ভ্রূণ ভাস্কর্য সিরিজ: ‘অলৌকিক অভিযাত্রা’

ভ্রূণ ভাস্কর্য সিরিজ: ‘অলৌকিক অভিযাত্রা’

Other

মানুষের জীবন বলতে সাধারণত জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সময়কেই বোঝায়। কিন্তু জন্মের আগেই তাকে সমাপ্ত করে আসতে হয় এক সুদীর্ঘ অভিযাত্রা। জনকের শুক্রাণু ও জননীর ডিম্বাণুর মিলনের মাহেন্দ্রক্ষণে শুরু হয়ে নিষেকের মাধ্যমে প্রথমে জাইগোট, এরপরে ভ্রূণ এবং ধাপে ধাপে বিকশিত হয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ মানবশিশুতে পরিণত হওয়ার দীর্ঘ পথপরিক্রমা।

জ্ঞাতসারে কিন্তু অগোচরে, মাতৃজঠরের বদ্ধকুঠুরীতে চলতে থাকে এ অলৌকিক অভিযাত্রা।

পরিশেষে কোনো এক শুভক্ষণে জন্ম-দরোজা ভেদ করে ধরণী মায়ের কোলে অভিষেক ঘটে আলোক-অভিসারী নতুন অতিথির। শুরু হয় নতুন অভিযাত্রা। চরাচরে চরৈবেতি...


আরও পড়ুন: লক্ষাধিক টাকার কাজ ১১ হাজার টাকায় করেন অপু!

শ্রীলেখার বর্ষবরণ যেভাবে

চোখের জলে ‘মিডিয়া’ থেকে দীপিকার বিদায়!


অজানাকে জানার কৌতুহল মানুষের সহজাত। তাই স্বভাবতই সৃষ্টির শুরু থেকেই জন্মের আগের সময় নিয়েও তার জিজ্ঞাসা ছিলো অন্তহীন।

কিন্তু মাতৃগর্ভের গোপন কন্দরের খবর জানা তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। সেটা তার কাছে ছিলো এক দুর্ভেদ্য রহস্যপুরি। যেখানে রহস্য, সেখানে সৃষ্টি হয় নানা জল্পনা-কল্পনার। এর ফলে তৈরি হয় বিবিধ সংস্কার-কুসংস্কার। জন্ম-পূর্ব সময় নিয়ে কৌতুহল মেটাতে মানুষ এসব সংস্কার-কুসংস্কারের বেড়াজালেই আচ্ছন্ন থেকেছে বিগত শতাব্দীর গোড়ার দিক অব্দি। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি মানুষের জন্মরহস্য উদঘাটন করতে সমর্থ হয়। শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর নিষেক থেকে ভ্রূণের গঠন ও বিকাশের প্রতিটি স্তর পরতে পরতে মেলে ধরে তার চোখের সামনে।

এক সময় যে বিষয়ে বিন্দু-বিসর্গও জানা ছিলো না, কালক্রমে তা হয়ে উঠেছে একটি পূর্ণাঙ্গ শাস্ত্র: ভ্রূণতত্ত্ব বা এমব্রিওলজি। যদিও এ সংক্রান্ত পূর্ণ জ্ঞান এখনো বিশেষজ্ঞদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সাধারণ মানুষ জানে যৎসামান্য। কুসংস্কারের অন্ধকার ও অভিশাপ এখনো পুরোটা কাটেনি। তবে অনেকে একটু বিশদ জানতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তেমন একজন হলেন ইংল্যান্ডের বর্তমান সময়ের শীর্ষস্থানীয় শিল্পী ড্যামিয়েন হার্স্ট। নিজের প্রথম সন্তানের জন্মের পর প্রাক-জন্ম সময় বা ভ্রূণের বিকাশ সম্পর্কে তার আগ্রহ ও আকর্ষণ বেড়ে যায়। এ নিয়ে তিনি বেশ কিছু ড্রয়িং করেন।  

কাতারের সাবেক আমির হামাদ বিন খলিফা আল-সানির মেয়ে ও বর্তমান আমির তামিম বিন হামাদ বিন খলিফা আল-সানির বোন শেইখা আল-মায়াস্সা ইংল্যান্ডের গ্লুচেস্টারশায়ারে শিল্পী হার্স্টের স্টুডিও পরিদর্শনে গেলে তিনি শেইখাকে ড্রয়িংগুলো দেখান এবং শেইখার কাছে ড্রয়িংগুলোকে বৃহদাকার সিরিজ ভাস্কর্যে রূপ দেওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। শেইখা আল-মায়াস্সা তার দেশের  রাজধানী দোহায় মা ও শিশুদের জন্য নিবেদিত আট শ’ কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মাণাধীন হাসপাতাল সিদরা মেডিকেল এন্ড রিসার্চ সেন্টারের সামনে প্রস্তাবিত ভাস্কর্য সিরিজটি স্থাপনের পরিকল্পনা করেন।

পরিকল্পনা অনুযায়ী হার্স্ট ১৪টি ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যের একটি সিরিজ তৈরি করেন। এর নাম দেওয়া হয়, ‘দ্য মিরাকিউলাস জার্নি’ বা ‘অলৌকিক অভিযাত্রা’। দুই কোটি মার্কিন ডলার ব্যয়ে স্থাপিত এ ভাস্কর্য সিরিজে শুক্রাণু তথা গর্ভধারণ থেকে শুরু করে মাতৃগর্ভে একটি শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ ধারাবাহিকভাবে ১৪টি ধাপে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। শুধু ভ্রূণই নয় সাথে এর আধার মাতৃজরায়ুও রয়েছে ভাস্কর্যের অংশ হিসেবে। ভাস্কর্যগুলোর উচ্চতা ৫ থেকে ১১ মিটার এবং মোট ওজন ২১৬ টন। ১৪তম ভাস্কর্যটি ৪৬ ফুট উঁচু একটি ছেলে শিশুর। ভাস্কর্য সিরিজটি মূলত ২০১৩ সালে স্থাপন করা হয়। তবে হাসপাতালের নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়ায় ২০১৮ সালের নভেম্বর পর্যন্ত প্রতিটি ভাস্কর্য এক-একটি বেলুন দিয়ে ঢেকে রাখা হতো, যা ধীরে ধীরে খুলে গিয়ে পুরো ভাস্কর্যটি উন্মোচন করে দেখাতো।

ভাস্কর্য সিরিজটি স্থাপনের পর পাঁচ বছর পর্যন্ত বেলুন আবৃত করে রাখার কারণ হিসেবে কর্তৃপক্ষের তরফে হাসপাতালের নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়াকে দেখানো হলেও অনেকে মনে করেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিরূপ সমালোচনার পরে তারা ভাস্কর্য সিরিজটিকে আপাতত জনসাধারণের দৃষ্টির অন্তরালে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।

নেতিবাচক সমালোচনার একটি বড় কারণ ছিল এটি ‘মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম নগ্ন ভাস্কর্য’। যদিও নগ্ন ভাস্কর্যটি একটি নবজাতকের। তবু সংস্কৃতিগত পার্থক্যের কারণে অর্থাৎ মুসলিম-অধ্যুষিত দেশ হওয়ায় এ নিয়ে বিতর্ক হওয়া ছিলো স্বাভাবিক। কেননা দেশটি ইউরোপ-আমেরিকার নয়, মধ্যপ্রাচ্যের। তাই শাসক-গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে এটি ছিলো একটি অত্যন্ত সাহসী পদক্ষেপ। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো স্বচ্ছ এবং অবস্থান ছিলো শক্ত ও অনড়। তারা দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করেছেন, এ ভাস্কর্য সিরিজটিতে নারী ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে সিদরা মেডিকেল এন্ড রিসার্চ সেন্টারের মিশন প্রতিফলিত হয়েছে। অতএব, এটি এ ভাস্কর্য সিরিজ স্থাপনের উপযুক্ত ও যথাযথ স্থান।

news24bd.tv তৌহিদ