ঈদের খাবারে সতর্কতা অবলম্বন করুন

ঈদের খাবারে সতর্কতা অবলম্বন করুন

রমজানে আমাদের খাওয়াদাওয়ার নিয়মকানুন থাকে ভিন্ন রকম। রোজা শেষে আবার ফিরে যাই গতানুগতিক খাদ্যাভ্যাসে। তবে পুরো মাস যাঁরা রোজা রেখেছেন, পুরনো খাদ্যাভ্যাসে ফিরতে তাঁদের একটু সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। হঠাৎ করে বেশি খেলে এ সময় হতে পারে বদহজম, বমি, ডায়রিয়া, পেট ফাঁপাসহ নানা সমস্যা।

এ বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক, ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ

সকালে যা খাবেন
সাধারণত ঈদের দিনের সকালটা শুরু হয় মিষ্টি বা সেমাই জাতীয় খাবার দিয়ে। ঈদের নামাজ পড়ার আগে সেমাই, ফিরনি, পায়েস বা হালকা নাশতা খাওয়া যেতে পারে। খাওয়ার আধা ঘণ্টা পর দেড় থেকে দুই গ্লাস পানি খাওয়া ভালো। পাশাপাশি কিশমিশ, বাদাম, পেঁপে, বেল বা আমের জুস ইত্যাদিও খেতে পারেন।

কিন্তু এক মাস রোজা রাখার পর সকালে খাবার গ্রহণেই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। মিষ্টিজাতীয় খাবার পরিমাণে কম খেতে হবে। আর যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তাদের মিষ্টিজাতীয় খাবারে একটু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। অনেক বাড়িতে ঈদের দিন সকালে খিচুড়ি-মাংসের প্রচলনও আছে। সেখানেও একই কথা। অর্থাৎ অল্প পরিমাণে খেতে হবে। নইলে সকাল থেকেই এসিডিটি বা বুকজ্বলা সমস্যা হবে। সারা দিনের ঈদের আনন্দ মাটি হবে।

দুপুরের খাবার
দুপুরের দিকে সাধাণরত পোলাও, বিরিয়ানি, রোস্ট—এ ধরনের গুরুপাক খাবার আমাদের দেশে ঈদের দিন তৈরি হয়। তবে ঈদের দিন দুপুরে এ ধরনের খাবার যত কম খাবেন তত ভালো। অবশ্য বয়সে তরুণ এবং যাঁদের খাবারদাবারে তেমন সমস্যা হয় না, তাঁরা খেতে পারেন। আবার যাঁরা অতি বয়স্ক বা বা মধ্য বয়সী, বিশেষ করে যাঁরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত তাঁরা একটু রয়ে-সয়ে খেলে বিপদে পড়বেন না। পোলাও বা বিরিয়ানি—এ ধরনের ভারী খাবারের সঙ্গে সালাদজাতীয় খাবার এবং টক বা মিষ্টি দই খাবেন। খাওয়ার শেষে কোমল পানীয় পান না করে লেবুর শরবত, টক দইয়ের লাচ্ছি, জুস খাওয়া ভালো।

রাতের খাবার
সারা দিন পোলাও বা বিরিয়ানি, মিষ্টিজাতীয় ভারী খাবার খাওয়া হয় বলে রাতের মেন্যুটা সাধারণ হওয়া দরকার। তাই  রাতের মেন্যুতে ভাত বা রুটি রাখতে পারেন। কেননা এমনিতেই রাতের খাবার একটু লাইট বা হালকা হওয়া ভালো। তার ওপর এক মাস রোজা রেখে হঠাৎ করে দিনে তিন বেলা খাবার খাচ্ছেন সেটাও মাথায় রাখতে হবে। অতিভোজন বা বেশি খেলেই যত বিপত্তি বাধে। এমনকি রাতে কোনো দাওয়াতে গেলেও অল্প পরিমাণে খাবেন। রাতের খাবারের সময় সাধারণত একত্রে বসে অনেক গল্পগুজব করে খাওয়া হয়। এতে অতিরিক্ত বাতাস পাকস্থলীতে ঢুকে, ফলে বারবার ঢেঁকুর তোলার সমস্যা হয়। তাই খাবারের সময় যতটা সম্ভব কম গল্পগুজব করা উচিত। রাতের খাবারের পর হালকা ব্যায়াম বা কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করা ভালো। খাওয়ার অন্তত দুই ঘণ্টা পর ঘুমাতে যাবেন।

তৈলাক্ত খাবারে সাবধানতা
বাড়ির পাশাপাশি বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের বাসায় বেড়াতে গিয়ে অনেক খাবারই খেতে হয়। এ সময় প্রায় সব বাসাবাড়িতেই ঈদের দিনে চলে পোলাও, কোর্মা, বিরিয়ানি, মুরগি, খাসি বা গরুর ভুনা গোশত, কাবাব, রেজালা প্রভৃতির ব্যাপক আয়োজন। যাদের এসব খাবারে তেমন সমস্যা হয় না, তাদেরও পরিমাণে একটু কম খাওয়া উচিত। কেননা এক মাস রোজা রাখার পর পাকস্থলীতে একেবারে বেশি চাপ দেওয়া ঠিক নয়। অনেকে অনিচ্ছায় বা পীড়াপীড়িতে অতিভোজন করে ফেলেন। এতে কিন্তু সমস্যা তৈরি হয়। অনেক সময় অধিক চাপে পাকস্থলীর পাচক রস বা এনজাইম ঠিকমতো কাজ করে না। মনে রাখতে হবে, এসব খাবার পরিপূর্ণভাবে হজম করতে অন্তত ১০ থেকে ১২ ঘণ্টার মতো সময় দরকার। সুতরাং একবার খাওয়ার পর অন্তত সে সময়টুকু বাদ দিয়ে পরে আহার করা উচিত, অন্যথায় একসঙ্গে বেশি খাওয়ার ফলে পেটে অস্বস্তিকর অনুভূতি, ভরা ভরা ভাব, বারবার ঢেঁকুর ওঠা, এমনকি বুকে ব্যথা পর্যন্ত হতে পারে।

রোগীদের জন্য পরামর্শ
যাঁরা বিভিন্ন রোগে ভুগছেন, তাঁরা এ সময়টাতে সতর্ক থাকবেন বেশি। খাবারের অনিয়মের কারণেই সাধারণত পেটব্যথা, গ্যাস্ট্রাইটিস, ডায়রিয়া, বমি, পেটফাঁপা ইত্যাদি দেখা দেয়। দুই-এক দিন বেশি খেতে যদিও খুব বাধা নেই, তবুও খাওয়া উচিত কম। আবার আগে যেসব খাবারে সমস্যা হওয়ার ইতিহাস আছে, তা পরিহার করা উচিত।
যাঁদের হার্টের সমস্যা রয়েছে, তাঁরা তেল বা চর্বিজাতীয় খাবার যথাসম্ভব এড়িয়ে চলবেন। ডায়াবেটিস রোগীরা চিনি এড়িয়ে মাঝেমধ্যে অল্প অল্প করে খাবেন। কিডনির সমস্যা থাকলে প্রোটিনজাতীয় খাদ্য যেমন—মাছ, মাংস, ডিম ইত্যাদি সামান্য খাবেন। ফলমূলও বেশি খাওয়া যাবে না।

রোজা রাখার ফলে দীর্ঘক্ষণ পেট খালি থাকায় পেপটিক আলসারের রোগীদের নিঃসরিত হাইড্রোক্লোরিক এসিড পাকস্থলী ও ডিওডেনামে ক্ষত তৈরি করতে পারে। ঈদের দিন তৈলাক্ত ও ঝাল-মসলাযুক্ত খাবার খাওয়ায় পাকস্থলী ও ডিওডেনামের ক্ষতে তাদের আবার প্রদাহের সৃষ্টি হয়। ফলে বুক ও পেট জ্বালা অনেক বেড়ে যায়। আইবিএস বা ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম রোগে যাঁরা ভুগছেন, তাঁদের সমস্যাটা আরো বেশি হয়। তাঁদের ক্ষেত্রে দুগ্ধজাত খাবারগুলো যেমন—পায়েস, সেমাই, হালুয়া ইত্যাদি খাবার একেবারে এড়িয়ে যাওয়া কিংবা যথাসম্ভব কম খাওয়া প্রয়োজন। কেননা এসব খাবারে অস্বস্তি, ঘন ঘন মলত্যাগ ও অসম্পূর্ণ মলত্যাগের অনুভূতি হয়।

যাঁদের অ্যানাল ফিশার ও পায়ুপথে জ্বালাপোড়া, ব্যথা ইত্যাদি আগে থেকেই আছে, তাঁদের এ সমস্যা প্রকট হয়। যাঁদের হিমোরয়েড বা পাইলসের সমস্যা আছে, তাঁদের পায়ুপথে রক্তক্ষরণও হতে পারে। এ জন্য খাবারের পর ইসবগুলের ভুসি খেতে পারেন।

মনে রাখা ভালো
♦  দিনে বিভিন্ন খাবারের ফাঁকে ফাঁকে প্রচুর পানি ও অন্যান্য তরল খান।
♦  বেশি গরম বা বেশি ঠাণ্ডা—এমন অবস্থা থেকে সতর্ক থাকুন।
♦  ফুটপাতের বা খোলামেলা খাবার একদম এড়িয়ে চলুন।
♦  পানি ফুটিয়ে পান করবেন। গ্রামের দিকে গেলে টিউবওয়েলের পানি পান করাই ভালো। তবে এলাকায় আর্সেনিক বা অন্য কোনো সমস্যা থাকলে সতর্ক হতে হবে।
♦  মাংসে তেল বা ঘিয়ের পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে, ভুনা মাংসের বদলে কাবাব খেতে পারেন।
♦  সালাদ, দই ও আঁশজাতীয় খাবার রাখুন খাবারের তালিকায়।
♦  চটপটিজাতীয় খাবার বা টকজাতীয় খাবারও খেতে পারেন।

দরকারি কিছু ওষুধ
এ সময় হাতের কাছে পেটের পীড়ার ওষুধ, খাওয়ার স্যালাইন, বমির ও পেট ফাঁপা নিয়ন্ত্রণের জন্য ডমপেরিডন-জাতীয় ওষুধ, সর্দি-জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল ও অ্যান্টিহিস্টামিন-জাতীয় ওষুধ হাতের কাছে থাকা দরকার।

শিশুদের নানা অসুখবিসুখে এ সময় হাতের কাছে সর্দি-জ্বর ও বমির সিরাপ রাখা উচিত, বিশেষ করে যাঁরা শহর থেকে গ্রামে যাচ্ছেন তাঁদের এ বিষয়ে বেশি নজর দেওয়া দরকার। আর যাদের নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হয়, তারা হাতের কাছে সেসব ওষুধ রাখুন।