আধুনিক রাষ্ট্রগুলোতে ‘পার ক্যাপিটা জিডিপি’ একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। এ সূচকটি দিয়ে বুঝা যায়— কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকেরা কতো বেশি উৎপাদনশীল। সিঙ্গাপুরের ‘পার ক্যাপিটা জিডিপি’ ৬৪০০০ মার্কিন ডলার, এর অর্থ হলো একজন সিঙ্গাপুরিয়ান নাগরিক বছরে ৬৪০০০ মার্কিন ডলারের পণ্য ও সেবা উৎপাদন করেন। অন্যদিকে চেক রিপাবলিকের ‘পার ক্যাপিটা জিডিপি’ ২৩০০০ মার্কিন ডলার, যা সিঙ্গাপুরের চেয়ে ৪১০০০ মার্কিন ডলার কম।
এ পরিসংখ্যান অনুসারে সিঙ্গাপুরের অর্থনীতি চেক রিপাবলিকের অর্থনীতির চেয়ে অধিক সফল।কিন্তু কে অধিক সুখী? একজন সফল সিঙ্গাপুরিয়ান না কি একজন ব্যর্থ চেকোশ্লোভাকিয়ান? একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, একজন সিঙ্গাপুরিয়ানের চেয়ে একজন চেকোশ্লোভাকিয়ান অধিক সুখী জীবন যাপন করেন। সিঙ্গাপুর ঘুরে আমার নিজেরও এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। সবাই শুধু কাজ আর কাজ করছে।
এখানে আমি আরও একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। ২০১৬ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংখ্যা যে-তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে আমি দেখি যে, ইউরোপে প্রতি এক লাখ মানুষে প্রায় সাড়ে পনেরো জন আত্মহত্যা করে থাকে; যা দরিদ্র আফ্রিকার তুলনায় অনেক বেশি। আফ্রিকাতে এ সংখ্যা প্রতি এক লাখে সাড়ে সাত জন। পূর্ব মেডিটেরানিয়ান অঞ্চলে, যেমন সিরিয়া, মিশর, ও জর্ডানে এ সংখ্যা আরও কম। লাখে মাত্র চার জন।
এখান থেকে আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে, অর্থনৈতিক বা বৈষয়িক উন্নতি, যেটিকে আমরা সফলতা বলছি, সেটির সাথে সুখের কোনো সমানুপাতিক সম্পর্ক নেই। স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান, স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার, নিরাপদ পরিবহন, নির্বিঘ্ন বিদ্যুৎ, ভালো গতির ইন্টারনেট, প্রয়োজনীয় ইলেকট্রনিক ডিভাইস, এবং চলনসই পোশাকের চাহিদা যখন মিটে যায়, তখন আর বৈষয়িক উন্নতির সাথে সুখের খুব বেশি সম্পর্ক থাকে না। বৈষয়িক উন্নতির সাথে সুখের সম্পর্ক যতো খারাপ হয়, সফলতার সাথে বৈষয়িক উন্নতির বন্ধুত্ব ততো গাঢ় হয়।
সুখ উপভোগের জন্য প্রয়োজন অবসর সময়, কিন্তু সফলতা উপভোগের জন্য প্রয়োজন শুধু খেটে মরা। খেটে মরে কেউ সুখি হতে পারে বলে মনে করি না। অতিরিক্ত খাটা স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো নয়। একবার আমার একটি ওয়েবসাইটে, তিন মাসে প্রায় দেড় কোটি টাকার টাই সেট বিক্রি হলো। এতে আমার লাভও হলো ভালো। কিন্তু লক্ষ করলাম, এ তিন মাস আমি প্রচুর পরিশ্রম করেছি। বিজ্ঞাপন ডিজাইন করা, প্রোডাক্ট ডিজাইন করা, চীনে কারখানার সাথে যোগাযোগ রাখা, শিপমেন্ট দেখভাল করা, ওয়েবসাইট দেখভাল করা, বাংলাদেশে আমার কর্মীদের সামলানো, ইত্যাদি করতে গিয়ে আমি কোনো অবসর সময় পাই নি।
ফলে আমি ওই উপার্জনের কোনো সুখও উপভোগ করতে পারি নি। এমন কি আমার স্ত্রীকেও সময় দিতে পারি নি। পড়াশোনো থেকেও বিচ্ছিন্ন ছিলাম। প্রতি ঘন্টায় হাজার হাজার টাকার অর্ডার পড়ছে, শুধু এটিই উপভোগ করছিলাম। এক পর্যায়ে এটি হয়ে উঠলো নেশার মতো। কোনো ঘন্টায় কেউ অর্ডার না করলে প্রচন্ড মন খারাপ হতো, এবং সাথে সাথে অর্ডার না পরার কারণ অনুসন্ধান করতে বসতে হতো। দেখা যেতো পিক্সেল রেসপন্সে কোনো গোলমাল হয়েছে, পারচেজ ইভেন্টে ডাবল কাউন্ট হচ্ছে, ফলে ফেসবুক ঠিকমতো বুঝতে পারছে না কাকে কাকে বিজ্ঞাপন দেখাতে হবে। সমাধান করার পর আবার অর্ডার পড়া শুরু, আবার সেই মাদকীয় উপভোগ। প্রতি ঘন্টায় হাজার হাজার টাকা আয় হচ্ছে, এর চেয়ে নেশাদায়ক আর কী হতে পারে?
একদিন আমি হিশেব করতে বসলাম, ভালোভাবে চলার জন্য মাসে আমার কতো টাকা প্রয়োজন? আমি অংকটি বের করলাম, এবং দেখলাম যে এর চেয়ে বেশি উপার্জন করার কোনো প্রয়োজন আমার নেই। প্রয়োজনের অতিরিক্ত যাই উপার্জন করবো, তাই মেদ হিশেবে জমা হবে, এবং সুখ নষ্ট হবে। আমার কাছে সুখ হলো প্রচুর অবসর সময় পাওয়া, যেন আমি পড়তে, ও লিখতে পারি, এবং প্রিয়জনদের সময় দিতে পারি। যদি আমি অতিরিক্ত উপার্জন বন্ধ না করতাম, তাহলে এ লেখাটি আমি লিখতে পারতাম না। লেখাটি না লিখলে হয়তো আমি আয় করতে পারতাম অনেক টাকা, কিন্তু তা হতো প্রয়োজনের অতিরিক্ত আয়, যা আমার জন্য পেটের উপরে জমা চর্বির মতোই ক্ষতিকর হতো।
আরও পড়ুনঃ
মিয়ানমারে সামরিক ক্যু’র পর সহিংসতায় ২ লাখ ৩০ হাজার উদ্বাস্তু
বৃটেনের বেথনাল গ্রিন ও বো লেবার পার্টি বিএএমই শাখার নতুন কমিটি ঘোষণা
চীনের মার্শাল আর্ট ট্রেনিং সেন্টারে ভয়াবহ আগুন, নিহত ১৮
যানবাহন, অফিস-আদালতসহ সবকিছু বন্ধের প্রস্তুতি, চালু থাকবে জরুরি সেবা
আমি অস্বীকার করছি না যে উৎপাদনের সাথে বা জিডিপির সাথে সুখের কোনো সম্পর্ক নেই, তবে তা অতোটা নয়, যতোটা রটানো হয়। রাষ্ট্র নাগরিকদের প্রতিদিন উদ্বুদ্ধ করছে বেশি বেশি উৎপাদন করার জন্য, কারণ নাগরিকেরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত উৎপাদন না করলে রাষ্ট্রের চালকেরা বাঁচবে না। বাংলাদেশ সরকার এই মুহুর্তে সবচেয়ে বেশি খুশি হাকিমপুরি জর্দার মালিকের উপর। সরকারের দৃষ্টিতে তিনিই সবচেয়ে বেশি উৎপাদন করছেন, কারণ প্রতিবছর তিনিই সবচেয়ে বেশি কর পরিশোধ করছেন।
সরকার কি আমার এ লেখাটি পড়ে খুশি হবে? মোটেই না। সরকার খুশি হতো যদি আমিও একটি তামাক ফ্যাক্টোরি খুলে সরকারকে কোটি কোটি টাকা কর দিতাম। রাষ্ট্রের চোখে একজন লেখকের চেয়ে একজন জর্দা কোম্পানির মালিক অধিক গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্র কি আমাকে সফল বলবে? না, রাষ্ট্র আমাকে সফলও বলবে না। রাষ্ট্র সফল বলবে হাকিমপুরীকে; যদিও আমি মানুষের ফুসফুস উন্নত করছি, আর হাকিমপুরী ধ্বংস করছেন।
রাষ্ট্র যদি কোনোদিন আমাকে পুরস্কৃতও করে, তাহলে ওই পুরস্কার রাষ্ট্রকে কিনতে হবে হাকিমপুরীর জর্দার টাকা দিয়ে; এবং পুরস্কারে তামাকের গন্ধ থাকার কারণে আমাকে তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
('মানুষ এবং অন্ধকারের প্রশংসা' থেকে)
news24bd.tv / নকিব