পান একঝাঁক শকুন জটলা করে পড়ে থাকা কতোগুলো মৃতদেহ নিয়ে টানা-হেঁচড়া করছে। পূর্বদিকের রাস্তা ধরে তারা সোজা এগোতে থাকেন। চারপাশে কোথাও মানুষজনের চিহ্নমাত্র নেই। হঠাৎ খলিলুর রহমানের মনে হয় পিশাচেরা বুঝি একরাতেই ঢাকা শহরের সব মানুষকে মেরে ফেলেছে, শুধু বেঁচে আছেন তারা দুজন!

চারদিকে একটা থমথমে ভয়ার্ত পরিবেশ। কাকের একটানা ডাক পরিবেশকে আরো ভারি করে তুলেছে। চারদিকে আগুনে পোড়া আর গুলিতে ঝাঁঝরা হওয়া বিধ্বস্ত বাড়িঘর। কিছু ঘরবাড়ি তখনো জ্বলছে। পৌরসভার কাছে এসে তারা দেখতে পান ময়লা ফেলার গাড়িগুলো লাশে বোঝাই। তখনো নিচে পড়ে থাকা কিছু লাশ সুইপাররা টেনে-হিঁচড়ে গাড়িতে তুলছে। পাশে দাঁড়িয়ে একদল পাকসৈন্য পুরো বিষয়টি তদারকি করছে।
আলো-আঁধারি কেটে গিয়ে ততক্ষণে চারদিক ফর্সা হয়ে উঠেছে। পৌরসভার কাছ থেকে তারা হাঁটতে হাঁটতে ব্যাপটিস্ট মিশনের দিকে এগোতে থাকেন। রূপমহল সিনেমা হলের সামনে এসে দেখতে পান অনেক লাশ স্তুপিকৃত অবস্থায় পড়ে আছে। তাদের বুঝতে বাকি থাকে না বিভিন্ন বয়েসি এসব লোক গতরাতে সিনেমা দেখতে এসেছিলো। এখানে তারা বেশ কিছু মেয়েলোকের লাশও দেখতে পান যাদের শরীরে কোনো কাপড় ছিল না।
মিশনারি অফিস, বাসস্ট্যান্ড, কলিজিয়েট স্কুল, জজকোর্ট, প্যাগোজ হাই স্কুল, স্টেট ব্যাংক বিল্ডিং, ঠাটারিবাজার, গোপিবাগ, নয়াবাজার, তাহেরবাগ, টিপু সুলতান রোড, বনগ্রাম রোড, গুলিস্তান সর্বত্র শুধু মৃতদেহ আর মৃতদেহ! লাশে আর লাশে সয়লাব সমস্ত এলাকা। কোথাও কোথাও বড়িঘর আগুনে পুড়ছে। উঁচুউঁচু দালানগুলোর ফাঁক দিয়ে আগুন থেকে থেকে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠছে। সাহেববাজার ব্রিজ পেরিয়ে নবাবপুর রোডে ঢুকেই তারা একদল উৎসবমুখর বিহারিকে দেখতে পান। সে কী বিভৎস উল্লাসনৃত্য! উন্মত্ত লাফালাফি আর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে তারা, এদের সকলের হাতে শোভা পাচ্ছে সয়ংক্রিয় অস্ত্র। কয়েকজন বাঙালিকে ধরে এনেছে তারা, এঁদের সকলের হাত পেছনদিকে বাঁধা। শরীরে নেই কোনো কাপড়। ইচ্ছেমতো একেবারে ফ্রি-স্টাইলে কেউ চড় মারছে, কেউ ছুটে এসে লাথি মারছে, এমনিতরো নির্যাতন চলছে তাদের উপর। একজন লোকের পুরুষাঙ্গে ইট বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। একজনকে রাস্তায় ফেলে চিৎ করে শুইয়ে তার উপর দাঁড়িয়ে কয়েকজন উল্লাসনৃত্য করছে। এসব বিভৎস দৃশ্য দেখে তাদের শরীর শিউরে ওঠে।    
তবু তারা এগোতে থাকেন। সব দেখতে চান তারা। কতো নৃশংস হতে পারে মানুষ, আজ সচক্ষে দেখে নিতে চান তারা। ক্ষ্যাপামিতে পেয়ে বসে তাদের। নিজেদের বিপদের কথা চিন্তা না করেই তারা এগোতে থাকেন সামনের দিকে। উভয়ের পরনেই পুলিশের পোশাক। এ কারণেই তারা বেঁচে যাচ্ছেন। তাদেরকে কেউ তেমন একটা ঘাটাচ্ছে না।
তারা এগোতে থাকেন। সামনে তাদের জন্য যে আরোও ভয়ঙ্কর সব দৃশ্য অপেক্ষা করছে তার সবটুকু না দেখে আজ তারা কিছুতেই ক্ষান্ত দেবেন না। তারা আজ এর শেষ দেখতে চান।
একস্থানে এসে তারা দেখতে পান একদল বিহারি কয়েকটি বাঙালি শিশুকে বাঁশের মাথায় জীবন্ত বিদ্ধ করে ঝুলিয়ে রেখেছে রাস্তার ওপর। একটি শিশু তখনও জীবন্ত। এসব বিহারিদের হাতে শোভা পাচ্ছে মাংশকাটা-দা, শাবল, লোহার রড, কুড়াল, বন্দুক। দল বেঁধে এরা লুট করছে বাঙালিদের ঘরবাড়ি। তারপর তারা সেসব বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে।

ঠাটারিবাজার ট্রাফিক সিগনালের কাছে এসে তারা আরেকটি হৃদয়বিদারক ঘটনার মুখোমুখি হন। এক বাঙালি যুবকের পেটে বাঁশ ঢুকিয়ে তার মাথায় স্বাধীন বাংলার পতাকা টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। আর তাকে ঘিরে একদল বিহারি উল্লাসনৃত্য করছে। আরেকটু সামনে ঠিক ঠাটারিবাজারের মাঝখানে এসে তারা দেখেন কয়েকজন বিহারি একজন বাঙালি যুবককে মাটিতে চেপে ধরে তার মলদ্বার দিয়ে লোহার রড ঢুকানোর চেষ্টা করছে। যুবকটির আর্তচিৎকারে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠছে। কেউ নেই শোনার, কেউ নেই দেখার। তারা দেখছেন কিন্তু, তাদের নেই কিছু করার। বাধা দিলে নিজেদের জানটাও যে খোয়াতে হবে, এটি বুঝতে তাদের মোটেও অসুবিধা হচ্ছে না। বাধা দিয়ে তো তাদের নিরস্ত করতে পারবেনই না, উপর থেকে আবার কোন অত্যাচারের স্বীকার হন, এই ভয়ে তারা চুপ করে এসব বীভৎস ঘটনাবলি নীরবে সহ্য করে যান।
যুবকটি পানি পানি বলে আর্তনাদ করতেই একজন বিহারি তার মুখ বরাবর দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করে দেয়। এই দৃশ্যটিও তাদের নীরবে সহ্য করতে হয়।   

তারা সেখান থেকে সরে পড়েন। তারপর ঘুরতে ঘুরতে গুলিস্তান হয়ে বিজয়নগরের রাস্তা ধরে শান্তিনগর হয়ে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে চলে আসেন। সেখানে এসে দেখেন, পাকসৈন্যরা বাঙালি সিপাহিদের লাইনে দাঁড় করিয়ে তাদের ইচ্ছেমতো যাকে খুশি তাকে ধরে নিয়ে একটি ট্রাকে তুলছে। তারা দূরে দাঁড়িয়ে ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেন। সেখান থেকেই শুনতে পান পাকসেনারা বলছে, "শালা বানচোৎ, শুয়োরকা বাচ্চা, মালাউনকা বাচ্চা তুমহারা মুজিবর আব্বা আভি কাহা হ্যায়? হারামি বাঙালিকা বাচ্চা, জয়বাংলা বোলতা হ্যা? সব শালাকো এক গুন্তিছে খতম করদো। "
তারা আর সেখানে থাকা সমীচীন মনে করলেন না। দুজনে উল্টোদিকে ঘুরে হাঁটা দিলেন। হাঁটতে হাঁটতেই তারা তাদের বন্ধু ফরিদ আলির বাসায় যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন।
৩.
ফরিদ আলি এবং পুলিশ ইন্সপেক্টর সালেহুজ্জামান হাত-পা ছড়িয়ে বিছানার উপর অসহায়ের মতো বসেছিলেন। এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পেলেন। শব্দ শুনেই তারা তড়াক করে বিছানায় সোজা হয়ে বসলেন। ঝটিতে দুজন দুজনের দিকে তাকালেন। দুজনের দৃষ্টিতেই একটা ভয়, সেইসাথে একটা বেপরোয়া ভাব। ভাবটা এমন -- যা কিছু ঘটুক, কুছ পরোয়া নেহি।
ফরিদ আলি বিছানা থেকে নেমে দরজার দিকে এগোতেই সালেহুজ্জামান লাফ দিয়ে বিছানা থেকে ওঠে তাকে থামালেন। কোমর থেকে পিস্তল বের করে ইজেক্টর টেনে ট্রিগারে আঙুল রাখলেন। অতঃপর তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে। মনে মনে ভাবলেন, দরজার বাইরে মৃত্যু দাঁড়িয়ে, অসুবিধে নেই মরবেন। কিন্তু জীবনটা এমনি এমনি দেবেন না। কয়েকটাকে মেরে তবে মরবেন।
ফরিদ আলিও বেপরোয়া ভঙিতে শিরদাঁড়া সোজা করে বিছানায় বসে ভয়ঙ্কর কোনো ঘটনার প্রতীক্ষায় দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন। তার দৃষ্টিতে আগের সেই ভয় ভাবটা আর নেই। তার স্থলে সেখানে জেগে উঠেছে বেপরোয়া একটা ভাব। যা হয় হোক, তারা প্রস্তুত।
দরজার কাছ থেকে সালেহুজ্জামান অকম্পিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, "কে?" -- নিজের কণ্ঠ শুনে নিজেই খুব বিস্মিত হলেন। এমন পরিস্থিতিতে কেউ এমন স্বাভাবিক ভঙিতে কথা বলতে পারে!
এদিকে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। সালেহুজ্জামান আবার পূর্বের মতোই অকম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন­ "কে? কথা বলছেন না কেন?" কথাটা বলেই তিনি আর জবাবের অপেক্ষা করলেন না। ঝটিতে দরজা খুলে পিস্তল তাক করলেন। তিনি তাদেরকে প্রস্তুত হবার সুযোগ দিতে চান না। কিন্তু দরজা খুলেই দেখতে পেলেন সামনে দাঁড়ানো খলিলুর রহমান আর কামরুজ্জামান। তাদের অবস্থা একেবারে বিধ্বস্ত। চোখদুটো একেবারে রক্তবর্ণ আর ফোলা ফোলা। চুলগুলো উস্কখুস্ক। তাদের দেখে মনে হচ্ছে যেন মৃত্যুর দুয়ার থেকে কোনোরকমে ফিরে এসেছেন। অবশ্য সালেহুজ্জামানের ভাবনাটা একেবারে মিথ্যে নয়। সত্যিইতো তারা বিভৎস এক মৃত্যুলোকের ভিতর দিয়ে হেঁটে এসেছেন! যেকোনো সময় তারা নিজেরাও এই ইহধাম ত্যাগ করতে পারতেন। এখনো তারা বেঁচে আছেন, এ এক বিস্ময়কর ঘটনাও বটে। অবশ্য যে বীভৎস ঘটনাগুলো তাদের প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে তার চেয়ে বুঝি মৃত্যুই শ্রেয় ছিল।

তারা কোনো কথা না বলে সালেহুজ্জামানকে ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেলেন। সিনিয়র অফিসারকে সম্মান করার বিষয়টি তখন আর তাদের মাথায় নেই। না থাকাটাই স্বাভাবিক।
সালেহুজ্জামান দরজা বন্ধ করে আবার পূর্বের জায়গায় ফিরে আসলেন। ফরিদ আলি তাদেরকে দেখে একটু নড়েচড়ে বসলেন। কামরুজ্জামান একটি হাতলওয়ালা চেয়ার টেনে তাতে গা এলিয়ে দিলেন। খলিলুর রহমান মেঝেতে সটান শুয়ে পড়লেন। কারো মুখে কোনো কথা নেই। এইভাবেই কেটে গেল অনেকক্ষণ।
অবশেষে খলিলুর রহমান মুখ খুললেন। তিনি তার সদ্যলব্ধ অভিজ্ঞতার বিস্তারিত বিবরণ দিতে শুরু করলেন। তার কথা সালেহুজ্জামান এবং ফরিদ আলি উভয়েরই বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো। তাদের কাছে বিষয়টি এক ভয়ঙ্কর লোমহর্ষক গল্প বলে মনে হচ্ছিলো। কিন্তু সাথে সাথে তারা এটিও বুঝতে পারছিলেন যে, এটি কোনো গল্প নয়। ভাবছিলেন, আহা যদি সত্যি সত্যিই গল্প হতো! গল্পে তো অনেক ঘটনাই ঘটানো যায়। কিন্তু বাস্তবে যে এমন ঘটনা ঘটতে পারে, এ যে অবিশ্বাস্য!

ইলেক্ট্রিসিটি নেই। চৈত্র মাসের দুঃসহ গরমে বদ্ধ ঘরের ভেতরে অন্ধকারে বসে আছেন চারটি মানুষ। তাদের গরম লাগছে না। কারণ তাদের অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গেছে। তাদের সকলের মনে এখন কেবল একটাই ভাবনা, এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী! ভেবে ভেবে কোনো কূল-কিনারা খুঁজে পাচ্ছেন না। কী করবেন তারা এখন? কী করা উচিৎ তাদের? এভাবে হাত-পা গুটিয়ে যদি সবাই বসে থাকেন তাহলে তো চলবে না। কিছু একটা তো করতে হবে। কিন্তু কী করবেন তারা? কী করবেন! কী? কী করার সাধ্য আছে তাদের! সারা দেশ যখন আজ ঘাতকের অভয়-আস্তানা!  

 "এভাবে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে তো চলবে না। কিছু একটা তো করা চাই। এভাবে সবকিছু নীরবে সহ্য করা যায় না। "
নীরবতা ভেঙে প্রথম কথা বললেন 
সালেহুজ্জামান।

"আমরা সবাই ক্ষুধার্ত। সবার আগে কিছু খাওয়া দরকার। "
ফরিদ আলি বিছানা ছেড়ে উঠলেন। "আগে কিছু খাই তারপর না হয় ভাবা যাবে, কী করা যায়। " কথাগুলো বলতে বলতে তিনি খাবারের ব্যবস্থা করতে ভেতরের ঘরে চলে গেলেন।
এতক্ষণ যেন বিষয়টি কারো মনেই ছিল না। কিংবা এই পরিস্থিতিতে খাবারের কথা বলতে যেন তাদের মন ঠিক সায় দিচ্ছিলো না। অথবা তাদের ক্ষুধার অনুভূতিটাই লোপ পেয়ে গিয়েছিলো।
কিন্তু ফরিদ আলি খাওয়ার বিষয়টি তুলতেই সবার একসাথে ক্ষিধে পেয়ে গেল কিংবা ক্ষুধার অনুভূতিটি যেন সহসা ফিরে এলো।

সালেহুজ্জামান বিরবির করে বললেন, "বিশ্ব জুড়ে মানুষের একটাই মাতৃভাষা, ক্ষুধা!"

এরই মধ্যে বড় বড় চারটি বাটিতে করে মুড়ি-গুড় আর চারকাপ চা নিয়ে এলেন ফরিদ আলী বললেন, "নাও মুড়ি খাও, শেখ সাহেবের প্রিয় খাবার। "
খেতে খেতে চার বন্ধু ভাবতে লাগলেন, এখন এই অবস্থায় কী করা যায়। ভাবতে ভাবতে তারা এর কোনো কূল-কিনারা পেলেন না। একটা প্রশিক্ষিত আধুনিক সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে একটা নিরস্ত্র দিশেহারা জাতি কী করতে পারে!
সবাই আপনমনে চিন্তা করছেন, কোনো কথা বলছেন না কেউ। ঘরের ভেতরে মুড়ি চিবানোর আর চায়ের কাপে চুমুক দেয়ার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। সবাই ভীষণ চুপচাপ।
সালেহুজ্জামানই প্রথম কথা বললেন, "শেখ মুজিবকে ওরা অ্যারেস্ট করে ফেলেছে। এখন এই অবস্থায় কে দেবে দিক-নির্দেশনা!"
খলিলুর রহমান এতক্ষণে নিজেকে বেশ সামলে নিয়েছেন। তিনি বললেন, "শেখ সাহেব তো সাত তারিখের ভাষণেই বলে দিয়েছেন কী করতে হবে। তিনি হয়তো তখনি বুঝতে পেরেছিলেন তাকে গ্রেফতার করা হবে। সেটা বুঝতে পেরেই হয়তো বলেছিলেন, যদি হুকুম দিতে নাও পারেন আমরা যেন আমাদের কাছে যা-কিছু আছে তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করি। স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষণা তো তিনি সেদিনই দিয়ে রেখেছেন। "
এতক্ষণ ফরিদ আলি পুরোনো পত্রিকাগুলো ঘাটছিলেন। অবশেষে তিনি তার কাঙ্ক্ষিত পত্রিকাটি খুঁজে পেলেন। ৩ মার্চের দৈনিক আজাদ পত্রিকা সবার সামনে মেলে ধরলেন তিনি। ‘বাঙালিরা একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হতে চায়। ’ শেখ মুজিবের এই উক্তিটির দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বললেন, "স্বাধীনতার ঘোষণার আর বাকি রইলো কোথায়? বঙ্গবন্ধু এই ঘোষণা দিলেন দুই তারিখে আর তিন তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে দেয়া হলো। তাছাড়া গত সতের তারিখে চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে মৌলানা ভাসানী কী বলেছেন? বলেছেন, শেখ মুজিব বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিয়েছেন, আর দ্বিধা নয়, সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। আঠারো তারিখের সব কাগজে খবরটি ছাপা হয়েছে, আমি নিজ চোখে দেখেছি। সুতরাং এখন আর ঘরে বসে ভাবাভাবির সময় নেই, কোনো কারণও নেই। আমাদের যা-কিছু আছে তাই নিয়ে এখন শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। যত দেরি হবে আমরা ততো পিছিয়ে পড়বো। শেষে আর উঠে দাঁড়াবারও অবকাশ থাকবে না। "
একসাথে এতোগুলো কথা বলে তিনি থামলেন। জবাবের প্রতীক্ষায় সবার মুখের দিকে একবার করে তাকালেন।
তারপর আবারও যেন কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু কামরুজ্জামান তাকে বাধা দিয়ে বললেন, "এটা কোনো যুক্তির কথা নয়, এটা স্রেফ আবেগের কথা। শুধু আবেগ দিয়ে যুদ্ধ হয় না, যুদ্ধের জন্য শক্তির প্রয়োজন, সামর্থের প্রোয়োজন। এতবড় একটা সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়বো, আমাদের সেই শক্তি কোথায়? কোথায় পাবো অস্ত্র? যা-কিছু দিয়ে মারামারি হয়, যুদ্ধ হয় না। "

ফরিদ আলি বেশ কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বললেন, "আবেগ দিয়ে যুদ্ধ হয় না কে বলেছে? আমরা আমাদের আবেগ দিয়েই যুদ্ধ করবো। আমরা আমাদের মাতৃভূমিকে পিশাচদের হাত থেকে বাঁচাতে যুদ্ধ করবো। আমরা হায়েনাদের হাত থেকে আমাদের মা-বোন-সন্তানদের রক্ষা করতে যুদ্ধ করবো। "

ফরিদ আলির মুখের কথা কেড়ে নিয়ে খলিলুর রহমান বললেন, "আমরা একটা সত্য ও ন্যায়ের যুদ্ধে নামবো। আর ওরা হচ্ছে হানাদার, অন্যায়কারী। সুতরাং মনোবলের দিক থেকে আমরা ওদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। আর তাছাড়া যুদ্ধে নামলে পথ আপনা থেকেই বেরিয়ে আসবে। আগে তো নামতে হবে! ঘরে বসে এভাবে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করার তো কোনো মানে নেই। ঘরে বসে থাকলেও যখন মরতে হবে তখন যুদ্ধ করে মরাটাই তো শ্রেয়। "

আবার সবাই চুপচাপ। কিছুক্ষণের নীরবতা। অবশেষে নীরবতা ভঙ্গ করে কামরুজ্জামান কপালে ভাঁজ তুলে চিন্তিত মুখে বললেন, "সবইতো বুঝলাম, কিন্তু আমরা শুরুটা করবো কীভাবে?"
এ প্রশ্নের উত্তর যে কারো জানা নেই। তারা শুধু জানেন, তাদের উপরে একটা যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে, তাদের বাবা-ভাই-সন্তানদের নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে, তাদের মা-বোন-কন্যাদের ইজ্জত যথেচ্ছ লুণ্ঠিত হচ্ছে! সুতরাং এখন ঘরে বসে থাকার সময় নয়। এখন সময় যুদ্ধে যাবার। কিন্তু কীভাবে? কীভাবে শুরু হবে সেই যুদ্ধ? এই প্রশ্নের উত্তর যে সবার অজানা।

তাদের চারজনের মধ্যে সালেহুজ্জামান যেহেতু পুলিশের ইন্সপেক্টর সুতরাং তারই উপর বর্তায় তাদেরকে নেতৃত্ব দেয়ার দায়িত্ব। কেউ অবশ্য মুখ খুলে একথা বলে না। কিন্তু সবার মনেই এরকম একটা চাওয়া। সালেহুজ্জামান নিজেও বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারেন। তিনি সবার দিকে একবার করে গভীরভাবে তাকালেন। তাদের চোখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে বললেন, "যুদ্ধে যাবো সেটা ঠিক আছে, কিন্তু তার আগে নিজেদের প্রস্তুতিরও একটা ব্যাপার আছে। বাড়িতে গিয়ে অন্তত স্বজনদের সাথে একবার দেখা করে আসার দরকার। তাদের কাছ থেকে অন্তত বিদায় নিয়ে আসার তো দরকার। "

ফরিদ আলি বাধা দিয়ে বললেন, "না, তার কোনো দরকার নেই। বাড়িতে গিয়ে অযথা মনকে দুর্বল করার কোনো মানে হয় না। যুদ্ধে গেলে এখান থেকেই চারজন একসাথে যাবো। বাড়িতে যেতে চাইলে আমাদের আর এ জীবনে দেখা নাও হতে পারে। হয়তো বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতেই পারবো না। তার আগেই কোথাও মরে পড়ে থাকবো, কেউ জানতেও পারবে না। "
"কিংবা ধরো কোনোরকমে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছলাম, প্রিয়জনদের কাছ থেকে বিদায়ও নিলাম, কিন্তু তারপর আবার আমরা একসাথে মিলতে পারবো তারই-বা কী নিশ্চয়তা আছে? সুতরাং এখন এবং এখান থেকেই শুরু করতে হবে। আর কোনো উল্টোপাল্টা চিন্তা করা যাবে না। " 
ফরিদ আলির কথার সাথে এটুকু যোগ করলেন খলিলুর রহমান।

সালেহুজ্জামান কামরুজ্জামানের মুখের দিকে তাকালেন। তিনি তার কাছ থেকেও এ ব্যাপারে কিছু শুনতে চান। কামরুজ্জামান সম্মতিসূচক মাথা নাড়ছিলেন। তার এই মাথা নাড়াতে সালেহুজ্জামান সন্তুষ্ট হতে পারেন না। তিনি স্পষ্ট করে কিছু শুনতে চান। কিন্তু কামরুজ্জামান কোনো কথা বলছেন না দেখে তিনি তার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করেন, "আপনি কী বলেন? আপনারও কি একই মত?"
কামরুজ্জামান অত্যন্ত স্পষ্ট এবং বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেন, "হ্যাঁ, আমিও তাদের সাথে একমত। বাড়িতে যাবার আমি কোনো প্রয়োজন দেখি না। আমাদের এখান থেকেই সরাসরি যুদ্ধে যাওয়া উচিত। "

সালেহুজ্জামান নিজেও তা-ই চাইছিলেন। কিন্তু তিনি একা সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছিলেন না। তাদের সবার মনের কথাটি জানার জন্যই তিনি এ প্রসঙ্গের অবতারণা করেছিলেন। সবার মতামত জানতে পারায় তার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া অনেকটা সহজ হয়ে যায়। তিনি বলেন, "যা-হোক, আপনারা সবাই একজন প্রকৃত যোদ্ধার মতোই কথা বলছেন। "

এমন সময় দরজায় আবার কড়া নাড়ার শব্দ। সবাই একসাথে চমকে ওঠেন তারা। কে এলো আবার এই সময়?
দরজা খুলতেই হন্তদন্ত হয়ে ফরিদ আলিকে প্রায় ঠেলেই ভেতরে ঢুকলেন আনিসুর রহমান। তিনি ফরিদ আলির খুব কাছের মানুষ, অনেকটা বন্ধুর মতোই। ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্টে আছেন।
ফরিদ আলি দরজা বন্ধ করে আনিসুর রহমানকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। পরিচয়পর্ব শেষ হলে আনিসুর রহমান বললেন, "গতকাল রাতে যখন ওরা আমাদের পিলখানা সদরে হামলা চালালো, সৌভাগ্য আমার যে আমি তখন সেখানে ছিলাম না। তাই জোর বাঁচা বেঁচে গেছি। জানোয়ারগুলো কাউকে  ছাড়েনি। কেউ রক্ষা পায়নি পিশাচগুলোর হাত থেকে। কাল রাতে পাশেই একটা আত্মীয়ের বাড়িতে ছিলাম। এখন ওরা আমাকে ছাড়ছিল না। কোনোরকমে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে চলে এলাম। তাদেরকে বলে এসেছি, যেন ফাঁক পেলেই ওরা গ্রামের বাড়িতে চলে যায়। "
একটু থেমে তিনি সবার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, "আপনাদের কারো পরিবার কি ঢাকাতে আছেন?"
সবই এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়েন।
আনিসুর রহমান বলেন, "যাক, এটা অন্তত একটা ভালো খবর। এখন আপনাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ দিচ্ছি। কাল রাতে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার পূর্বমুহূর্তে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে টিএন্ডটি’র টেলেক্সযোগে বার্তা পাঠিয়েছেন। ইপিআর-এর ওয়ারলেস থেকে সারা দেশে তা প্রচার হয়ে গেছে। "
সবাই উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "কী ঘোষণা দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু?"
"This may be my last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved."
 অতঃপর আনিসুর এক এক করে সবার মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন, সদ্য পরিচিত এই মানুষদের চোখমুখের ভাষা পড়তে মোটেও ভুল করলেন না তিনি।
দূরে কোথাও যেন বেজে উঠলো দামামা, নাকি তাদের বুকের গভীরে!

লেখক পরিচিতি: অধ্যাপক ও কবি ।
সূত্র: 
একাত্তরের গণহত্যা ও নারী নির্যাতন -- আসাদুজ্জামান আসাদ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -- ড. মোহাম্মদ হাননান।
news24bd.tv/ডিডি
 

সম্পর্কিত খবর